গল্পসল্প- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী

লিসার মা বললেন, বয়সও বেশি, চেহারাটাও বাজে। আবার নাকি সময় সময় তার বেশ্যাসক্তিও দেখা দেয়। হোক না জমিদারের সন্তান, জেনেশুনে লিসাকে তার দিকে ঝুঁকতে দেওয়া কি ঠিক হবে? ডাক্তার আঁদ্রে বের্স বললেন, দেখো লিউবোফ, আমি তোমার কথা উড়িয়ে দিচ্ছি না। তোমার যখন ব্রেইন ফিভার হলো, তোমাদের জ্ঞাতি ডাক্তার বাদ দিয়ে আমার মতো বুড়ো একজন হাতুড়ে ডাক্তারকে ধরে নিয়ে এল তোমার বাবা।
তুমি তখন বুড়ো ছিলে না। হাতুড়েও না।
তা ঠিক, কিন্তু তোমার-আমার বয়সের পার্থক্য ছিল আঠারো বছর, এটা তো অস্বীকার করবে না? তোমার ষোল আর আমার...।
আঠারো বছর কোথায়? তুমি নিজের বয়সটা বড় বাড়িয়ে বল। আসলে তুমি আমার চেয়ে সতের বছর সাড়ে ৯ মাসের বড় ছিলে।
বেশ, মেনে নিলাম। এবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখ তো, আমার চেহারাও কি বাজে নয়?
ধ্যাত, আমার যখন ব্রেইন ফিভার, তুমি যখন গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে আর হাতে থার্মোমিটার আর কী সব যন্ত্রপাতি নিয়ে আসতে, কী দারুণই না লাগত তোমাকে। সে জন্যই তো তোমার ইশারায় সাড়া দিলাম।
ডাক্তার বললেন, আমিও বুঝিনি এভাবে সুইট সিঙ্টিন এক রোগিণীর কাছে ধরা পড়ে যাব। একেবারে জনমের মতো।
ধরা পড়েছিলে বলেই না লিসা, সোনিয়া আর তানিয়ার মতো তিনটা ফুটফুটে মেয়ে পেয়েছ। আমাকে না পেলে তোমার ওই ব্যক্তিগত যন্ত্রটা বন-বাদাড়ে যার-তার ওপর প্রয়োগ করতে, আর নষ্ট মেয়েদের কাছ থেকে নোংরা সব অসুখ-বিসুখ ধার করে এনে নিজের অপমৃত্যু ঘটাতে।
ডাক্তার বের্স বললেন, শুনলাম, কাউন্ট নাকি তোমারই ছেলেবেলার বন্ধু? তার ব্যাপারে এত কঠোর হলে চলবে?
বন্ধু না ছাই। ওর বোন মারিয়া ছিল আমার বান্ধবী। আর কাউন্ট লেভ তলস্তয় আমার আর মারিয়ার চেয়ে তিন বছরের ছোট। তুমি তো জান না, ও কতটা হিংসুটে। আমাকে একবার রেলিং থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল। তারপর হাড় ভেঙে কয়দিন গেল বিছানায়। কিন্তু ওর বদমায়েশি নাকি এখনো আছে। জুয়া খেলে সাত হাজার টাকা খুইয়েছে। বেশ্যাটেশ্যা নিয়ে আর বলতে চাই না, আমার বমি এসে যায়। পুরুষ মানুষের রুচিটুচি বলে কিছু নেই_এই শহরের বিউটি কুইনও যা, সাইবেরিয়ার মাদি ভল্লুকও তা।
ডাক্তার বলেন, জমিদারের ছেলেদের কাজকর্ম কম থাকে বলে চবি্বশ ঘণ্টার দু-চার ঘণ্টা মেয়েমানুষের পেছনে ব্যয় করতেই পারে। সবাই তো আর ইমামতি করবে না।
ডাক্তার আর একটু এগিয়ে গিয়ে বলে ফেলতে চেয়েছিলেন, তোমার বাবাও তো জমিদার-পুত্র, তাঁর কথাই ধর না কেন। জমিদার পুত্ররা এসব না করলে তোমারও জন্ম হতো না। তুমিও তো ইললেজিটিমেট_সোজা কথা, অবৈধ সন্তান। কিন্তু কথাটা শেষ পর্যন্ত বলেননি। ডাক্তার বললেন, তলস্তয়দের শীতলক্ষার পাড় কাপাসিয়া ও সোনার গাঁও জমিদারিতে কাউন্ট লেভ পেয়েছে চার হাজার একর জমি, শ-চারেক ভূমিদাস, তা ছাড়া লিখেটিখে এর মধ্যে তো বেশ বিখ্যাতও হয়ে উঠেছে। তোমার ছোটবেলার বন্ধু, তুমিই ভালো বুঝবে। লিসার মা বললেন, এ জন্যই তো বলি, ছেলেদের কম বয়সে বিয়ে করাটাই ভালো। তাহলে আর রতিক্রিয়ার জন্য এখানে-সেখানে যাওয়ার দরকার হয় না। সংসারও হয়, বাচ্চারাও তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়।
ডাক্তার বললেন, লিউবোফ আমি যদি আরেকবার জন্মগ্রহণ করি, যেদিন বুঝব শরীরের ভিন্ন একটি ভাষা আছে, সেদিনই বিয়ে করে ফেলব।
দুই.
প্রায় আট মাইল হেঁটে কাউন্ট লেভ তলস্তয় ডাক্তারের বাড়িতে আসেন। লিসাদেরও একটি খামার আছে ভাওয়ালের কাছে। ফেরার পথে মা-সহ লিসা, সোনিয়া ও তানিয়া গোটা সপ্তাহ কাটিয়ে গেল লেভ-এর জমিদারিতে। লিউবোফ এবার এমন ধারণা নিয়ে গেল যে লেভ-এর মতো পাত্র, বয়স একটু বেশি হলেও হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। আর পুরুষ মানুষের কিছু দোষ তো থাকবেই। নিজের বাবাও তো এমন কোনো ধোয়া তুলসীপাতা ছিল না।
এর মধ্যে একদিন চেম্বার সেরে এসে ডাক্তার বের্স স্ত্রীকে বললেন, সিলাকে খুব মনমরা দেখাচ্ছে যে।
লিউবোফ বললেন, হবে না। আমরা কী ভাবছি, আর কী ঘটছে?
মানে?
কাউন্ট আসলে লিসার ব্যাপারে আগ্রহী নয়।
তাহলে জুয়াড়ি বদমাশটাকে আর আসতে দেওয়া ঠিক হবে না। মা-বাবা হিসেবে আমাদের ভূমিকা অবশ্যই পালন করতে হবে। আমার মেয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে এসেছে নাকি?
লিউবোফ বললেন, তুমি অযথা খেপে যাচ্ছ। আমি তো বলিনি, লেভ কেবল ফুর্তি করতে এখানে আসে। ফুর্তি করার মতো মেয়ের অভাব নেই আমাদের রাজার রাজত্বে। অন্তরের একটা কঠিন টান না থাকলে কেউ আট মাইল হেঁটে এখানে আসে?
ঠিকই বলেছ, তোমার মতো ষোল বছর বয়সী রোগী আমার আরো ছিল। আমি তো তোমাকে দেখতেই বারবার এসেছি; অন্য কাউকে নয়।
শোন, বলছি শোন_কাউন্ট সোনিয়াকে পছন্দ করছে। সোনিয়াও তার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ব্যাপারটা তানিয়াও জানে। তানিয়ারও বয়স কম হয়নি_ষোল, এই বয়সেই আমি তোমাকে বিয়ে করি।
তানিয়া নিজেও এই বদখত দেখতে লোকটাকে পছন্দ করে। ১৬ তারিখ মানে গতকাল ১৬ সেপ্টেম্বর ১৮৬২ সোনিয়াকে প্রপোজ করেছে এবং শিগগিরই বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে।
তাহলে লিসার ব্যাপারটা কী হবে?
লিসাও প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছে, কাউন্টের চোখ সোনিয়ার ওপর।
তিন.
২৩ সেপ্টেম্বর ১৮৬২
বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে ঢাকা আর্মেনিয়ান চার্চে।
১৬ থেকে ২২_এই কয়দিনে কাউন্ট তাঁর পাগলামির চূড়ান্ত দৃশ্য দেখিয়ে ছেড়েছেন। বিয়ের দিন দেখা হবে চার্চে বিয়ের অনুষ্ঠানে। এর আগে বর ও কনে সাক্ষাৎ রীতিবিরুদ্ধ। অথচ সকালেই লেভ এসে হাজির। সরাসরি সোনিয়ার মুখোমুখি। তাঁকে দেখে সোনিয়া চমকে ওঠে। বাষ্পাক্রান্ত চোখ ঘষতে থাকে। গত দুই দিন প্রচণ্ড কষ্ট দিয়েছে লেভ। আত্মহত্যার ইচ্ছা জেগেছে।
লেভ জিজ্ঞেস করল, আমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত এখনো বহাল আছে তো?
সোনিয়া জবাব দেয় না।
আমাকে বিয়ে করার পর কি মনে হবে না অন্য কাউকে বিয়ে করলে ভালো ছিল?
সোনিয়া ফোঁপাতে থাকে।
তুমি কি নিশ্চিত যে এর পরও আমাকে ভালোবাসো?
সোনিয়া এবার হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।
এর পরও_মানে?
বিয়ে মানে তো দুই দেহ এক মন। এখানে লুকোচুরির সুযোগ কোথায়। তলস্তয় তাঁর বিগত বছরগুলোর ডায়েরি কয়টা সোনিয়ার হাতে তুলে দিলেন। বললেন, এগুলো পড় তাহলে আমাকে বুঝতে তোমার সুবিধা হবে। আমি প্রতিদিন যা করেছি, যা ভেবেছি_সব এখানে লেখা আছে। প্রেমে ও ক্ষমায় যদি আমাকে দেখ, তাহলে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে তুমি একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পার। আমারও একটা নোংরা অতীত আছে, যা আমার জীবনেরই অংশ। তারপর কাউন্ট লেভ তলস্তয় চলে যান।
ডায়েরি হাতে সোনিয়া তাঁর পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ভীরু হাতে ডায়েরির পাতা উল্টাতে থাকে।
২৬ জুন ১৮৬২
মেয়ে মানুষ দেখলেই আমি উচাটন হয়ে পড়ি। আমার মেজভাই আমার তাতিয়ানা ফুপুর বুয়াটার সঙ্গে যে কী-সব করে যাচ্ছে! কিন্তু আমি, ব্যাপারটা আসলে যে কেমন এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। এই অভিজ্ঞতা না হলেও আমি যে মূর্খই থেকে যাব। আমার গল্প-উপন্যাসে যখন এ ধরনের অবস্থা বর্ণনা দেব, তা হবে সম্পূর্ণ বানোয়াট ও আজগুবি। কেবল হস্তমৈথুনজ্ঞান-ভিত্তিক।
ঢাকা শহর ফড়িয়া আর বেশ্যার দালালে ভর্তি। কিন্তু আমি তাদের খপ্পরে পড়তে চাই না। আমাদের জমিদারিতেই কত সুপুষ্ট মেয়ে আছে। কয়জনের সঙ্গে চোখ ইশারায় কথাও বলেছি। কিন্তু তার আগে তো আমার সব কিছু জানা দরকার। আমি তাদের সামনে আনাড়ি হিসেবে চিহ্নিত হতে চাই না। হয়তো মেয়েটি বলে বসবে, তোমার মেজভাই এত বড় উস্তাদ আর তুমি দেখি অ আ ক খ-ও বোঝ না। যাও মায়ের দুধ চোষ গিয়ে।
শেষ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে কেরানীগঞ্জে এলাম। এখানে নদীর পাড়ে বেশ কয়েক ঘর বারবণিতার বসবাস। আমি যে পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা করেছিলাম, এখানকার সবচেয়ে সুন্দরী বারবণিতার রেটও তার দশ ভাগের এক ভাগ। আমি টাকা আগাম দিয়ে মাথা নিচু করে ঝাঁপ-দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে আগরবাতির মিষ্টি ধোঁয়া। আমার মনে হয়েছে, কোনো শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছি।
মেয়েটি বলল, আইস নাগর। আমার নাম চন্দ্রবানু। তোমার কী নাম?
লেভ তলস্তয়?
এই রকম নাম তো কোনো দিন শুনি নাই। কোন ধর্ম?
মানব ধর্ম।
চন্দ্রবানুর পান-লাল জিহ্বা দেখা যাচ্ছে। গালের টোলটাকেও মনে হচ্ছে একটি হীরের গহনা। চন্দ্রবানু বলল, ধর্ম যে-বা হোক, কর্ম হোক ভালো। সব ধর্মের মানুষই এই কাম করে, আমার কাছে আসে। আমারও বিশ্বধর্ম। প্যাঁচাল পারতে চাই না, কাটা না বরাবর?
আমি লজ্জা পেলাম। তারপর একসময় ব্যাপারটা ঘটেই গেল।
চন্দ্রবানু বলল, এত তাড়াতাড়ি পয়সা উসুল হলো?
আমি হোগলার ওপর কাঁথাপাতা বিছানায় উঠে বসি। প্যান্টের দড়ি বাঁধি, শার্টের বোতাম লাগাই। তারপর হঠাৎ ধর্ষিতা এক নারীর মতো হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করি।
আমার কান্নার কারণ, আমি কৌমার্য হারিয়েছি, চিরতরে হারিয়েছি।
২৩ মে ১৮৪৭
গত রাতে আমি কোথায় ছিলাম, কেউ জানে না। আমাদের জমিদারির সুইপার রমেশ তেওয়ারি অনেক দিন ধরে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছিল। বলল, বাবু টাকাটা বাইরের মানুষকে না দিয়ে আমাদের দিলে আমাদের আয়-রোজগারটা ভালো হয়। বিবি-বাচ্চা নিয়ে ভালো থাকতে পারি। আমি তার কথার মানে বুঝতে পারি। জিজ্ঞেস করি, কে?
রমেশ বলে, এই তল্লাটের সবচেয়ে পাকা, একবার গেলে বাবু আপনার মনে হবে বাৎসায়নের সরাসরি কোনো শিষ্যার কাছে এসেছেন। চৌষট্টি কলার সবই জানে। তবে বাবু তাড়াহুড়ো করলে হবে না। গোটা রাত থাকবেন, দুই পয়সা বেশি বকশিশ দেবেন।
আমি আবার জিজ্ঞেস করি, কে?
বাবু তার নাম রঙিনী তেওয়ারি, এই অধমের স্ত্রী। একদিন তার সঙ্গে থাকলে তিন দিন বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করবে না। একই রেট।
সত্যি সত্যি একটি অসাধারণ রাত কাটালাম। রমেশ তেওয়ারি ছনের ঘরের বাইরে বসে পাহারা দিল, আধা মিনিটের জন্যও ভেতরে উঁকি দিল না। ভোরের দিকে আমি যখন বেরিয়ে যাই, রমেশের মুখোমুখি হলে আমিই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলি।
কিন্তু আগ বাড়িয়ে রমেশ বলে, বাবু যখন মন চায় আসবেন। হাতে নগদ টাকা না থাকলেও আসবেন। আমার স্ত্রী আপনাকে পেয়েছে_এই অহংকারে আগামী এক মাস আমাকে তার কাছে ঘেঁষতে দেবে না। তখন আর কী করব_সস্তা দরের বেদেনি খুঁজে বের করব নিজের জন্য। বাবু কখনো যদি বেদেনি টেস্ট করতে চান বলবেন। ভয় একটাই, এদের আবার খারাপ অসুখ হয়।
এ পর্যন্ত এগারোজন রমণীর সঙ্গে আমার ব্যাপারটা ঘটে গেছে। আমি এ জন্য গভীর মনস্তাপের মধ্যে আছি। আমি নিজেকে যতই নীতিকথা শোনাই না কেন, আমার শরীর সে কথা শুনতে চায় না। শরীরের কারণে আমার পড়াশোনা ও লেখালেখিও ঠিকমতো হচ্ছে না। একেকবার মনে হয়, রঙিনীর কাছে যাই, বেদেনির কাছে, চন্দ্রবানুর কাছে যাই। অতৃপ্তি আমাকে ধ্বংস করে ফেলছে।
২৯ জুলাই ১৮৪৮
দেহের ক্ষুধা আমাকে অনেক নিচে নামিয়েছে। আমি আর নামতে চাই না। কিন্তু প্রতিজ্ঞা ধরে রাখতে পারি না। আজ সন্ধ্যার পর মণিপুর খামারের পাশে কৃষ্ণবর্ণ এক রমণীকে দেখে আমি আত্মহারা হয়ে যাই। একটি বৃক্ষের আড়ালে যখন উপনীত হই, সে খিলখিল করে হাসতে থাকে। আমি তার হাসির কারণ বুঝতে পারি না। আমি যখন টাকা সাধলাম নিল না। বলল, আমারও তো ভালো লেগেছে। আমি কি তোমাকে টাকা দেব? তুমি আমাকে যে টাকা দিতে, আমি তা-ই তোমাকে ফিরিয়ে দিলাম। ব্যস।
কিন্তু মেয়েটি কে? আমি তার রূপ-সাগরের সৈকতে অবগাহন করে এসেছি। আমাকে আরো গভীরে যেতে হবে। আমি বেশ বুঝতে পারছি, কামনাচ্যুত হতে হলে আমাকে মেয়েদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে_যতটা দূরে সম্ভব।
আমার কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। কাজ কামনাকে ধ্বংস করে। আমি আরো তিনটি ভাষা শিখব, সবগুলো ধর্মগ্রন্থ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ব, বেদে রমণীদের উপন্যাস রচনা করব।
২০ জানুয়ারি ১৮৪৯
এবার আমার তাতিয়ানা ফুপুর হাতে ধরা পড়ে গেলাম। গাশা নামের এই মেয়েটি তার খাস দাসী, আমি অনেক দিন ধরেই তার সঙ্গে ব্যাপারটা চালিয়ে আসছি। অধিকাংশ সময়ই গাশার ছোট্ট ঘরে। সবচেয়ে মর্মান্তিক হচ্ছে, অপরাধের প্রশ্রয় দেওয়ার অপরাধে গাশাকে চাকরিচ্যুত করে চিরদিনের জন্য তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মূল অপরাধীর কিছুই হলো না।
এই অবিচার আমাকে খুব পীড়া দিচ্ছে। এ আমার কেমন ভালোবাসা_তাড়িয়ে দেওয়া মেয়েটির খোঁজে আমি এখনো রাস্তায় নামছি না।
২৫ ডিসেম্বর ১৮৫১
আমি ঠিক বলতে পারব না, কোন বেদেনির কাছ থেকে উপদংশের মতো যৌনব্যাধি আহরণ করেছি। প্রচণ্ড জ্বর ও যন্ত্রণা। আজ সতের দিন চলছে। কথা ছিল জমিদারিতে ফিরে যাব। বিছানাই ছাড়তে পারছি না। মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, এই নোংরা রোগেই আমার মৃত্যু হবে। যা-ই হোক, পারদ চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠছি। চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি, জ্বরের কারণে আসা হচ্ছে না।
এ পর্যন্ত পড়ে সোনিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমের মধ্যে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠেছে। হঠাৎ জেগে উঠে মনে হয়েছে, আত্মহত্যার এখনই সময়। এরপর সোনিয়া সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
ডাক্তার বের্স তাঁর আদরের মেয়েটিকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে দেন। ঘুমটা ভালো হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
চার.
তলস্তয় আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এর পরও নিশ্চিত যে আমাকে ভালোবাসো?
ঠোঁট উল্টে অবোধ শিশুর মতো সোনিয়া কেঁদেই চলেছে।
ঠিক তখনই ডাক্তারের স্ত্রী, সোনিয়ার মা লিউবোফ ঘরে ঢুকে পড়েন। লেভকে ধমক দিয়ে বলেন, তুমি এখানে কেন? বিয়ের দিন তো দেখা করতে নেই। যাও, এক্ষণই চলে যাবে। চার্চেই দেখা হবে।
লেভ তলস্তয় ধীরে ধীরে বেরিয়ে যান।
তানিয়া, সোনিয়ার ছোট বোনটি আসলে এ বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। সংগীতে অত্যন্ত গুণী এই মেয়েটির একবার মনে হলো_সোনিয়া যদি কোনো একটা কারণ দেখিয়ে লেভকে প্রত্যাখ্যান করত, দারুণ হতো। সে-ই আটকে দিত লেভ তলস্তয়ের ফেরার পথ। বলত, যেতে পারবেন না, আমাকে আপনার চোখে লাগছে না। দেখুন, আমার কোনটা সোনিয়ার চেয়ে কম। যদি যেতে হয় আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন।
বেশ জমজমাট বিয়ে। কনে পক্ষ চার্চে প্রস্তুত। বরের দেখা নেই।
বর কি পালিয়েছেন?
যখন অপেক্ষা করতে করতে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ছে, তখন জানা গেল_কাপড়চোপড় সব ধোপাবাড়িতে থাকায় বিয়ের আচকান জোগাড় করতে লেভ তলস্তয়ের যাত্রায় দেরি হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত হাজির হলেন। জমজমাট সে বিয়েতে উপহার পাঠালেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রামমোহন রায়।
সব কিছু সহ্য করে সোনিয়া লেভ-এর সঙ্গে সংসার শুরু করলেন। তলস্তয়ের ভালোবাসা সব ভুলিয়ে দিল। 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' লিখতে শুরু করেছেন। তলস্তয় লিখেন, কাটেন। সোনিয়া সুন্দর করে লিখে তলস্তয়ের সামনে তুলে ধরেন। তলস্তয় আবার কাটেন। এ রকম কাটাছেঁড়া চলছেই। দীর্ঘদিন ধরে। আরো কয় বছর চলবে কে জানে।
বিয়ের দুই বছর পর সোনিয়া স্থায়ীভাবে চলে এলেন লেভ-এর জমিদারিতে। বাকি জীবন এখানেই কাটাবেন।
ঘোড়ার গাড়িতে আসা-যাওয়ার পথে সোনিয়া প্রায়ই লক্ষ করেন, বছর চারেকের একটি হালকা-পাতলা ছেলে জমিদারি সীমানার ধারে হাঁ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটি যেন তাঁর প্রতীক্ষায়ই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে।
তলস্তয় বললেন, সোনিয়া আর একটি কথা তোমাকে বলা হয়নি। সোনিয়া ঘোড়ার গাড়িতে তলস্তয়ের কানে বলল, ব্যাপারটা কিন্তু এখনো শুরু হয়নি। কয় সপ্তাহ আগেই হওয়ার কথা ছিল। আমার কিন্তু শীঘ্রই বমি শুরু হবে?
ঋতু বন্ধ, বমির জন্য অপেক্ষমাণ সোনিয়া তাহলে গর্ভবতী হয়ে পড়েছেন। সোনিয়ার প্রথম সন্তান আসছে।
তলস্তয় বললেন, তুমি মা হতে যাচ্ছ।
সোনিয়া বললেন, এখন কাউকে বলবে না কিন্তু।
আচ্ছা।
তারপর তলস্তয় আবার বলতে শুরু করলেন, সোনিয়া আরেকটি কথা তোমাকে বলা হয়নি।
কী কথা? আচ্ছা, তুমি না বলেছ পুশকিনের কবিতা তোমার ভালো লাগে_পুশকিন কিন্তু আমারও প্রিয় কবি।
তলস্তয় বললেন, চার বছর বয়সী ওই হালকা-পাতলা ছেলেটি আমারই। ছেলেটির নাম টিমোথি। ওর মা একজন কৃষাণী, নাম আকসিনিয়া বাজিকিন। তুমি তো জানোই, আমিও সারা জীবন কৃষকের জীবনই চেয়েছি। আর পুশকিন তো অবশ্যই ভালো, সবচেয়ে জঘন্য হচ্ছে শেকসপিয়র। আমি একদম সহ্য করতে পারি না।
ঠিক তখনই সোনিয়ার গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করে ভেতর থেকে উঠে আসে মুখভর্তি বমি। সোনিয়া ধরে রাখতে পারেন না। উগড়ে দেন। অর্ধেক পড়ে গাড়ির বাইরে, অর্ধেক ভেতরে, কিছুটা তলস্তয়ের গায়ে।
তলস্তয় পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করে সোনিয়ার মুখ মুছে দেন। বলেন, আমি খুশি হয়েছি।
দূরের টিমোথি মূর্ত হয়ে ওঠে সোনিয়ার সামনে। তলস্তয়ও ভাবেন, আকসিনিয়া তো তার কাছে এতটুকু শুশ্রূষা পাওয়ার দাবি কখনো করতে পারেনি।
তাহলে তাঁর মহাপুরুষ হওয়ার সুযোগ আর নেই। তলস্তয় কেবলই মানুষ।
[তবে টিমোথি তাঁর জীবন কাটিয়েছেন লেভ তলস্তয় জমিদারিতে গাড়ির কোচোয়ান হিসেবে। কৃষাণ-বধূ আকসিনিয়ার সঙ্গে তলস্তয় প্রায় তিন বছর দৈহিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন।]
==========================
আলোচনা- 'সেই আমি এই আমি' by আতিকুল হক চৌঁধুরী  ইতিহাস- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের হৃদয়সংবেদী ডায়েরি' by দেবেশ রায়  স্মরণ- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের মৃত্যু-শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি' by বেলাল চৌধুরী  ইতিহাস- 'বাংলায় সিপাহি বিদ্রোহ' by রিদওয়ান আক্রাম  শিল্প-অর্থনীতি 'এখন প্রয়োজন ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের' by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'গণতন্ত্র : চাইলেই ধরা দেয় না' by এমাজউদ্দীন আহমদ  আন্তর্জাতিক- 'কোরীয় অঞ্চলে নতুন উত্তেজনা কত দূর যেতে পারে?' by জগলুল আহমেদ চৌধূরী  আলোচনা- 'মানসিক নির্যাতনের প্রতিকার কোথায়' by আশরাফ-উল-আলম  আসুন, ওদের দিকে মমতার হাত বাড়িয়ে দিইঃ গোলটেবিল বৈঠক।এইচআইভি/এইডস : প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবা ও মানবাধিকার  আলোচনা- 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস'  আলোচনা- 'নেত্রীর অশ্রুপাত, হরতাল এবং অ্যাকশনে বিএনপি' by সঞ্জীব রায়  আলোচনা- 'আরো আলোকিত হোক জনশক্তি রপ্তানি খাত'  আলোচনা- 'কানকুন সম্মেলনে আমাদের প্রত্যাশা' by শিরীন আখতার  আলোচনা- 'জনসংখ্যার বিপদ ও পরিত্রাণের পথ'  শিল্প-অর্থনীতি 'বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতি:দুর্ভাবনার বিষয়' by ড. আর. এম. দেবনাথ  গল্পসল্প- 'হায়রে নাড়ি ছেঁড়াধন' by শিখা ব্যানার্জী  গল্পসল্প- 'জননী ও জন্মভূমি' by শুভ রহমান  গল্পালোচনা- ''বিভীষণ' বিদায় ও হরতাল সমাচার' by শুভ রহমান  খবর- হরতালের বিরুদ্ধে একজোট, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা  আলোচনা- 'হজ ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে কিছু কথা' by এয়ার কমোডর (অব.) মুহম্মদ জাকীউল ইসলাম


দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আন্দালিব রাশদী


এই গল্পসল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.