কিছু কারখানার কারণে অশান্ত পুরো পোশাক খাত

সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার নামে পোশাক খাতে সৃষ্ট অস্থিরতা দূর করতে সরকার, মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। টানা দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে শ্রমিক অসন্তোষ চলে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েও আসে। কিন্তু মজুরি বৃদ্ধিসহ নতুন নতুন দাবিতে আবারো বিক্ষোভ করছেন পোশাক খাতের শ্রমিকরা। রোববার সকাল থেকে আশুলিয়ার বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়কের জিরাবো এলাকা পর্যন্ত সড়কের উভয়পাশে অবস্থিত বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা কারখানায় কাজ বন্ধ রেখে বিক্ষোভ করেন তারা। সংশ্লিষ্টদের দাবি, ঢাকার সাভার-আশুলিয়া এলাকার কিছু চিহ্নিত কারখানার কারণেই বার বার অশান্ত হচ্ছে পুরো পোশাকশিল্প। ফলে কারখানা মালিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। শিল্পমালিকরা জানান, শ্রমিক অসন্তোষের জেরে কারখানা বন্ধ থাকায় বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করা যায়নি। আবার যারা করেছে, তারা শিপমেন্ট করতে পারেনি। অস্থিরতার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান অর্ডার নিতে পারেনি। ফলে অনেক অর্ডার হাতছাড়া হয়ে গেছে।

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে সাভার-আশুলিয়ায় দীর্ঘদিন পোশাক কারখানা বন্ধ থাকায় শুধু ওই অঞ্চলের কারখানা মালিকদের ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি হয়েছে পুরো পোশাকশিল্পে। এর জের টানতে হচ্ছে এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। ক্রেতাদের কাছে নেতিবাচক খবর গেছে। ক্রেতারা অর্ডার কমিয়েছে। অনেক অর্ডার অন্যত্র চলে গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা কারখানার অভ্যন্তরে জড়ো হয়ে পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবিতে ‘পঁচিশ’ ‘পঁচিশ’ স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। সকাল থেকে আশুলিয়া এলাকার নিট এশিয়া, ডেকো, এনভয়, ভিনটেজ, নাসা, সেতারাসহ বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা তাদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কয়েকটি কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের কারখানা ছুটি ঘোষণা করেন।
যেসব কারখানায় অসন্তোষ বেশি:   
নাসা গ্রুপের পাঁচটি কারখানা, নিউ এইজ গার্মেন্টস লিমিটেডের চারটি কারখানা, অনন্ত গার্মেন্টসের দুটি কারখানা, ডেকো ডিজাইন ও ডেকো ওয়াস লিমিটেড, মেডলার গার্মেন্টস, নিট শিয়া লিমিটেড, ভিনটেস গার্মেন্টস, চিনশিন অ্যাপারেলস, বান্দ ডিজাইন, টেক ম্যাক্স গার্মেন্টস লিমিটেড, স্টারলিং স্টাইল লিমিটেড, স্টারলিং ক্রিয়েশন লিমিটেড, সেতারা গ্রুপ, মুন রেডি অয়ার, ইয়াগি বাংলাদেশ গার্মেন্টস লিমিটেড, এনভয় গ্রুপের তিনটি কারখানা,  হলিউড অ্যাপারেলস লিমিটেড, স্টারলিং অ্যাপারেলস লিমিটেড, ভার্চ্যুয়াল বটমস, সিএস লি টওয়ের লিমিটেড, ইসলাম গ্রুপের তিনটি কারখানা, শারমিন গ্রুপের ৪টি ফ্যাক্টরি, হামিম গ্রুপের ৫টি ফ্যাক্টরি ও শুশুকা নিটওয়্যার লিমিটেড, জেনারেশন নেক্সট লিমিটেড। এই কারখানাগুলোতে প্রায় ২ লাখ লোকের কর্মসংস্থান। এগুলো সবই  আশুলিয়ায় অবস্থিত। শিল্প পুলিশের একটি সূত্র জানায়, শ্রমিক অসন্তোষ শেষে গত সপ্তাহে এবং চলতি সপ্তাহের প্রথম দিন, অর্থাৎ শনিবার পর্যন্ত শিল্পাঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও রোববার সকাল থেকে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা তাদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন।
ডেকো গ্রুপের একজন কর্মকর্তা বলেন, আগে শ্রমিকদের যেসব দাবি ছিল, সেগুলো আমরা প্রথম দফাতেই মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন শ্রমিকরা নতুন দাবি নিয়ে এসেছেন, বিশেষ করে ২৫ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে বিক্ষোভ করছেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে তারা সিদ্ধান্ত চান। এর আগে সকালে শ্রমিকরা কারখানায় ঢুকেই বের হয়ে যান। এরপর গ্রাউন্ডে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। বেশ কয়েকজন স্টাফ-কর্মকর্তাকেও তারা অবরুদ্ধ করে রাখেন। তাদের একটি অংশ দাবি করছেন, এখনই তাদের ২৫ হাজার টাকা মজুরির দাবি মেনে নিতে হবে। আবার কেউ বলছেন, টিফিনের টাকা বাড়িয়ে যেটি ৪০ টাকা করা হয়েছে, সেটি এবার ৫০ টাকা করতে হবে। কেউ আবার হাজিরা বোনাস আরও বৃদ্ধি করতে বলছেন, যেটি ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হয়েছে ইতিমধ্যেই।
পুলিশ জানায়, কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা সকালে সড়ক অবরোধের চেষ্টা করলেও পুলিশ ও যৌথ বাহিনী তাদের বুঝিয়ে ফিরিয়ে দেয়। সূত্র জানায়, ডেকোসহ বেশ কয়েকটি কারখানার অভ্যন্তরে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সচেষ্ট ছিলেন।
শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম গণমাধ্যমকে বলেন, আগের দিন নাসায় সামান্য ঝামেলা হওয়ার পর নাসা বন্ধ ছিল। আজকে (রোববার) কিছু কারখানার শ্রমিকরা কোথা থেকে কী তথ্য পেয়ে বিক্ষোভ করছে, এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। মূলত ২৫ হাজার টাকা বিষয় না; তাদের দাবি মেনে নেয়া হলেও মালিক নিজে গিয়ে তাদের আশ্বস্ত করুক- এটা তারা চায়। আবার ভিনটেজের শ্রমিকদের দাবি, তাদের কারখানা খুলে দেয়া হোক। তাদের দাবি মেনে নেয়ার পরও এখন আবার নতুন দাবি সামনে আনছে। তিনি জানান, শিল্পাঞ্চলে রোববার বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৩(১) ধারায় ১৫টি এবং ৪টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ছিল।
এদিকে বিজিএমইএ বলছে, রোববার আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে মোট ২৭টি কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এরমধ্যে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৩(১) ধারার (নো ওয়ার্ক, নো পে) ভিত্তিতে ১৩টি এবং কারখানা খোলা রাখার পর কাজ বন্ধ আছে কিংবা স্ববেতনে ছুটি আছে এমন কারখানার সংখ্যা ১৪টি।
শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় বন্ধ থাকা কারখানাগুলোর মধ্যে ছিল- কমফিট কম্পোজিট লিমিটেড, নাসা সুপার কমপ্লেক্স লিমিটেড, সেতারা গ্রুপ, শিনশিন অ্যাপারেলস লিমিটেড, জেনারেশন নেক্সট, ভিনটেজ গার্মেন্টস লিমিটেড ও আঞ্জুমান ডিজাইনার্স লিমিটেড। এছাড়া স্ববেতনে ছুটি ছিল, কাজ বন্ধ আছে কিংবা শ্রমিকরা চলে গেছে এমন কারখানাগুলোর মধ্যে ছিল- এএম ডিজাইন লিমিটেড, ডেকো গ্রুপ, ব্যান্ডো ডিজাইন লিমিটেড, এনভয় গ্রুপ, অনন্ত গ্রুপ, নিউএইজ গ্রুপ, স্টারলিং ক্রিয়েশন, স্টারলিং অ্যাপারেলস, ইয়াগি বাংলাদেশ, দ্য রোজ গার্মেন্টস, টেক ম্যাক্সসহ মোট ১৪টি কারখানা।
বিজিএমইএ জানায়, আশুলিয়া অঞ্চলে রোববার তাদের ২৪৫টি কারখানা চালু ছিল। এ ছাড়া আগস্ট মাসের বেতন পরিশোধ করেছে ২৬৬টি কারখানা এবং আগস্ট মাসের বেতন এখনো দিতে পারেনি ৬টি কারখানা।
বিজিএমইএর তথ্যমতে, রোববার গাজীপুর এলাকায় তাদের কারখানা চালু ছিল ৮৭৬টি, বিপরীতে বন্ধ ছিল ৬টি কারখানা। সাভার আশুলিয়া এবং জিরানি এলাকায় চালু ছিল ৪০৭টি এবং বন্ধ ছিল ২৭টি কারখানা। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ এলাকায় ২০৯টি কারখানা, ডিএমপি এলাকায় ৩০২টি এবং চট্টগ্রামে ৩৫০টি কারখানা চালু ছিল।
এসব এলাকায় কোনো কারখানা বন্ধ ছিল না।
বিজিএমইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, শ্রমিকদের বিক্ষোভের প্রথম চার দিন কোনো দাবি-দাওয়ার কথাও আসেনি। এরপর একে একে শ্রমিকদের যে দাবি-দাওয়া আসতে থাকে এগুলো শ্রম আইনের কোনো জায়গায়ই নেই। তাদের কেউ বলে টিফিন বিল বাড়াতে হবে, কেউ বলে ছুটি দিতে হবে। কেউ বলে ৪ ঘণ্টার বেশি কাজ করবে না।
শ্রম সচিব সফিকুজ্জামান বলেন, দেশের পোশাক শিল্প সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশনের অপচেষ্টা করা হয়েছে। যাতে বৈদেশিক রপ্তানি সংকুচিত হয়। এ ছাড়া ভুল তথ্য ছড়িয়ে একটি মহল শিল্প এলাকায় অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতার পেছনে বিদেশি ইন্ধন রয়েছে। তবে সরকারের যথাযথ উদ্যোগে অসন্তোষ অনেকাংশে দূর হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.