সোনামসজিদ স্থলবন্দর: শতকোটি টাকা লোপাট শিমুল-পলাশ সিন্ডিকেটের

২০১৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসন থেকে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল। এমপি হয়েই শিমুলের চোখ পড়ে সোনামসজিদ স্থলবন্দরে। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে পাঁচ বছরে কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। স্থলবন্দরকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দেন শিমুলের ভাই সোহেল উদ্দিন আহমেদ পলাশ। দুই ভাইয়ের সিন্ডিকেট বন্দরে শত কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য করে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা অবৈধ কমিটি, শুল্ক না দিয়ে পণ্য ছাড় করিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এমন অভিযোগ করেছেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরেও চলছিল সিন্ডিকেটের অবৈধ কর্মকাণ্ড। ৫আ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রের সব খাতেই চলছে সংস্কার। এর বাইরে নেই সোনামসজিদ স্থলবন্দরও। সম্প্রতি সিন্ডিকেটের চাঁদাবাজির প্রতিবাদে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন করেন আমদানি-রপ্তানিকারকরা। পরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। ছয়দিন বন্ধ থাকার পর জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপে শনিবার থেকে শুরু হয়েছে আমদানি-রপ্তানি। ভেঙে গেছে এমপির সিন্ডিকেট। জানা গেছে, ২০১৮ সালের আগে মাসে অন্তত শত শত কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ হতো সোনামসজিদ স্থলবন্দরে। তবে এমপি হয়ে এ বন্দরটিতে নজর দেন শিমুল ও তার ভাই পলাশ। তারা শ্রমিক থেকে শুরু করে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সবগুলো কমিটিতে নিজেদের পছন্দমতো লোক বসিয়ে মেতে ওঠেন লুটপাটে। এমনকি স্থলবন্দর পরিচালনায় নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পানামা সোনামসজিদ পোর্ট লিংক লিমিটেডেও ভাগ বসায় দুই ভাইয়ের সিন্ডিকেট। পলাশ ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। অবৈধ উপায়ে উপার্জিত এসব টাকা তারা বিদেশে পাচার করেছেন এবং দেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ডের কারণে সোনামসজিদ বন্দরে স্থবিরতা বিরাজ করছে। আমদানি-রপ্তানিকারক সাঈদী হাসান ও আসাদুল হক বলেন, সাবেক এমপি শিমুল ও পলাশের নির্দেশেই এই বন্দরটিতে কোনো নির্বাচিত কমিটি দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেননি। তাদের কারণেই আজ অনেক ব্যবসায়ী দেউলিয়ার পথে। সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহলের দাবি জানান তারা।

যে প্রক্রিয়ায় রাজস্ব লুটপাট
শিমুল এমপি হওয়ার পর থেকে নজিরবিহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি চলেছে সোনামসজিদ স্থলবন্দরে। বন্দর পরিচালনার দায়িত্বে থাকা পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেড, শ্রমিক লীগ নামে সংগঠন, কাস্টমস ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের যোগসাজশে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ও ওজনে ছাড় দেয়ার ঘটনা অনেক বেড়ে যায়। ফলে আমদানি করা পণ্যের প্রতিটি ট্রাক থেকে সরকার তিন ভাগের মাত্র একভাগ রাজস্ব পায়।  নামসর্বস্ব কিছু শ্রমিক সংগঠনের নেতা রাজস্ব ফাঁকিতে সহায়তা করেন। বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, রাজস্ব ফাঁকি, ঘুষবাণিজ্য ও জালজালিয়াতির মাধ্যমে ব্যবসায়ী, কাস্টমস কর্মকর্তা ও বন্দর সংশ্লিষ্টরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
কাস্টমস-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অসাধু ব্যবসায়ীদের সুযোগ করে দিতেই প্রতি গাড়িতে প্রায় চার টন ফলের ওজন কম দেখিয়ে রাজস্ব কর্মকর্তারা গাড়িপ্রতি উৎকোচ নেন ৩০ হাজার টাকা করে। এতে প্রতি গাড়ি থেকে সরকার রাজস্ব হারায় প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। এত লোভনীয় আয়ের উৎস যাতে বন্ধ না হয়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট কাস্টমস কর্মকর্তারা প্রায় সময়ই এসব অসাধু আমদানিকারকের শুল্ক ফাঁকির প্রথা চালু রেখে স্বার্থরক্ষা করে চলেছেন। এ ছাড়া বাণিজ্যিক পণ্যের গাড়িতে আরও বেশি পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার জন্য ব্যবসায়ী ও রাজস্ব কর্মকর্তার সমন্বয়ে সোনামসজিদ শুল্ক স্টেশনে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। স্থানীয় সংসদ সদস্যের ভাই পলাশ এ সিন্ডিকেট পরিচালনার নেপথ্যে ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্দেশনা অনুযায়ী বন্দরে আমদানি পণ্য নিয়ে আসা ১০ চাকার ট্রাকে ১৮ টনের বেশি পণ্য বহন করা যাবে না। আর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা ১০ চাকার ট্রাকে ২১-২২ টন পণ্য নিয়ে আসে। অথচ রাজস্ব দেয় ১৭-১৮ টনের। ফলে প্রতি ট্রাকে তিন থেকে চার টন ফলের রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়। আর শুল্ক ফাঁকির মোট টাকার ৩ ভাগের একভাগ টাকা ভাগবাটোয়ারা হয় সিঅ্যান্ডএফ, পানামা, কাস্টমস আর প্রভাবশালী নেতাদের পকেটে। বাকি দুই ভাগ অর্থ যায় আমদানিকারকের পকেটে। এ ছাড়া উচ্চ ডিউটির পণ্য আনা হচ্ছে মিথ্যা ঘোষণায়। ফলের প্রতিটি ট্রাক থেকে ১০ হাজার টাকা করে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের বিরুদ্ধে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এসব কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছেন সংসদ সদস্যের ভাই সোহেল আহমেদ পলাশ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যথানের পর সিঙ্গাপুরে চলে যান সাবেক এমপি শিমুল ও তার ভাই পলাশ। মুঠোফোনে নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন সোহেল আহমেদ পলাশ। তিনি বলেন, আমি ৫ বছরে কোনোদিন পোর্টে গেছি বা কাউকে হুকুম করেছি এ রকম কোনো প্রমাণ নেই। এখন সময় খারাপ যাচ্ছে এজন্য অনেকেই অনেক কথা বলবে। তবে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাবেক এমপি শিমুলের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.