কুমিল্লা নির্বাচন থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি?

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রতি কেবল কুমিল্লাবাসী নয়, সারা দেশের মানুষেরই প্রবল আগ্রহ ও কৌতূহল ছিল। তবে সেটি এ কারণে নয় যে নির্বাচনে প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যে কে বিজয়ী হন। সেই আগ্রহ ও কৌতূহলের মূলে ছিল নির্বাচনটি কেমন হয়। বিক্ষিপ্ত অঘটন ও প্রভাব বিস্তারের বিচ্ছিন্ন প্রয়াস থাকলেও নির্বাচনটি যে শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় পার করা গেছে, সেটি সবার জন্যই স্বস্তিদায়ক। এতে কোন দলের কোন প্রার্থী কত ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্বাচনটি পরাজিত হয়নি। হওয়ার সমূহ আশঙ্কা ছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেছিলেন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে তিনি কোনো চ্যালেঞ্জ মনে করেন না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি যেমন সরকার ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল, তেমনি নির্বাচন কমিশনের জন্যও ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। কমিশনের প্রথম পরীক্ষাও ছিল এটি। এতে জয়ী হতে না পারলে আগামী দিনগুলোতে তাদের পথচলা কঠিন হতো। এখনো যে খুব সহজ, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। আর সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল এটি প্রমাণ করা যে দলীয় সরকারের অধীনেও মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে সেখানে আওয়ামী লীগ যেই কৌশলই নিক না কেন, সরকার বা তার প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে বলেই নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কোনো ভয়ভীতি কিংবা প্রলোভনের কাছে নতিস্বীকার করেননি। তাই এ কথা বলা অন্যায় হবে না যে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হারলেও সরকার জিতেছে। বিরোধী দল বিএনপির জন্য পরীক্ষা ছিল, যে নির্বাচন কমিশনের গঠনকে তারা মেনে নিতেই চায়নি, সেই কমিশনের অধীনে নির্বাচনে যাবে কি যাবে না। এখানে দলীয় অবস্থান যতটা না তাদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সহায়তা করেছে, তার চেয়ে বেশি কার্যকর ছিল বিএনপির মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর ভূমিকা।
কুমিল্লার রাজনৈতিক মহলে এ কথাও চাউর হয়ে গিয়েছিল, দলীয়ভাবে বিএনপি নির্বাচন না করলে তিনি আগেরবারের মতো স্বতন্ত্র প্রার্থী হতেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক কৌতুক থাকে, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স কিংবা ইভিএম পদ্ধতি চালুর প্রতিবাদে বিএনপির নির্বাচন বর্জন ছিল তার একটি। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের দিনের বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা বাদ দিলে বলতে হয়, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো কমবেশি ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। সিটি নির্বাচন উপলক্ষে একাধিকবার কুমিল্লা সফরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পেছনের দরজা দিয়ে নয়, সম্মুখসমরেই জয়ী হতে চেয়েছে এবং সে ক্ষেত্রে উভয় দলেরই কিছু সুবিধা-অসুবিধা ছিল। বিএনপির বড় অসুবিধা ছিল তাদের ভাষায় ‘বৈরী’ রাজনৈতিক পরিবেশ। প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকা তাদের কাজকে সহজ করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ বেজার হবে বলে বিএনপির অভিযোগগুলো তারা উড়িয়ে দেয়নি। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। দু-একটি ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া বিএনপির নেতা-কর্মীরা অনেকটা নির্ভয়েই প্রচারকাজ চালিয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রধান অসুবিধা ছিল দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। শুরু থেকে সেটি কুমিল্লার রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচিত হলেও পুরোপুরি মেটানো যায়নি বলেই দলের পক্ষে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্যাহও স্বীকার করেছেন। দ্বিতীয় অসুবিধা ছিল তাঁদের প্রার্থীকে বিএনপি প্রার্থীর চেয়ে যোগ্যতর প্রমাণ করা। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা বিএনপির প্রার্থীর দুর্বলতাগুলো ভোটারদের সামনে তুলে না ধরে ক্ষমতাসীন দলের মেয়র হলে উন্নয়ন বেশি হবে—তত্ত্বটিই সামনে নিয়ে এসেছেন। তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগের প্রার্থী থেকে শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ‘নিষ্ঠুর’ আচরণের অভিযোগ আনলেও তার পক্ষে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত দিতে পারেননি। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোন দলের প্রার্থী জয়ী হলেন, কোন দলের প্রার্থী পরাজিত হলেন, জাতীয় রাজনীতির জটিল অঙ্কে সেটি বিচারের একমাত্র মাপকাঠি নয়।
এখানে দেখার বিষয় ছিল আমাদের ভঙ্গুর নির্বাচনব্যবস্থাটি যেন একেবারে ধ্বংস হয়ে না যায়। এই নির্বাচনের বড় অর্জন হলো নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার। সবাই মিলে চেষ্টা করলে আমরা আবার ধ্বংসপ্রায় নির্বাচনী ব্যবস্থাটি পুনরুদ্ধার করতে পারি। এ ব্যাপারে মুখ্য দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হলেও সরকার তথা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী—সবার দায় আছে। যে যার অবস্থান থেকে তারা সেটি পালন করেছে বলেই কুমিল্লাবাসী একটি মোটামুটি উতরে যাওয়া নির্বাচন পেয়েছে। অনেকে বলতে চান, ক্ষমতাবদল হয় না বলে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে সম্ভব হলেও জাতীয় নির্বাচন সম্ভব নয়। সদিচ্ছা থাকলে সব নির্বাচনই সব সরকারের আমলে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করা সম্ভব। আবার সদিচ্ছা না থাকলে কোনো নির্বাচনই যে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করা সম্ভব নয়, নিকট অতীতে অনুষ্ঠিত ইউপি, পৌরসভা ও উপজেলা নির্বাচনই তার প্রমাণ। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, হবিগঞ্জের একটি উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের শূন্য হওয়া আসনে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। আবার খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া আসনে জাতীয় পার্টির ও আওয়ামী লীগের জয়ী হওয়ার উদাহরণ আছে। কুমিল্লার নির্বাচন আমাদের সামনের দিকে তাকানোর একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। কুমিল্লায় নির্বাচনী প্রচারে দায়িত্ব পালনকারী বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, কুমিল্লার নির্বাচন প্রমাণ করেছে, ‘আমরাও পারি।’ তিনি দলীয় প্রার্থীর জয়ের কথা বলেননি। বলেছেন সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার কথা। অন্যদিকে সেখানে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারে ছিলেন, অপর এক নেত্রী বলেছেন, এই নির্বাচন প্রমাণ করেছে, শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব। তাঁর দাবি, দেশে সুশাসন ও উন্নয়ন আছে বলেই আওয়ামী লীগ মাগুরা করেনি। গণতন্ত্রের একমাত্র না হলেও প্রধান শর্ত সুষ্ঠু নির্বাচন। যে জাতি মুক্তিযুদ্ধ করে একটি দেশ স্বাধীন করতে পারে, সেই জাতি কেন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না? এই চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনের জন্য যত বড়, তার চেয়ে বেশি সরকারের জন্য।
২. কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি হয়েছে বৃহস্পতিবার। বুধবার রাত আটটায় কমলাপুরে রয়েল পরিবহনের কাউন্টারের ব্যবস্থাপকের কাছে কুমিল্লার একটি টিকিট চাইলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ভোট দিতে যাচ্ছেন? বললাম, ভোট দিতে নয়, দেখতে যাচ্ছি। ভোটের দিন তিন ধরনের মানুষ নির্বাচনী এলাকায় যায়। ভোটদাতা, ভোটগ্রহীতা ও ভোটের আয়োজনকারী। আমি এর কোনোটার মধ্যেই পড়ি না। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেন, আমি অন্য গ্রহের লোক কি না। কিছুক্ষণ পর স্বগতোক্তির মতো করে বললেন, ‘কী দেখবেন, ফলাফল তো আগেই ঠিক হয়ে আছে।’ সত্যি ফলাফল ঠিক হয়ে আছে? তাহলে এই যে ঢাকা-কুমিল্লাগামী বাসে-ট্রেনে শত শত লোক যাচ্ছেন, তঁাদের কষ্টটা কি একেবারে মূল্যহীন? ২০ মিনিট পরপর রয়েলের বাস ছাড়ে। প্রতিটি বাসই যাত্রীবোঝাই এবং তাঁদের বেশির ভাগ যাচ্ছেন ভোট দিতে। বাসে কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে আলাপ হলো। একজন টেলিফোনে নির্বাচনী পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। ওপাশ থেকে কী বলা হয়েছে জানি না। কিন্তু এপাশ থেকে ভদ্রলোক বললেন, ‘মিডিয়াকে ব্যস্ত রাখতেই এটি করা হয়েছে।’ বুঝলাম, সিটি করপোরেশন এলাকার ভেতরে কোটবাড়ী এলাকায় জঙ্গি সন্দেহে একটি বাড়ি পুলিশের ঘিরে রাখার কথাই বলছেন ভদ্রলোক। দুপুর থেকেই টেলিভিশন ও পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে খবরটি প্রচার করা হচ্ছিল। অন্যদিকে সিলেটের আতিয়া মহলে সফল অভিযানের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মৌলভীবাজারের দুটি বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে। সেখানে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে সাত জঙ্গির দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। মৌলভীবাজারের ঘটনা নিয়ে কারও মনে সন্দেহ না থাকলেও ভোটের আগের দিন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকায় জঙ্গি আস্তানা আবিষ্কার নিয়ে আরও অনেকের মতো বাসের সহযাত্রী ভদ্রলোকও প্রশ্ন তুলেছেন। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ভোট গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চালানো যাবে না। দুদিকেই বিপদ।
অভিযান চালালে ভোটে তার প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। জনমনে ভীতির সঞ্চার হতে পারে। আবার অভিযান না চালালে জঙ্গিরা যেকোনো অঘটন ঘটাতে পারে। ভোটের দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, পুলিশ এলাকাটি ঘিরে রাখলেও কোনো অঘটন ঘটেনি। বাস ছাড়ার আগেই পরিবহনের কর্মীরা জানিয়েছিলেন, ভোটের কারণে বাস শহরের ভেতরে না-ও যেতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশ্বরোডে আটকে দিতে পারে। কিন্তু তারা বাধা দিল না। স্বাভাবিক অবস্থায় সব বাস যেমন টমসন ব্রিজে গিয়ে থামে, আমাদের বাসটিও সেখানে যাত্রীদের নামিয়ে দিল। ভোটের কারণে সবকিছু সুনসান। দু-একটি ইজিবাইক ও রিকশা চলাচল করছে। রাস্তার দুই পাশে টানানো সাদা-কালো পোস্টারই জানান দিচ্ছে, বৃহস্পতিবার ভোট। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ টহল দিচ্ছে; প্রার্থীর সমর্থকেরা সারা দিনের ব্যস্ততা শেষে ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। কয়েক দিন আগে কুমিল্লা এসে দলীয় নেতা-কর্মীদের আনাগোনায় যেমন সরগরম ছিল, বুধবার রাতে তেমনটি ছিল না। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে দুই দিন আগেই প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেছে। বহিরাগত ব্যক্তিরাও কুমিল্লা ছেড়ে চলে গেছেন। তবে সিটি করপোরেশনের যাঁরা ভোটার, তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন একটি সুন্দর ভোটের জন্য, একটি সুন্দর নির্বাচনের জন্য। রয়েল পরিবহনের ব্যবস্থাপকের শঙ্কা মিথ্যা প্রমাণ করে কুমিল্লায় একটি ভালো নির্বাচনই হয়েছে। সেখানে ফলাফল আগে থেকে ঠিক করে রাখা হয়নি।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.