দায়মুক্ত মিতা দুদকের কাঠগড়ায় by মারুফ কিবরিয়া

সাড়ে তিন বছর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চলমান দুর্নীতির অনুসন্ধান থেকে ‘দায়মুক্তি’ পান চট্টগ্রাম-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা। অভিযোগ ছিল অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি। দুদকে থাকা অভিযোগনামায় নানা তথ্য উপাত্ত থাকা সত্ত্বেও ছাড় পান মিতা।

গুঞ্জন রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে সংস্থাটি তার অনুসন্ধান থেকে সরে আসে। তবে ক্ষমতা হারানোর পর নতুন করে আবারো দুদকের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে মিতাকে।

এবার দুদকের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, ৩ মেয়াদে এমপি থাকাকালে নানা অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। সংস্থাটির গোয়ান্দা ইউনিটের প্রতিবেদনেও মিতার দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে।  
সংস্থাটি জানায়, এমপির দায়িত্ব পালনকালে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনৈতিক কার্যক্রমসহ নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামায় তার বার্ষিক আয় ছিল ৪৭ লাখ ৫ হাজার ৮০৫ টাকা। গত ১০ বছরে তার আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ লাখ ৬৭ হাজার ৮২৪ টাকা। যা ২০১৪ সালের বার্ষিক আয়ের তুলনায় ১০১.২ শতাংশ বেশি এবং অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১৯৯.২৩ শতাংশের বেশি। স্ত্রী মাহমুদা মাহফুজের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১৯০ শতাংশের বেশি।

দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে মিতা ও তার স্ত্রীর নামে পূর্বাচলে প্লট, মতিঝিলে ৫ কাঠা জমির উপর নির্মিত বিল্ডিং, গুলশানে ফ্ল্যাট, উত্তরায় দিয়াবাড়িতে ৫ কাঠা জমির প্লট, হারামিয়া সন্দ্বীপে জমি বাড়ি এবং মাহফুজুর রহমান মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এর আগেও ২০২০ সালে মিতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অনুসন্ধানে নেমে সেখান থেকে সরে আসে দুদক। মিতার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগটি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করে কমিশন। ২০২১ সালে অভিযোগ নিষ্পত্তির বিষয়টি অনুমোদন করার পর ২রা মার্চ তৎকালীন দুদক সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার অব্যাহতির বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি দিয়ে জানান। এরপর বিষয়টি মাহফুজুর রহমান মিতাকে চিঠি দিয়ে জানানোর পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিবকে অনুলিপি দিয়ে জানানো হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে ৯ই মার্চ অবসরে যাওয়া দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের আগ্রহে তড়িগড়ি করে মিতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষ করা হয়।

সে সময় মিতার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ ও দুদকের অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, ঢাকার পূর্বাচলে নিজের মালিকানাধীন রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের নামে ৫০ কাঠা জমি, নিজ নামে পূর্বাচলে আরও ৫ কাঠার জমি, গুলশান-২ রাজউকে একটি ফ্ল্যাট, চট্টগ্রাম হাউজিং সোসাইটি ও ঢাকার মিরপুর হাউজিংয়ে ফ্ল্যাট, নোয়াখালী ও খুলনাতে প্লটের মালিক হন মিতা। অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ সংসদ সদস্য মিতা তার পিএস জসিম, অফিস কর্মকর্তা মাকসুদ ও ওমর ফারুকের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ায় পাচার করেছেন-এমনও অভিযোগও দুদকের কাছে ছিল।

সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে দ্বিতীয় দফায় এমপি হওয়ার পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মাহফুজুর রহমান মিতা। ওই সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৯৭ কোটি টাকার বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক, মেসার্স বিশ্বাস বিল্ডার্স ও মেসার্স ডলি কনস্ট্রাকশনের কাছ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন আদায় করেন তিনি।  শুধু তাই নয়, ঠিকাদাররা কাজ শুরু করলে সেখানে অনৈতিক হস্তক্ষেপ করে নিজের লোক দিয়ে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ করেন চট্টগ্রাম-৩ আসনের সাবেক এই এমপি।

মিতার বিরুদ্ধে থাকা আরও অভিযোগ বলছে, সন্দ্বীপে সড়ক ও জনপদ বিভাগের বাস্তবায়নাধীন দেলোয়ার খাঁ সড়ক নির্মাণের ৭২ কোটি টাকার টেন্ডারে (টেন্ডার নম্বর-২১৯৬৫৪) অনিয়ম করেছেন মিতা। এই রাস্তার টেন্ডারে অংশ নেন তিনজন ঠিকাদার। আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা পরিষদ সদস্য আফতাব খান অমির প্রতিষ্ঠান ‘র‌্যাভ-আরসি’ সর্বনিম্ন দর আহ্বান করলেও সেই প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ না দিয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা জামায়াত নেতা জাহেদুর রহমান জিলামকে সাড়ে ৪ কোটি টাকা বেশি দরে কাজ পাইয়ে দেন মিতা। এই রাস্তার টেন্ডার নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির পর নির্মাণ কাজেও ব্যাপক অনিয়মের তথ্য সামনে চলে আসে। রাস্তা নির্মাণে জমি অধিগ্রহণের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করার লক্ষ্যে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ না দিয়ে ভেঙে ফেলা হয় সন্দ্বীপের বিভিন্ন বাজারের শত শত দোকান, ভবন।

বিআইডব্লিউটিএ’র গুপ্তছড়া জেটি নির্মাণ দুর্নীতিতেও মাহফুজুর রহমান মিতার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যায় সে সময়। সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে ৫২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা দিয়ে নতুন একটি জেটি নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিল তৎকালীন সরকার। এই জেটি নির্মাণের কাজটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এস এস রহমানকে দেয়ার জন্য ডিও দিয়েছিলেন মিতা। এখানেও কমিশনের বিনিময়ে নিজস্ব ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া ২০১৮ সালের সন্দ্বীপের পিআইও অফিস থেকে টেন্ডার হওয়া ২৭টি ব্রিজের কাজ সাবেক এমপি মিতা তার নিজস্ব লোকজনের মধ্যে ১৫ শতাংশ টাকা কমিশনের বিনিময়ে ভাগ-বাটোয়ারা করেন বলে জানা যায়।

টেন্ডার ও কমিশন বাণিজ্যের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সন্দ্বীপের শিক্ষা খাতও। ২০২০ সালে দুদকে আসা অভিযোগে বলা হয়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাজের টেন্ডারে কোনো ঠিকাদার মিতার অনুমতি ছাড়া অংশ নিতে পারেননি। নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন দেয়ার বিনিময়ে এই অধিদপ্তরের সকল টেন্ডারে এমপি মনোনীত একজন করে ঠিকাদার অংশ নেন। কমিশন নিয়ে কাজ পাইয়ে দেয়ার ওয়াদা দিয়ে তা রক্ষা করেন মিতা। ফলে সেই কাজও পায় তার আশীর্বাদপুষ্ট ঠিকাদার।

এভাবে মিতার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যুতা, ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে ঘুষ নিয়ে ঠিকাদার নিয়োগ, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিস্তর অভিযোগ ছিল দুদকে। সেই প্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ৬ই অক্টোবর তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য সংস্থার প্রধান কার্যালয়ের (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-১) সহকারী পরিচালক মো. শফি উল্লাহকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর ৮ই অক্টোবর মিতাকে চিঠি দিয়ে দুদক কর্মকর্তা শফি উল্লাহ ৩রা নভেম্বর সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করেন। এসব কাগজপত্র বিবেচনায় নিয়ে অভিযোগ নথিভুক্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে মিতাকে অব্যাহতি দিতে সুপারিশ করেন দুদকের কর্মকর্তা। পরে ২০২১ সালের ২রা মার্চ অভিযোগটি নিষ্পত্তি করা হয় বলে জানানো হয়।

অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে মিতার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। আমাদের চট্টগ্রামের স্টাফ রিপোর্টারের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর চট্টগ্রামের কোথাও দেখা যায়নি সাবেক এই এমপিকে।
এ বিষয়ে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আগের বিষয়টি আমি জানি না। আমি তো ২০২৩ সালে নিয়োগ পেয়েছি। কেন তাকে অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে তখনকার কমিশনই বলতে পারবেন। এবার দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের অনুসন্ধানে মিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ পাওয়ায় প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।  


No comments

Powered by Blogger.