সীমান্তে হত্যা দিয়ে কী ভারত আন্তর্জাতিক আইন ভাঙছে না? by সুবাইল বিন আলম

আসুন একটা ঘটনা চিন্তা করি। সার্বিয়া বসনিয়াকে আক্রমণ করলো। কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে অনেক নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকেও মেরে ফেললো। কিছু লাশ চাপা দেয়ার চেষ্টাও করলো। অন্যের সীমান্তে এসে মানুষ ধরে নিয়ে গেল। মারা গেল অনেক শিশু।  খুব খারাপ লাগছে না? জ্বি, এগুলা যুদ্ধাপরাধ। যার শাস্তি এই বিশ্বেই হচ্ছে। আমাদের দেশ কি যুদ্ধাবস্থায় আছে?  নাই। কিন্তু এরকম ঘটনা কী হর হামেশা ঘটছে না? আমাদের সীমান্তে আসলে কী হচ্ছে? এর থেকে প্রতিকারের উপায় কি?

দ্যা ডিপ্লোমেটের একটা অপ-এডে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তকে ভয়ঙ্করতম সীমান্ত হিসেবে লেখা হয়েছিল। হবেই না কেন? যুদ্ধ ব্যতীত এত হত্যা আর অন্য কোনো দেশের সীমান্তেই হয় না।  মুহম্মদ আব্দুর রব উনার বাংলাদেশ, ভুগোল, বৈশ্বিক রাজনীতি এবং পরিবেশ বইয়ে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত ২০৬ জন সাধারণ মানুষকে সীমান্তে খুনের কথা বলেছেন। অধিকারের মতে ২০০০-২০২০ পর্যন্ত ১২৩৬ জন খুন হইয়েছে বিএসএফের হাতে। আহত হয়েছে ১১৪৫ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০২১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত মারা গেছে ৭০ জন। এই হিসাব শুধু পত্রিকাতে আসা হিসাব। বাস্তবে আরও বেশি।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে স্বর্ণা দাস (১৪) নামের এক কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে। ডেইলি মানবজমিনের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে আকুতি করে এই কিশোরী বলেছিল আমাকে মেরো না, আইনের আশ্রয় নাও। এই কথার পরও ওদের মন গলে নাই। আমাদের সনাতন ধর্মের মানুষেরা ভারতের উপর অনেক আস্থা রাখে। কিন্তু ভারতের গুলি থেকে তাদেরও রক্ষা নাই। এই ব্যাপারে তার পরিবারের সাক্ষী সবাই নিচ্ছে। কিন্তু ভারতের টাইমস অফ ইন্ডিয়া ৪ সেপ্টেম্বর তাদের রিপোর্টে দাবি করেছে বিজিবির গুলিতে স্বর্ণা মারা গেছে। ফেলানীর ঘটনা আমরা সবাই জানি, তার জন্য ভারতের আদালতে বিচার নামের প্রহসনে আমরা জানতে পারলাম কেউ তাকে মারে নাই। এমনি এমনি লাশটা কাটাতারে নিজেই ঝুলে ছিল। এভাবেই ভারতীয় প্রোপাগাণ্ডাতে আমরা হারিয়ে যাই।  এপ্রিলে ফেসবুকে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়। দেখা যায় লালমনিরহাটে বিএসএফ আমাদের সীমান্তের ভিতর ঢুকে ২ জন রাখালকে গুলি করছে, আর রাখালরা দৌড়ে পালাচ্ছে (যুগান্তর ৯ই এপ্রিল, ২০২৪)। ওরা নো ম্যানস ল্যান্ড পার হয়ে আমাদের এলাকায় কেন আসলো?  ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ইসহাক আলী খান পান্না ভারতে প্রবেশের সময় বিএসএফ’র গুলিতে নিহতের অভিযোগ আছে। (ইনকিলাব ২৫শে আগস্ট, ২০২৪) সারা জীবন ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্কও উনাকে এই গুলির হাত থেকে বাঁচাতে পারে নাই। যদিও বিএসএফ এখানেও অন্য গল্প বলছে।

ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় দু’টি প্রটোকল আছে-  জয়েন্ট ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ গাইডলাইনস ফর বর্ডার অথোরিটিজ অব দ্য টু কান্ট্রিজ, ১৯৭৫ ও দ্য ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ কো-অর্ডিনেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান, ২০১১। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত এ রকম দ্বিপক্ষীয় দু’টি প্রটোকল হলো-  জয়েন্ট ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ গাইডলাইনস ফর বর্ডার অথোরিটিজ অব দ্য টু কান্ট্রিজ, ১৯৭৫ ও দ্য ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ কো-অর্ডিনেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান, ২০১১। জয়েন্ট ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ গাইডলাইনস ফর বর্ডার অথোরিটিজ অব দ্য টু কান্ট্রিজ প্রটোকলের ধারা ৮ (আই) অনুসারে, এক দেশের নাগরিক যদি বেআইনিভাবে অন্য দেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করে বা কোনো অপরাধে লিপ্ত হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী আত্মরক্ষায় যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারবে, তবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করাটাই বাঞ্ছনীয়। আর্টিকেল ৮ (এম) অনুসারে, সীমান্ত দিয়ে যদি গরু পাচার করা হয়, তাহলে গরু ও গরু পাচারকারীদের সম্পর্কে তথ্য অপর পক্ষের সীমান্তরক্ষীদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে এবং নিকটস্থ থানার পুলিশের কাছে মামলা করে গরু উদ্ধারে পদক্ষেপ নিতে হবে। (প্রথম আলো, ৪ই সেপ্টেম্বর,২০২৪)।

এখন আমাদের কি আসলে কিছুই করার নাই? এই ক্ষেত্রে আসলে কয়েকটা উপায় আছে। প্রথমত হচ্ছে ডিপ্লোম্যাটিক উপায়। গতবছরের ২২শে জুন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী সীমান্তে হত্যা শূন্যতে নামিয়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে একমত হয়েছিল। ৫৪তম ভারত বাংলাদেশ বর্ডার সম্মেলনেও এই কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কাজের গরু কেতাবে আছে। মৃত্যুর মিছিল থামে নাই। আগের নতজানু পররাষ্ট্রনীতিও এর জন্য দায়ী। বাংলাদেশ কিন্তু ভারতের প্রায় সব দাবি মেনে নিয়েছিল যাতে এই মিছিল থামে। যেমন কাঁটাতারের বেড়া, যা পাকিস্তান বা চীনের সীমান্তে নাই, মোবাইল টাওয়ার সরিয়ে দেয়া। বাংলাদেশের সীমান্তে এই অধম ভারতের রোমিং দিয়ে মোবাইল ব্যবহার করে এসেছে, বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক না পেয়ে। তারমানে তারা কিন্তু সরায় নাই। এবার আর না পেরেই বাংলাদেশ সরকার খুব কড়া করে চিঠি দিয়েছে।

এরপর আসে নিজ নিজ দেশের আইন। ভারত বাংলাদেশ দুই দেশের আইনেই নিরস্ত্র মানুষদের মেরে ফেলার কোনো আইন নাই। আইন নাই চোরাচালানীদের বা বিনা বিচারে শাস্তি দেয়ারও। কিন্তু ভারত এই কাজ করেই যাচ্ছে আত্মরক্ষার দায়ে গুলি বলে অথবা স্বর্ণার কেসের মতো অস্বীকার করে শেষ উপায় তো ফেলানীর মতো কেস করা আছেই। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ‘ট্রিগার হ্যাপি: এক্সক্লুসিভ নিউজ অব ফোর্স বাই ইন্ডিয়ান ট্রুপস অ্যাট দ্য বাংলাদেশ বর্ডার’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, অপরাধী হিসেবে সীমান্ত হত্যার শিকার ব্যক্তিরা হয় নিরস্ত্র থাকে অথবা তাদের কাছে বড়জোর কাস্তে, লাঠি বা ছুরি থাকে। (৪ই সেপ্টেম্বর,২০২৪) উনাদের এই আষাড়ে গল্প ভারতের মানবাধিকার সংস্থাগুলোও খারিজ করে দেয়।  

সব শেষ উপায় আন্তর্জাতিক আইনে ব্যবস্থা খোঁজা। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এর রোম সংবিধির অনুচ্ছেদ ৭ এর অধীনে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে যখন কোনো বেসামরিক ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত ব্যাপক বা পদ্ধতিগত আক্রমণের অংশ হিসেবে, হত্যাসহ বেশকিছু অপরাধ। আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের বল প্রয়োগ এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের উপর জাতিসংঘের মৌলিক নীতি, ১৯৯০ ? নীতি ৯-এ পরিস্কারভাবে বলা আছে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাগণ কারও বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করবেন না, আত্মরক্ষা বা অন্যদের প্রতিরক্ষা, মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতের হুমকি, বিশেষ করে গুরুতর অপরাধ প্রতিরোধ, জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকির সঙ্গে জড়িত, এমন একটি বিপদ উপস্থিত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, অথবা তাদের পলায়ন প্রতিরোধ করতে এবং শুধুমাত্র যখন পর্যাপ্ত বিকল্প অনুপস্থিত। জেনেভা কনভেনশন এবং অতিরিক্ত প্রোটোকল ? জেনেভা কনভেনশন ৪, অনুচ্ছেদ ৩: অ-আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘাতের প্রেক্ষাপটে, জীবন এবং ব্যক্তির প্রতি সহিংসতা নিষিদ্ধ করে, বিশেষ করে সবধরনের হত্যা, অঙ্গচ্ছেদ, নিষ্ঠুর আচরণ এবং নির্যাতন, তাদের যারা সক্রিয় শত্রুতাকারী নয়। ভারতের এই হত্যার মধ্যে অনেক শিশুও আছে।  ভারত এইভাবে আন্তর্জাতিক আইনের অনেক ধারাই আমাদের সীমান্তে ভেঙেছে, যা অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধ বা মানবাধিকার লঙ্ঘন।  হয়তো কোনো উপায় না থাকলে আমাদের এই পথেই হাঁটতে হবে।
ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান বা চায়না বর্ডারেও বছরে গড়ে ৫/ ৬ জনের বেশি সাধারণ মানুষ মারা যায় না, যদিও প্রায়ই এদের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা থাকে। যদিও ওইখানে প্রায় যুদ্ধাবস্থা থাকে। আমরা চাই প্রতিবেশীর সঙ্গে সমমর্যাদাতে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক। আমাদের একজনও যেন আর সীমান্তে মারা না যায়, তাদেরও না। আর এটা  ভারত নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি সংশোধন করে এগিয়ে আসলেই শুধুমাত্র তা সম্ভব।

লেখক: টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক কলামিস্ট।

mzamin


No comments

Powered by Blogger.