নেশার জালে শৈশব by শুভ্র দেব

একটান দুইটান দিতে দিতে একদম শইল্লের লগে মানাইয়া লইছি। অহন বিড়ি থেইক্যা গাঁঞ্জা ধরছি। আমরা হগল দোস্তরা এক লগে বইয়া খাই। এরপর যার যার কামে যাই। কথাগুলো একনাগাড়ে বলে গেল ১১ বছর বয়সের শিশু রাহেল মিয়া। বাবা আনোয়ার মিয়াকে চোখে দেখেনি।  বুঝে ওঠার আগেই মা আমেনা বেগমকে ছেড়ে আরেক বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছেন। রাহেলের আরো এক ভাই ও এক বোন আছে। সংসারের খরচ সামাল দিতে না পেরে তার মা আবার বিয়ে করেছেন। কিন্তু মায়ের বিয়ের পর সংসারের বড় ছেলে হিসেবে চাপ বাড়ে রাহেলের ওপর। তেজগাঁও স্টেশন ও তার আশপাশের এলাকায় সারা দিন টোকাইয়ের কাজ করে। যা আয় হয় সেটা তুলে দেন সৎ বাবার হাতে। রাহেল বলে, সারাদিন পরিশ্রম করে টাকা কামাই। কিন্তু সৎ বাবা-মা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। আমার সঙ্গে টোকাইয়ের কাজ করতো এক বন্ধু। সে অনেক আগে থেকে সিগারেট গাঁজাসহ আরো অনেক ধরনের নেশা করতো। আমাকে সে অনেক জোর করতো। আমি খেতে চাইতাম না। তারপর কিভাবে যে জড়িয়ে পড়ি নিজেই জানি না। তেজগাঁও রেললাইনে থাকি। এখানেই ঘুমাই। এখানে আমার মতো আরো অনেকে থাকে। তাদের সঙ্গে থেকেই আমি গাঁজা খাই। কাজ করে যা আয় হয় তার কিছু আমার ভাই বোনকে দিয়ে দেই। আর বাকি টাকায় নেশা করি। আমরা পাঁচজন বন্ধু একসঙ্গে নেশা করি। রাতের বেলা বেশি করি। রাতে রেললাইনে বসে ছোট বড় সবাই নেশা করে। কেউ বাবা, কেউ গাঁজা, কেউ হেরোইন, কেউ আবার ফেনসি খায়। আমার কাছে যখন বেশি টাকা থাকে তখন আমি অন্য নেশা করি। রেললাইনের পাশের কলোনিতে গেলেই এসব পাওয়া যায়। নাসরিন খালার কাছে টাকা দিলেই তিনি আমাকে দিয়ে দেন। প্রতিদিন আমি প্রায় ৪০-৫০ টাকার গাঁজা কিনে আনি।
রাহেলের বন্ধু আলম। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ। বাবা মার সঙ্গে তিন বছর আগে তেজগাঁও স্টেশনে আসে। বাবা রিকশা চালায়। আর মা নেশার উপকরণ বিক্রি করেন। সেখান থেকেই একটু একটু করে চুরি করে নিয়ে আসে। তার মা রমিলা বেগম টের পেয়ে অনেকদিন তাকে পিটিয়েছেন। কিন্তু নেশার টানে সে বাবা মার কাছ থেকে আলাদা। রেললাইনে তার রাত দিন কাটে। মন চাইলে কখনো কখনো কাওরানবাজার কাঁচাবাজারে এসে সবজি টুকিয়ে বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়েই নেশার টাকার ব্যবস্থা করে। মাঝে মধ্যেই সবাই মিলে তারা বাবা কিনে। বাবার দাম একটু বেশি। এটা বড়লোকের নেশা। আলম জানায় আশেপাশের ছোট-বড় সবাই নেশার জগতে থাকে। এজন্য আমি শিখেছি। তবে খাওয়ার পর অনেক ভালো লাগে। কোনো রকম দুঃখ কষ্ট থাকে না। আমিন নামের এক বড় ভাই সিরিঞ্জ দিয়ে আরেকটি নেশা শিখিয়েছে। হাতের মধ্যে সুই ঢুকানোর অনেক দাগ পড়ে আছে। একটা সময় আমার স্কুলে যেতে অনেক মন চাইতো। এখন আর ইচ্ছে করে না।
তেজগাঁও রেলস্টেশনের পাশেই কিছু অকেজো স্লিপারের স্তূপ রাখা আছে। সেখানে বসে একা একাই নেশা করছে আলী। আলীর মা-বাবা কেউ নেই। পাশের বাড়ির এক খালার সঙ্গে ছোট বেলায় ঢাকায় এসেছে। খালা মানুষের বাসায় কাজ করেন। আর সে যখন যে কাজ পায় সে কাজ করে। এখানে তার তেমন কোনো বন্ধু নেই। তেজগাঁও কলোনির  এক বড় ভাই বিভিন্ন ধরনের নেশা করে। তিনি প্রায় সময় টাকা দিয়ে তাকে গাঁজা আনতে পাঠাতেন। সেখান থেকেই অনেকটা আগ্রহসহকারে সে নেশা করা শুরু করে। আর এখন পুরোপুরি এই জগতে ডুবে আছেন। দুইবেলা ভাত না খেলে চলে কিন্তু প্রতিদিন নেশা না করলে মাথা নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য যেকোনো ভাবে নেশার টাকা ব্যবস্থা করতে হবে। আলী বলে, যখন আমার মতো অন্য কাউকে বাবা মায়ের সঙ্গে দেখি তখন আমার অনেক খারাপ লাগে। একা একা কাঁদতে থাকি। রাত হলেই এখানে অনেক মানুষ নেশা করার জন্য আসে। আমরা কখনো সবাই এক সঙ্গে বসে নেশা করি। এখানে আমার আপন বলতে কেউ নেই। রাতে পাশের অকেজো ট্রেনের বগির নিচে ঘুমিয়ে পড়ি। আর দিন হলেই বিভিন্ন জায়গায় কাজে চলে যাই। আবার এখানে ফিরে আসি।
শুধু রাহেল, আলম, আর আলী নয়, মাদকের স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাত রাজধানীর কাওরানবাজার থেকে তেজগাঁও রেল স্টেশনের রাস্তার দুই পাশে গড়ে উঠা কলোনিতে এরকম কয়েক ডজন শিশু, কিশোর নেশার জগতে ডুবে আছে।

No comments

Powered by Blogger.