আওয়ামী লীগের জন্য বড় বার্তা

কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন (কুসিক) নির্বাচন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জন্য ‘বড় বার্তা’ বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও দলীয় প্রতীকে হওয়ায় জাতীয়ভাবে দু’দলের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মাপকাঠি হিসেবেই বিবেচিত হবে। স্থানীয় নানা সমীকরণ থাকলেও জয়-পরাজয়ে সরকারবিরোধী নেগেটিভ ভোট মূল ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। সাধারণ ভোটাররা সরকারকে একটা বার্তা দিয়েছেন। যাকে আরও সহজ করে বললে বলতে হবে, সাধারণ জনগণ পরিবর্তন দেখতে চান। অন্যদিকে বিএনপির জন্যও এ নির্বাচনে অনেক কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে। ভালো প্রার্থী মনোনয়ন দেয়াসহ ভোট গণনা পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে শক্তভাবে টিকে থাকলে ভবিষ্যতে এমন ফল বয়ে আনবে। কেননা বিএনপির নিজস্ব ভোট ছাড়াও বাড়তি বোনাস হিসেবে স্বাভাবিকভাবে যুক্ত হচ্ছে সরকারবিরোধী বিপুলসংখ্যক নেগেটিভ ভোট। এটি আসলে বিএনপির ভোট নয়। নানা কারণে সাধারণ ভোটারদের একটি বড় অংশ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ থাকলে তারা ভোটের সময় এভাবে সরকারবিরোধী বিকল্প প্রার্থী খুঁজে নেয়। অতীতেও এমন নজির দেখা গেছে। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী ফলাফলকে এভাবে বিশ্লেষণ করে কয়েকজন বিশ্লেষক মনে করেন, এখানে জয়-পরাজয়ে আরও যেসব বিষয় কাজ করেছে তা হচ্ছে দলীয় কোন্দলসহ স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ইস্যু। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিনের কোন্দল নিরসনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে নির্বাচনী ফলাফলে।
অপরদিকে কোন্দল মিটিয়ে অনেকটাই ঐক্যবদ্ধ ছিল বিএনপি। প্রকাশ্যে দলটির তৎপরতা তেমনটা না থাকলেও ঐক্যবদ্ধ থাকার কারণে নীরব ভোটবিপ্লব হয়েছে। যে কারণে কিছু কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ছিনতাই, বোমাবাজি ও জাল ভোট দিলেও শেষ রক্ষা হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, এ নির্বাচনটি সরকারের জন্য আরও ভাবনার খোরাক জোগাতে পারে। যেমন- টানা আট বছর ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিচারের বড় পরিসর সমাপ্ত করেছে। নানা বিতর্ক থাকলেও দেশে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নও হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু তারপরও আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক বাড়ছে না কেন? বিপরীতে বিএনপির ভোটব্যাংক না কমে বরং সরকারবিরোধী নেগেটিভ ভোট তাদের বাক্সে পড়ছে। জাতীয় নির্বাচনের দেড় বছর বাকি থাকতে এ বিষয়গুলো নতুন করে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বিশেষ করে একটি বিষয় লক্ষণীয় হতে পারে, ভবিষ্যতে দলীয় প্রতীকের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে এবং সেখানে যদি এমন ফলাফল দেখা যায় তাহলে সরকারি দল আওয়ামী লীগের জন্য তা হবে বড় ধরনের রাজনৈতিক দুঃসংবাদ। জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কুসিক নির্বাচন মোটামুটি ভালোই হয়েছে। নির্বাচন কমিশন আর একটু সচেষ্ট হলে আরও ভালো হতে পারত। তিনি বলেন, এ নির্বাচনে দুই দলের জন্যই বার্তা রয়েছে। ক্ষমতাসীন দল এত প্রচার-প্রচেষ্টার পরও কেন সেখানে জিততে পারল না, তা ভাবতে হবে। তার মতে, সরকারবিরোধী নেগেটিভ ভোট ছাড়াও আরও বেশ কিছু বিষয় জয়-পরাজয়ে ভূমিকা রেখেছে। এক বছর পার হলেও কুমিল্লায় তনু হত্যার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় তেমন ইতিবাচক কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় সেখানকার মানুষ বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা ক্ষোভ ছিল।
তিনি মনে করেন, ভোটাররা কী চায়, তা তাদের বুঝতে হবে। অন্যদিকে বিএনপির জন্যও এ নির্বাচনে সচেতন হওয়ার মতো কিছু বার্তা রয়েছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। তার গুণাবলি বা নির্বাচন পরিচালনার কৌশল কী ছিল, তা কেন্দ্রের ভেবে দেখা উচিত। টিআইবির প্রধান নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, অতীতে যে ধরনের নির্বাচন হয়েছে সে তুলনায় কুসিকে ভালোই হয়েছে। এ নির্বাচনে ভোটাররা দলগুলোকে কিছু বার্তা দিয়েছে। সেটি হলো, তারা যখন সুযোগ পায় তখন নিজেদের পছন্দের প্রতিফলন ঘটায়। কুসিকে তা-ই দেখিয়েছে। এটি সরকারের জন্য একটি বিশেষ বার্তা। ভবিষ্যতে তাদের নির্বাচন পরিকল্পনায় এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। তিনি বলেন, কুসিক নির্বাচনে সরকারবিরোধী নেগেটিভ ভোটই মূল ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। সেখানে বিএনপির ভোট নির্ধারিত ছিল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারবিরোধী ভোট। দুটির যোগফল ধানের শীষের পক্ষে গেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বড় দুটি দলের সারা দেশে নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটব্যাংক রয়েছে। ভোটের হিসাবে তাদের মধ্যে ব্যবধান খুবই সামান্য। এ দুটি দলের মোট ভোটারের মধ্যে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ নির্ধিারিত ভোট। জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলেরও কিছু ভোটব্যাংক রয়েছে। এলাকা ভেদে বাকি প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ হচ্ছে সাধারণ ভোটার। কেউ কেউ বলে থাকেন, এটি ফ্লোয়েটিং ভোট। এ ভোটই যে কোনো নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে মূল ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে এবং ভবিষ্যতেও করবে। তারা মনে করেন, এসব ভোটারকে কাছে টানার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বিএনপি। কারণ অতীত প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে দেখা গেছে, নানা কারণে সাধারণ মানুষ রুলিং পার্টি বা সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ থাকে। তাদের নানা কর্মকাণ্ডে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে না পেরে ভোটের জন্য অপেক্ষায় থাকে। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, যখন যে দল সরকারে থাকে তখন এমনই চিত্র দেখা যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হাফিজউদ্দিন খান যুগান্তরকে বলেন, এ নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে নানা ফ্যাক্টর কাজ করলেও সরকারবিরোধী নেগেটিভ ভোট বিএনপির বাক্সে গিয়েছে। তিনি বলেন, সরকার যথেষ্ট উন্নয়নমূলক কাজ করলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা কারণে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রয়েছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেখলাম, একদিনে ১২ জন নিখোঁজ। অনেকে গুম হচ্ছে। বিষয়টিকে সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখছে না। তাই যখন সুযোগ পাচ্ছে তখন তাদের পছন্দ-অপছন্দের সিদ্ধান্ত এভাবে জানিয়ে দিচ্ছে।
স্থানীয় বিশ্লেষণ : কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার পরাজয়ের নেপথ্যে দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ পাঁচ কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ ও সাধারণ ভোটাররা। এ কারণে সরকারে থেকে প্রশাসনিক আনুকূল্য পাওয়ার পরও সরকারি দলের প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে। অপরদিকে রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে থাকা বিএনপির প্রার্থী মো. মনিরুল হক সাক্কু জয়ের ফসল ঘরে তুলেছেন। নির্বাচনী এ ফলের নেপথ্যের বাকি চার কারণ হচ্ছে- বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ঘুচিয়ে আনা, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও ভুল কৌশল, মেয়র সাক্কুর জনপ্রিয়তা, সীমার পারিবারের সদস্যদের বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ড এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী ভোট। এদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের নেপথ্যে একজন মন্ত্রী ও এক সংসদ সদস্যের ভূমিকা নিয়েও এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। ওই সংসদ সদস্যের সঙ্গে বিএনপি প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর দীর্ঘদিনের সখ্যের বিষয়টি চাউর রয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীরা যুগান্তরকে জানান, ভোট কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের একক প্রভাব ছিল। কিন্তু অনেকেই নৌকা প্রতীকের ব্যাজ ও ভোটার স্লিপ নিয়ে ভোট কেন্দ্রে গেলেও ভোট দিয়েছেন ধানের শীষে। এসব কারণে ধানের শীষ প্রতীকের নীরব জয় ঘটেছে। সরেজমিন দেখা গেছে, নির্বাচনে পরাজয়ের পর শুক্রবার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তেমন কোনো তৎপরতা ছিল না।
শহরে এক ধরনের সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। নগরীর রামঘাটলায় অবস্থিত আওয়ামী লীগের দক্ষিণ জেলা কার্যালয়ে লোকজনের আনাগোনা তেমন দেখা যায়নি। ভোটের দিন ওই কার্যালয় খোলা থাকলেও শুক্রবার তা বন্ধ ছিল। পক্ষান্তরে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে উৎফুল্ল ভাব দেখা গেছে। ভিক্টোরিয়া কলেজ রোডে বিএনপির মহানগর কার্যালয়ের সামনে দলটির নেতাকর্মীরা জড়ো হয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় এবং পক্ষান্তরে বিএনপি প্রার্থীর জয়ের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ জানতে চাওয়া হলে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি বদরুল হুদা জেনু যুগান্তরকে বলেন, এ নির্বাচনকে ঘিরে বাহ্যিকভাবে আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ মনে হলেও ভেতরে ভেতরে গ্রুপিং কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির অনুসারীদের কার্যক্রম ছিল রহস্যজনক। অপরদিকে বিরোধী দলে থাকা বিএনপি সাংগঠনিকভাবে এখানে অনেকটা ঐক্যবদ্ধ ছিল। তিনি বলেন, মনিরুল হক সাক্কু কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলায় সাধারণ ভোটারদের খুব সহজে কাছে টানতে পেরেছেন। এছাড়া মেয়র হিসেবে তিনি দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন কাজও করেছেন।
মুরাদপুর, নুরপুর, শাহাপাড়া, হাউজিং এস্টেটসহ বেশ কিছু এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করেছেন। ওই সব এলাকায় আগে বৃষ্টিতে ৭-৮ ঘণ্টা জলাবদ্ধতা থাকলেও এখন তা কমে ২-৩ ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। এতে ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে সাক্কুর গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৬টি ভোটের মধ্যে ১ লাখ ২৭ হাজার ৮৬০টি ভোট পড়েছে। মো. মনিরুল হক সাক্কু ৬৮ হাজার ৯৪৮ ভোট পেয়ে পুনরায় মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। অপরদিকে আঞ্জুম সুলতানা সীমা পেয়েছেন ৫৭ হাজার ৮৬৩ ভোট। ঘোষিত ফলাফলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে ১১ হাজার ৮৫ ভোট বেশি পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী। ফল বিশ্লেষণ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ফল ঘোষিত একশ’ ১টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩৪টিতে মো. মনিরুল হক সাক্কুর প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা বেশি ভোট পেয়েছেন। বাকি ৬৭টি ভোট কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের চেয়ে বিএনপির ধানের শীষে ভোট বেশি পড়েছে। আরও দেখা গেছে, কুমিল্লা শহর এলাকায় ১৮টি ওয়ার্ডে ৭২টি ভোট কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি ভোট কেন্দ্রে সাক্কুর তুলনায় বেশি ভোট পেয়েছেন সীমা। অর্থাৎ ৪৭টি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের পরাজয় হয়েছে। এসব কেন্দ্রে বিএনপি ধানের শীষ প্রতীকে বেশি ভোট পেয়েছেন। এ ৭২টি কেন্দ্র শহরের যেসব এলাকায় নিয়ে অবস্থিত সেখানের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আফজল খানের সঙ্গে কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বিরোধ রয়েছে। নির্বাচনে এর প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন সীমা শিবির। তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোথাও তার প্রকাশ্য প্রচারণা ছিল না।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার যুগান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে আফজল খানের পরিবারের সদস্যরা হেরে গেলেই আমাকে দোষ দেয়া হয়। গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সীমার বাবা আফজল খান ২৮ হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। তখনও আমাকে দোষারোপ করা হয়। এবার আমার এলাকায় সীমা ৪ হাজার ভোট কম পেয়েছেন। এটারও দোষ কি আমাকে নিতে হবে?’ তিনি বলেন, ‘১৯৮৪ সালে পৌরসভা মেয়র পদে আমি ও আফজল খান নির্বাচন করে জয়ী হয়েছি। ১৯৮৯ সালে পৌর নির্বাচনে আফজল খান আমার বিরোধিতা করেছিল। আমি বারবার জয়ী হওয়ায় তা ভুলে যাই। কিন্তু পরাজয়ের গ্লানি বেশি দিন থাকে। আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে তা মিথ্যা। আপার (শেখ হাসিনা) নির্দেশে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে জয়ী করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।’ সাক্কুর সঙ্গে সখ্য ও গোপনে তাকে সহযোগিতা করার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এটি সর্বৈব মিথ্যা অভিযোগ।’ অপরদিকে আওয়ামী ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত সদর দক্ষিণ মডেল থানায় ৩১টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ২৯টির ফল প্রকাশ করা হয়েছে। বাকি দুটিতে নির্বাচনী অনিয়মের কারণে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। এ ২৯টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ২০টিতেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে, জয় হয়েছে বিএনপি প্রার্থীর। বাকি ৯টিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয় পেলেও এগুলোতে বিএনপি প্রার্থীর থেকে ভোটের ব্যবধান সামান্য। এ ৯টি ওয়ার্ড কুমিল্লা-১০ আসনের অন্তর্ভুক্ত। এ আসনের সংসদ সদস্য পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল), যিনি কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি। সীমা শিবিরের অভিযোগ, এ নির্বাচনে তার ভূমিকাও রহস্যজনক। তার আশ্বাসে সীমা ওই এলাকায় খুব একটা প্রচারণা চালাননি। এমনকি ভোটের দিনও সেই এলাকায় যাননি আঞ্জুম সুলতানা সীমা।
আরও জানা গেছে, সদর দক্ষিণ মডেল থানা এলাকায় আওয়ামী লীগ একচেটিয়া ভোট পাবে এমনটাই প্রত্যাশা ছিল দলটির। তাই এ এলাকায় সুষ্ঠু ভোট গ্রহণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল বিএনপি। যদিও ফলাফলে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। সদর দক্ষিণ এলাকার ৯ ওয়ার্ডে আঞ্জুম সুলতানা সীমা ৫ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে পিছিয়ে ছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছি। কোনো একটি মহল আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করছে। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘নির্বাচনের কয়েকদিন আগে কেন আমার থানার ওসি বদল করা হল, ভোটের আগের দিন কেন ১৯টি কেন্দ্রের পুলিশ ইনচার্জ বদল করা হল, কেন প্রশাসনের লোকেরা পিটিয়ে ভোটারদের কেন্দ্র থেকে দূরে সরিয়ে দিল? তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের এমন অবস্থার কারণে আমার লোকেরা নৌকা ব্যাজ ছাড়াই ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়েছেন।’ স্থানীয় সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আফজল খানের ছেলে ও সীমার ভাই মাসুদ পারভেজ খান ইমরান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ওই নির্বাচনের পর উভয় পরিবারের পুরনো বিরোধ আরও প্রকাশ্যে রূপ নেয়। এদিকে আফজল খান প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা মহানগরীর নজরুল এভিনিউ এলাকায় অবস্থিত কুমিল্লা মডার্ন স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন নিয়েও আফজল বাহারের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নেয়। সর্বশেষ ২৫ মার্চ ওই স্কুলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আফজল খানপন্থী কেউ নির্বাচনে অংশ না নিলেও এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত আরফানুল হক রিফাত সভাপতি পদে নির্বাচিত করা হয়। সিটি কর্পোরেশন ভোটের আগে ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের এ নির্বাচন কর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় সম্পর্কে দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচন সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব একেএম এনামুল হক শামীম বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ সংকট ছিল। নিরপেক্ষতার নামে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে রুঢ় আচরণ করেছে। এক প্রশ্নের উত্তরে শামীম বলেন, শুরু থেকেই আমরা দলের কোন্দল নিরসনের চেষ্টা চালিয়েছি, কিছুটা হয়তো সফলও হয়েছিলাম, না হলে তো নৌকা এত ভালো করত না, কিন্তু এরপরও পরিকল্পনামন্ত্রী ও সদর আসনের এমপির এলাকায় নৌকা কেন এত কম ভোট পেল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক কাজী জাফর উল্লাহ ও আমি সদস্য সচিব হিসেবে ২৮ দিন মাঠে ছিলাম। কিন্তু জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটরা অকারণেই মাঠে যেখানে নৌকার লোক দেখেছে তাদের হয়রানি করেছে।’ তিনি দাবি করেন, ‘সরকারি দলের নেতা হিসেবে আমরা আচরণবিধি মেনে মাঠে কাজ করেছি।
কিন্তু নৌকার বিরুদ্ধে যারা কাজ করেছে, বেইমানি করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘দলের সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। আমি চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বে আছি, দল ঠিক করতে, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যা যা করার দরকার সবই করব।’ এদিকে ভোটের পরদিন শুক্রবার নিজ ফেসবুক পেজে আঞ্জুম আরা সুলতানা একটি পোস্ট করেন। এতে তিনি বলেন, ‘আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। বঙ্গবন্ধুর কন্যা আমাকে মনোনীত করেন। নৌকা প্রতীক আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন। কুমিল্লার সর্বস্তরের জনগণ আমার পাশেই ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য- আওয়ামী লীগের কিছু ব্যক্তি বিশেষের ষড়যন্ত্রের জন্য আমি শেখ হাসিনার কাছে লজ্জিত। আমি আপনাদের সীমা। আপনাদের মাঝেই থাকব। আমার জন্য দোয়া করবেন।’ আরও জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার স্বচ্ছ ইমেজ থাকলেও তার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। সংখ্যালঘু শংকর হত্যাকাণ্ড, শহর ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুল হত্যাকাণ্ড, দেবিদ্বার পৌর যুবলীগ নেতা জালালউদ্দিন টিটু হত্যাকাণ্ডসহ বেশ কয়েকটি মামলার আসামি আফজল খান পরিবারের সদস্যরা। এটিও নির্বাচনে সীমার পরাজয়ের অন্যতম ফ্যাক্টর বলে মনে করেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি বদরুল হুদা জেনু যুগান্তরকে বলেন, সীমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন নেই। তবে তার পরিবারের সদস্যদের কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ধারণা রয়েছে। সেটিও নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে। অপরদিকে সাক্কুর বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ, ওয়ান-ইলেভেনে পালিয়ে থাকাসহ নানা বিষয় ছিল। কিন্তু তা প্রচার করতে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ।

No comments

Powered by Blogger.