রাজনৈতিক আলোচনা- 'গণতন্ত্র : চাইলেই ধরা দেয় না' by এমাজউদ্দীন আহমদ

পাশ্চাত্যের পর্যালোচকরা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বাংলাদেশকে একটি মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে খুশি হন। খুশি হন এ কারণে যে পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্রগুলোর বেশির ভাগে যে ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে, কোথাও রাজতন্ত্রের মোড়কে, কোথাও একনায়ক বা শেখদের আধিপত্যে, কোথাও নির্বাচিত আধিপত্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণে জনজীবন বাধা পড়েছে, সে তুলনায় বাংলাদেশে চালু রয়েছে একধরনের মধ্যপন্থার শাসন। এখনো বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুষ্ট হয়নি বটে; কিন্তু যে পথে চললে গণতন্ত্র পরিপূর্ণ অবয়বে অন্যত্র পরিস্ফুট হয়েছে_বাংলাদেশের অনুসৃত পথ অনেকটা তেমনি। এ অর্থে বিদেশি পর্যালোচকরা মডারেট মুসলিম দেশরূপে বাংলাদেশকে চিহ্নিত করলে দোষের কিছু নেই।
কিন্তু বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যাঁরা চিন্তাভাবনা করেন, তাঁরা বিদেশি পর্যালোচকদের প্রদত্ত এ অভিধায় অত্যন্ত নাখোশ। নাখোশ এ কারণে যে বাংলাদেশের জনসমষ্টির বিরাট অংশ মুসলমান হলেও স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে যাঁরা বিরাট অবদান রেখেছেন তাঁরা কখনো এটিকে মুসলিম রাষ্ট্ররূপে দেখেননি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যে একটি মুসলিম রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হবে তাও কল্পনা করেননি। শুধু মুসলমানদের প্রাধান্যে এ দেশ পরিচালিত হবে তা-ও ভাবেননি। সবার স্বপ্ন ছিল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার।
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে ভিন্ন প্রক্রিয়ায়। কোনো গোলটেবিলের চারপাশে বসা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে এর জন্ম হয়নি অথবা কোনো ধরনের দেন-দরবারের ফসল বাংলাদেশ নয়। নয় কোনো আধিপত্যবাদী শক্তির দাক্ষিণ্য। এ দেশের জনগণ এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ছিনিয়ে এনেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাদের যুদ্ধ করতে হয়েছিল মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের বর্বর সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। সুতরাং মডারেট মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশ_এ ধরনের উক্তি এ দেশের জনগণের কাছে কখনো সম্মানজনক হতে পারে না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের আপামর জনসাধারণ সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে অর্জন করেছে আজকের এ স্বাধীন দেশের মর্যাদা। আর এই জনসাধারণের মধ্যে রয়েছে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান এবং বিভিন্ন শ্রেণীর আদিবাসী, উপজাতীয় জনগোষ্ঠী। সঙ্গে সঙ্গে এটিও স্মরণযোগ্য যে জাতি হিসেবে বাংলাদেশিরা আজ পর্যন্ত যা কিছু অর্জন করেছে তাও সম্মিলিতভাবে, এ ভূখণ্ডের অধিবাসী হিসেবে কোনো ধর্মের অনুসারী হিসেবে নয়। ১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের দিকে দৃষ্টি দিন অথবা দিন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, দেখবেন, এ দেশের জনগণ সব বিভাজন, অনৈক্য, বৈষম্যকে ছাড়িয়ে যখনই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তখনই তাদের হাতে বিজয় ধরা দিয়েছে। এসব কারণে এ ভূখণ্ড সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে কোনো দিন তেমনভাবে কলুষিত হয়নি। পীড়িত হয়নি ধর্মের ভিন্নতাহেতু সৃষ্ট কোনো সামাজিক পীড়ায়।
সত্যি বটে, বাংলাদেশ মধ্যপন্থার একটি দেশ। উগ্রতা এখানে এক বিরাট ব্যাধির মতো এবং সেই ব্যাধিকে সবাই এড়িয়ে চলেন। নিকট-অতীতে কিছুসংখ্যক বিপথগামী ইসলামী আইনের দোহাই দিয়ে দেশে যে বীভৎস সন্ত্রাস সৃষ্টিতে তৎপর হয়েছিল, দেশের বিভিন্ন অংশে ভীতিকর এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, তাদের সেই বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডকে ঘৃণ্য, জঘন্য, অনৈসলামিক বলে চিহ্নিত করতে সবার আগে এগিয়ে এসেছিলেন এ দেশের ধর্মভীরু আলেম-ওলামাদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা। মধ্যপন্থার দেশ বলে এ দেশের জনগণের প্রিয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো গণতন্ত্র। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনব্যবস্থা। এর কোনো বিকল্প এ সমাজে অগ্রহণযোগ্য। সত্যি বটে, গণতন্ত্রের শিকড় এখনো সমাজজীবনের গভীরে প্রবেশ করেনি; কিন্তু জনগণের চিন্তাচেতনায়, ভাবে-আবেগে গণতন্ত্রের সুরই ঝংকৃত। গণতান্ত্রিকব্যবস্থাকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে যে ব্যর্থতা তা জনগণের নয়। এ ব্যর্থতা সমাজের অধিপতি শ্রেণীর। রাজনৈতিক নেতৃত্বের। রাজনৈতিকব্যবস্থার কাঠামোর। রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে নিয়োজিত ব্যক্তিদের। তা সত্ত্বেও, বলতে কোনো দ্বিধা নেই, গত দেড় দশকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যা অর্জিত হয়েছে তা মোটেই অকিঞ্চিৎকর নয়।
গণতন্ত্রের পথ সব সময় কণ্টকাকীর্ণ। দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে পাশ্চাত্যে গণতন্ত্র উঁচু বেদিতে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশকেও সেই গন্তব্যে পেঁৗছতে হবে। এ জন্য বেশ কয়েকটি সিঁড়ি অতিক্রম করা প্রয়োজন, ধীরে কিন্তু সাহসের সঙ্গে, অব্যাহত গতিতে। অন্যতম পদক্ষেপ হলো, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালীকরণ এবং তাদের সার্থক গণতন্ত্রায়ণ। এর কোনো বিকল্প নেই। একাধিক রাজনৈতিক দল ব্যতীত গণতন্ত্রের বাসরঘর সজ্জিত হয় না। গণতন্ত্রকে এ জন্য বলা হয়ে থাকে বহুদলীয় ব্যবস্থা। রবার্ট ডালের কথায় বহুমাত্রিকতা। এ ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য এ বহুমাত্রিকব্যবস্থার সর্বস্তরে গণতান্ত্রিকতার সুষম বিকাশ ঘটানো অপরিহার্য, রাজনৈতিক দলে তো বটেই। যে রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রের বিকাশ এখনো ঘটেনি, সেই দল শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সমাজব্যাপী গণতন্ত্রের ফুল ফোটাবে কিভাবে? নিজে গণতান্ত্রিক হয়েই সর্বস্তরে গণতন্ত্রের বাণী প্রচার করা সম্ভব। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, জাতীয় সংসদ তথা জাতীয় সংসদের বিভিন্ন কমিটি পর্যায়ে গণতান্ত্রিক নীতির পূর্ণ বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সংগঠিত আইন পরিষদের তাৎপর্য অনুধাবন করে এ সংস্থাটিকে রাজনৈতিকব্যবস্থার শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এ সংস্থাটিকে সর্বাবস্থায় কার্যকর করে, এটিকে প্রো-পিপল সংস্থারূপে তুলে জনসমষ্টির আশা-আকাঙ্ক্ষার সবটুকু এ সংস্থার মধ্যে জারিত করে গণতান্ত্রিকব্যবস্থার শ্রীবৃদ্ধি সম্ভব। অন্যদিকে যে আইন পরিষদ সংগঠনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা এত উজ্জ্বল এবং যে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সার্বিক সহায়তায় তা সম্ভব হয়েছে, সেই ব্যুরোক্র্যাসির শক্তি বৃদ্ধি, বিশেষ করে তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে তার স্বশাসিত শক্তিমত্তার প্রসার ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই গণতান্ত্রিকব্যবস্থায়।
গণতন্ত্র হলো সার্বিক এক ব্যবস্থা। আংশিক গণতান্ত্রিক বা আধা-গণতান্ত্রিক_এসব ধারণা অবাস্তব। যেমন অর্ধত্রিভুজ হয় না, তেমনি অর্ধগণতন্ত্র অবান্তর। অন্য কথায়, সমাজে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সর্বস্তরে এর প্রয়োগ। কেন্দ্রের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য তাই চাই প্রান্তেও গণতন্ত্রের উপস্থিতি। স্থানীয় সরকারের সব পর্যায়ে_গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে প্রশাসনকে গণতন্ত্রের রসে সিক্ত করতে হবে। গণতন্ত্রের সমগ্র প্রান্তর থাকে জনপ্রতিনিধিত্বের শ্যামলিমায় স্নিগ্ধ, থাকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সবুজ রঙে রঙিন।
চাইলেই গণতন্ত্র ধরা দেয় না। এ জন্য মনেপ্রাণে প্রস্তুতি নিতে হয়। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তা অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশের জনগণ এ জন্য প্রস্তুত। রাজনৈতিক নেতারা যদি সচেতন ও সজ্ঞান প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হন তাহলে ভয় কিসের?
=====================
আন্তর্জাতিক- 'কোরীয় অঞ্চলে নতুন উত্তেজনা কত দূর যেতে পারে?' by জগলুল আহমেদ চৌধূরী  আলোচনা- 'মানসিক নির্যাতনের প্রতিকার কোথায়' by আশরাফ-উল-আলম  আসুন, ওদের দিকে মমতার হাত বাড়িয়ে দিইঃ গোলটেবিল বৈঠক।এইচআইভি/এইডস : প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবা ও মানবাধিকার  আলোচনা- 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস'  আলোচনা- 'নেত্রীর অশ্রুপাত, হরতাল এবং অ্যাকশনে বিএনপি' by সঞ্জীব রায়  আলোচনা- 'আরো আলোকিত হোক জনশক্তি রপ্তানি খাত'  আলোচনা- 'কানকুন সম্মেলনে আমাদের প্রত্যাশা' by শিরীন আখতার  আলোচনা- 'জনসংখ্যার বিপদ ও পরিত্রাণের পথ'  শিল্প-অর্থনীতি 'বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতি:দুর্ভাবনার বিষয়' by ড. আর. এম. দেবনাথ  গল্পসল্প- 'হায়রে নাড়ি ছেঁড়াধন' by শিখা ব্যানার্জী  গল্পসল্প- 'জননী ও জন্মভূমি' by শুভ রহমান  গল্পালোচনা- ''বিভীষণ' বিদায় ও হরতাল সমাচার' by শুভ রহমান  খবর- হরতালের বিরুদ্ধে একজোট, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা  আলোচনা- 'হজ ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে কিছু কথা' by এয়ার কমোডর (অব.) মুহম্মদ জাকীউল ইসলাম  শিল্প-অর্থনীতি 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেতন-কাঠামো' by খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ  স্মরণ- 'মীর শওকত আলী বীর উত্তম : একজন বীরের প্রতিকৃতি' by ড. আশকার ইবনে শাইখ  আন্তর্জাতিক- 'মিয়ানমারে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ' by আহসান হাবীব  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিচিত্র সংকটের আবর্তে একটি বাড়ি' by এবিএম মূসা  ইতিহাস- 'হাজংমাতা শহীদ রাশিমনির স্মৃতিসৌধে' by দীপংকর চন্দ


দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ এমাজউদ্দীন আহমদ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য , কা বিশ্ববিদ্যালয়


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.