আন্দোলনে নিহতের চাচা-চাচাতো ভাইরাও হত্যা মামলার আসামি

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীর মিরপুরে শহীদ হওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইকরামুল হক সাজিদ হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে চট্টগ্রামে গুলিতে শহীদ তানভীর ছিদ্দিকীর  চাচা ও চাচাতো ভাইদের। গত ৭ই সেপ্টেম্বর  নিহত ইকরামুল হক সাজিদের বাবা জিয়াউল হক বাদী হয়ে কাফরুল থানায় মামলা করেন। তবে মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তারা কেউ ঘটনার দিন ঢাকায় ছিলেন না। বরং তারা সবাই ওইদিন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও চকরিয়ায় ছাত্রদের সমর্থনে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া তারা সবাই বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ শিক্ষার্থী ইকরামুল হক ৪ঠা আগস্ট মিরপুর-১০ এলাকায় নিহত হন। তার বাবা জিয়াউল হক বাদী হয়ে কাফরুল থানায় হত্যা মামলা করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে প্রধান আসামি করে এ মামলায় মোট আসামি করা হয়েছে ৭৩ জনকে। এ ছাড়া অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও ১০০-১৫০ জনকে। এর মধ্যে ২৯নং আসামি জিয়াউর রহমান (৪৫), ৪১নং আসামি মো. কামাল (৪৩), ৫৪নং আসামি মিজানুর রহমান মাতব্বর (৫৫) এবং ৬২নং আসামি নাজমুল হোছাইন (৩৪) শহীদ তানভীরের আত্মীয়। অভিযোগ রয়েছে, শহীদ তানভীর ছিদ্দিকী হত্যা মামলার পলাতক আসামি ও কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তারেক বিন উসমান শরীফের ষড়যন্ত্রে ইকরামুল হত্যা মামলায় ঢোকানো হয়েছে তাদের নাম।

সূত্র মতে তানভীর ছিদ্দিকীর পরিবার ও আত্মীয়রা দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এমনকি এক আসামি রাজনৈতিক মামলায় ১২ বছর কারাবাস শেষে ঘটনার এক মাস আগে মুক্ত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তারা ঘরছাড়া হয়েছেন। বাড়ির প্রতিটি ইটও খুলে নিয়ে গেছে তারেক বাহিনী। শহীদ তানভীর ছিদ্দিকীর পরিবারের অভিযোগ, গত ১৫ বছর আগে তানভীর ছিদ্দিকী হত্যার আসামী তারেক বিন উসমান শরীফ ও নোমান শরীফের সন্ত্রাসী বাহিনী ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে শহীদ তানভীরের বাড়িসহ স্বজনদের শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে এলাকা ছাড়া করে। সর্বশেষ ইটের টুকরোটিও নিয়ে যায় তারা। পুরো একটি গ্রাম বিস্তীর্ণ মাঠে পরিণত হয়েছে। এ সময় দখল নেয় পুরো গোষ্ঠীর স্বজনদের কোটি কোটি টাকা মূল্যের ধানি জমি, লবণ চাষের জমি, চিংড়ি ঘের ও পুকুর। এতে নিঃস হয়ে পড়েন তারা।

এ ছাড়া টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্প, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর ও মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পে দুর্নীতি করে তারেক বিন উসমান শরীফ ও নোমান শরীফ শতকোটি টাকার মালিক বনে যায়। এসব অবৈধ টাকায় গড়ে তুলেছেন সশস্ত্র তারেক বাহিনী। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হলেও তার গড়ে তোলা এ বাহিনী কালারমার ছড়ার উত্তর পাশের বিভিন্ন পাহাড়ে অবস্থান করে। পরে গত ১১ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনী এসব পাহাড়ে অভিযান পরিচালনা করে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় তারেক বাহিনীর সন্ত্রাসীরা। যৌথবাহিনীর অভিযানের মুখে সন্ত্রাসী তারেক বিন উসমান ও নোমান শরীফ ঢাকায় পালিয়ে গেছে। তারা বলেন, ষড়যন্ত্র করে শহীদ সাজিদ হত্যা মামলায় ঢোকানো হয়েছে শহীদ তানভীর ছিদ্দিকীর আত্মীয়দের নাম। এর মধ্যে মো. কামাল (৪৩) তানভীরের চাচা। তিনি কালারমার ছড়া ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সদস্য। কিন্তু মামলার এজাহারে লেখা হয়েছে, তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাগর আহমেদ শামীমের এপিএস। এ ছাড়া জিয়াউর রহমান জিয়া, মিজানুর রহমান মাতাব্বর ও নাজমুল হোছাইন তানভীরের চাচাতো ভাই। জিয়া উপজেলা যুবদলের সাবেক ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক, কক্সবাজার জেলা যুবদলের সদস্য এবং কালারমার ছড়া ইউনিয়ন যুবদলের সহ-সভাপতি ছিলেন। এজাহারে তাকে জলদস্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মিজানুর রহমান মাতাব্বর ২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত কালারমার ছড়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। ছিলেন উপজেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতিও। আর নাজমুল হোছাইনও উপজেলা যুবদলের সাবেক ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ও বর্তমানে ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন তানভীরের ৫ আত্মীয়। ২০০৬ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর সকাল ১০টায় ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি উসমান গণিকে কুপিয়ে এক হাত বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করা হয়। বিচ্ছিন্ন হাত নিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে পুরো এলাকায় বিজয় উল্লাস করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। একইদিন ওই পরিবারের আরেক সদস্য ও ওয়ার্ড ছাত্রশিবিরের সভাপতি জয়নাল আবেদীন ধইন্নাকে হাত পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে বস্তায় ভরে পাশের কোহেলিয়া নদীতে ফেলে দেয়। তার লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরে ২০০৮ সালের ১৩ই জুন পরিবারের আরেক সদস্য জবল চৌধুরীকে কালারমার ছড়া বাজারে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি ইউনিয়ন বিএনপি’র সভাপতি এবং উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে মিজানুর রহমান নামে আরেকজনকে গুলি করে হত্যা করে তারেক বাহিনী।
শহীদ তানভীরের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় পরিবারের অনেক সদস্য পঙ্গুত্ববরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিভিন্ন সময়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে দেড় শতাধিক আত্মীয়-স্বজনকে। পরিবারের অনেক সদস্য ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত জেলহাজতে বন্দি ছিলেন। শহীদ তানভীর সিদ্দিকী পরিবারের সদস্য তারেক আজিজ সিদ্দিকী বলেন, স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর যখন আমরা আমাদের হারানো বসতভিটায় বাড়িঘর নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করি ঠিক তখনই এ রকম একটা হত্যা মামলায় আমাদের জড়ানো হয়েছে এমন খবর পেয়ে স্তব্ধ হয়ে পড়ি। এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে সঠিক তদন্ত ও নিরাপদ মানুষদের হয়রানি থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য আমরা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করেছি।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.