এ বই বাঙালির ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ

আমরা আজকে এখানে সমবেত হয়েছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখিত কারাগারে তার যে স্মৃতিকথা, যে বইটি আমরা বের করলাম সম্প্রতি, সেটাকে কেন্দ্র করেই। এটি তার দ্বিতীয় বই, এর আগে আমরা বের করেছি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। কারাগারের এ বইটি আপনারা যদি নিজেরা দেখেন, এখানে তার বেশ কয়েকটা লেখা- অনেকগুলো খাতা। তার মধ্যে একটি খাতা যেটা বহু বছর পর খুঁজে পাওয়া গেছে, আমার একটি লেখায় আমি সেগুলো তুলে ধরেছি। তারপরও আমি আপনাদের একটু দেখাতে চাই যে, আপনারা দেখতে পারেন, এ খাতাটা প্রথম এই যে পাতাটা রয়েছে এখানে দেখুন, সম্পূর্ণ পুরনো একটা খাতার মলাট। আর এ মলাটের ওপর একটা কথা লেখা আছে, আসলে এ বইটা ছিল বাজেয়াপ্ত। জেলখানায় এ খাতাটা বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং সেই তথ্যটা পেয়েছিলাম এসবির রিপোর্ট থেকে। ’৯৬ সালে যখন সরকার গঠন করি তখন এসবির রিপোর্টগুলো নিয়ে এসে সেগুলো ফটোকপি করে রেখে দিই এবং সেখান থেকে জাতির পিতার জীবনের অনেক তথ্য জানতে পারি।
সেখানেই জানতে পারলাম, দু’খানা খাতা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তো দ্বিতীয়বার যখন সরকারে এলাম তখন আমি এসবিকে বললাম, এখানে এসবির যিনি বসে আছেন তাকে, দায়িত্ব দিয়ে বলেছিলাম, এ খাতাটা আমাকে খুঁজে বের করে দিতে হবে এবং ওখানকার কর্মকর্তারা সবাই কষ্ট করেছে এবং ২০১৪ সালে এসে সেই খাতাটা আমি পেলাম, যে খাতাটায় বঙ্গবন্ধু নিজেই কিন্তু নাম দিয়ে গেছেন। তিনি এ খাতায় লিখেছিলেন, ‘থালাবাটি কম্বল জেলখানার সম্বল’; কিন্তু খাতাটা যে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল সেখানে মলাটের ওপর লেখা ছিল, ‘ঈৎরঃরপরংস ড়ভ ঔধরষ অফসরহরংঃৎধঃরড়হ’ এবং সেই কারণে এটাকে বাজেয়াপ্ত করা হয়। তো এত বছর পরে এই খাতাটা পাওয়া যায়। আর বাকি যে খাতাগুলো, আমার লেখার মধ্যে আমি লিখেছি কীভাবে এগুলো আমরা পেয়েছি। আমার মায়ের কথা বারবার মনে পড়ে। কারণ আমার মা সব সময় যখনই বাবা গ্রেফতার হতেন তিনি লেখার জন্য খাতা দিতেন এবং পড়ার যে বইগুলো দিতেন সেগুলো আবার তিনি সব সময় সংগ্রহ ও সংরক্ষিত করতেন এবং বারবার উৎসাহ দিতেন লেখার জন্য। আর এ খাতাগুলো অত্যন্ত সযত্নে রেখে দিতেন। কাজেই সেই খাতাগুলো ফিরে পাওয়া একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। কারণ ’৭১ সালে খাতাগুলো উদ্ধার করি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই বাড়ি সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলে ছিল এবং কীভাবে উদ্ধার করেছি আমার ভূমিকায় আমি তা লিখেছি, আর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। আবার ’৭৫ সালে বাবা, মা, ভাই, বোন সবই হারিয়েছি। ওই বাড়িতে এমন একজন কেউ ছিল না যে কেউ কিছু বলতে পারে। আর আমরা দুই বোন ছিলাম বিদেশে। দীর্ঘ ছয় বছর পর ফিরে আসি। প্রথমে তো আমাকে ওই বাড়িতে ঢুকতেই দেয়া হয়নি। তারপর যখন আমি যেতে পারি তখন অন্য কোনোকিছুই না, প্রথম এলে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। এরপর যখন আমার একটু হুঁশ হল, আমার শুধু মনে হচ্ছিল মায়ের হাতে রাখা ওই খাতাগুলো কীভাবে উদ্ধার করা যায় এবং আমি কিন্তু ওই বাড়ি থেকে ওই সময় শুধু ওই খাতা কয়টাই নিয়ে এসেছিলাম, আর কিছু নেয়ার মতো ছিলও না, মনও ছিল না। কারণ চারদিকে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ, সেই অবস্থার মধ্যে আমাকে দেখতে হয়েছে ধুলাবালি মাখা সব জালের মধ্য দিয়ে, তখন এ খাতাগুলো নিয়ে আসি।
এখানে আরেকটি খাতা আপনারা দেখবেন ১৯৬৮ সালের, ওটা হচ্ছে তার শেষ লেখা। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৮ জানুয়ারি তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং এরপরই আগরতলা মামলা হয়। ৫ মাস পর তিনি এ খাতাটা পান। কারণ মামলা শুরু হওয়ার পর খাতাটা তার হাতে দেয়া হয়েছিল। তো সেখানে খুব অল্পই লেখা আছে। কিন্তু ওই খাতাটা নিয়েই আমার একটা স্মৃতি রয়ে গেছে, সেটুকুই শুধু আপনাদের কাছে আমি আজকে বলতে চাই। জানুয়ারি মাসের পর থেকে আমরা জানতাম না তিনি কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন, বেঁচে আছেন কিনা- কিছুই জানতে পারিনি। কোনো খবর আমরা জানতাম না; কিন্তু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। যখন মামলা শুরু হল, সেই কোর্টও ছিল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। তখনই প্রথম তার সঙ্গে দেখা হল। এরপর আমরা মাঝে মাঝে সাক্ষাৎকারের অনুমতি পেতাম। তাকে অফিসার মেসে রাখা হতো। সেই জায়গাটা এখন একটা মিউজিয়ামের মতো করে রাখা হয়েছে। আমাদের সেনাবাহিনী ওটাকে মিউজিয়াম হিসেবে রেখেছে। অনেকে ইচ্ছে করলে যেতে পারেন। এটা হল শুধু একটা খাট, আর বাকি দুটো চেয়ার। আমি যখন যেতাম, তো একদিন খাটে বসে হঠাৎ দেখি বালিশের নিচে একটা খাতা। তো আমার কী মনে হল, আমি আস্তে খাতাটা বের করে পড়তে শুরু করলাম। আমি যখন পড়তে শুরু করলাম তখন আব্বা আর মা পাশাপাশি চেয়ারে বসা, আব্বা এ জিনিসটা লক্ষ্য করলেন। তিনি উঠে এলেন। আস্তে আমাকে জড়িয়ে ধরে কোনো বকাও দিলেন না, কিচ্ছু বললেন না, শুধু হাত থেকে খাতাটা নিয়ে নিলেন। নিয়ে শুধু এটুকুই বললেন, এখন পড়বি না, আমার মৃত্যুর পরে পড়বি। আমার হাত থেকে তিনি খাতাটা নিয়ে রেখে দিলেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর যখন এ খাতাগুলো হাতে পেলাম, সত্যি কথা বলতে কী,
এগুলো পড়া আমার জন্য খুব কষ্টের ছিল। আমার বান্ধবী ছিল বেবী, ও সব সময় আমার পাশে থাকত, সাহায্য করত; কিন্তু খাতাগুলো যখন পড়ব, কেন যেন কিছুতেই সেই সাহসই পেতাম না। আর বারবার বাবার সেই কথাটা মনে পড়ত। যাই হোক, আমরা এগুলো বই আকারে বের করতে পেরেছি এবং আজকে সবার হাতে তুলে দিতে পেরেছি। হয়তো ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে যদি থাকতাম, আমরা দুই বোনও বেঁচে থাকতাম না। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ। একজন মানুষ তার জীবনে সংগ্রাম করে দুটি দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। প্রথমটা হল পাকিস্তান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে আপনারা দেখবেন সেই পাকিস্তান অর্জনের পেছনে তার কত অবদান রয়েছে। আর যখন তিনি উপলব্ধি করলেন, এ পাকিস্তানের অধীনে বাংলাদেশের মানুষ শোষিত-বঞ্চিত, বাংলাদেশের মানুষের কোনো অধিকার নেই; বাংলাদেশের মানুষের টিকে থাকা সম্ভব নয়; তখন তিনি বাঙালির মুক্তির জন্য সংগ্রাম করলেন। আমরা আমাদের জীবনে একটানা দুই বছরও বাবাকে কাছে পাইনি। তবে আমার মা অত্যন্ত সাহসী ছিলেন আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তার ছিল বিরাট অবদান। তিনি নিজের ব্যক্তিগত জীবনে কিছুই চাননি; কিন্তু সব সময় বাবার কাজে সহযোগিতা করেছেন এবং আমাদেরও সেভাবে গড়ে তুলেছেন। আপনারা এ বইয়ের একটি জায়গায় দেখবেন তিনি লিখেছেন (এটি আলাদা একটা খাতায় আমরা পেয়েছিলাম)- আমি একটু পড়ছি : ‘৮ ফেব্রুয়ারি দু’বছরের ছেলেটা এসে বলল, আব্বা বালি চল।
কী উত্তর ওকে আমি দেব। ওকে ভুলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, তোমার মার বাড়ি তুমি যাও, আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কি বুঝতে চায়? কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ, আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে; কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শেখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’ ছোটবেলায় আব্বার সঙ্গে দেখা তো জেলখানায়ই হতো। যখন জামাল ছোট, এরপর রেহানা, তারপর রাসেল, আমি আর কামাল একটু বড় ছিলাম। আমরা জানতাম যে, আমার বাবা দেশের মানুষের জন্য কাজ করে। তাই, আমাদের কোনো আবদার কোনোকিছু বাবার কাছে ছিল না বরং যতটুকু সময় তিনি বাইরে থাকতেন- স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে এমনভাবে আমাদের ভরিয়ে দিতেন যে, আমরা না পাওয়ার বেদনাটা ভুলে যেতাম। এত আদর, এত ভালোবাসা কোনো সন্তান পায় তা আমরা জানি না। যা হোক, আমার জীবনের এটুকুই সার্থকতা যে, এত ঝড়-ঝঞ্ঝা, এত কিছুর পরও তার লেখাগুলোকে আমরা খুঁজে পেয়েছি এবং বাংলাদেশের মানুষকে তিনি ভালোবেসেছেন। তার জীবনের সবকিছু বাংলাদেশের মানুষকে ঘিরে। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, এ দেশের মানুষকে তিনি সব থেকে বেশি ভালোবাসেন। ডেভিড ফ্রস্ট যখন জিজ্ঞেস করেছেন, আপনার কোয়ালিফিকেশন কী? তিনি বলেছেন, আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসা। যখন জিজ্ঞেস করেছেন, ডিসকোয়ালিফিকেশন কী? বললেন, দেশের মানুষকে আমি অতিরিক্ত বেশি ভালোবাসি। তাই, ভালোবাসা মানুষের প্রতীক। কারণ বাংলার মানুষকে একটা সুন্দর জীবন তিনি দিতে চেয়েছিলেন।
আর সেই বাংলার মানুষকে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, একটা রাষ্ট্র দিয়ে গেছেন, আত্মপরিচয়ের সুযোগ দিয়ে গেছেন; কিন্তু মানুষকে মানুষের মতো বাঁচার সুযোগ করে দেয়ার জন্য যখনই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তখনই তাকে আর সময় দেয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ- যে দেশটা ছিল একটা প্রদেশ। ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা যে দেশটি শাসিত। এরপর পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা শাসিত সেই দেশের শাসনভার পেয়ে ’৭২ সালে অল্প সময়ের মধ্যে একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলা- এটা এত সহজ কাজ ছিল না; কিন্তু এখন আমার মাঝে মাঝে এটাই দুঃখ হয় যে, তখন তো কেউ সময় দেয়নি। অনেকেরই কত সমালোচনা- এটা হল না, ওটা হল না। ধৈর্য নেই, নানা ধরনের কথা, কত কিছু মনে হল যেন সেই সময় মানে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে করতে সেই স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি তাদের হাতকেই যেন শক্তিশালী করে দিল। আর এখনও আমার মাঝে মাঝে এটাই মনে হয় যে, এই যে তার বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা, নানা কথা লেখার মধ্য দিয়ে তার জীবনটাকে কেড়ে নেয়ার পথটা অর্থাৎ ১৫ আগস্টের ঘটনা ঘটানোর একটা যেন পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল অনেকেই। পরবর্তীকালে হয়তো তারা উপলব্ধি করতে পারছেন কী তারা হারিয়েছিলেন। আর এই বই পড়ার মধ্য দিয়ে- ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’- এ দুটি বই পড়ার মধ্য দিয়ে অন্তত বুঝতে পারবেন, একটি মানুষ একটি দেশকে ভালোবেসে দেশের মানুষের জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন। জীবনের কোনোকিছু কোনো চাওয়া-পাওয়া রাখেননি। শুধু এ দেশের মানুষকে তিনি কিছু দিয়ে যেতে চেয়েছেন। রাষ্ট্র দিয়ে গেছেন, আত্মপরিচয়ের সুযোগ দিয়ে গেছেন, ঠিকানা দিয়ে গেছেন। সব সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা আবৃত্তি করতেন, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ উদাত্ত কণ্ঠে এই কথা, এই উচ্চারণ করতেন সব সময়। আজকে সেটাই তার জীবনে বাস্তব হল। নিঃশেষে প্রাণটা দিয়ে গেলেন; কিন্তু তাকে যারা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল তারা তা পারল না। তিনি সেই ইতিহাসে আবারও ফিরে এসেছেন এবং এ বাংলার মাটিতে আবার ফিরে এসেছেন তার বাংলাদেশে, তার সোনার বাংলাদেশে। আর আমাদের, আমার একটাই কাজ, বাংলাদেশকে তার সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলা। সেটুকুই শুধু করে যেতে চাই, যতটুকু পারি। তার দুঃখী মানুষের মুখে যেন হাসি ফুটিয়ে যেতে পারি। যখনই একটু কাজ করি, যখন কোনো ভালো কাজ হয় তখন কেবল এটুকু মনে হয় যে, আমার আব্বা আজ বেঁচে নেই, তিনি থাকলে বহু আগেই তো বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ সত্যি উন্নত জীবন পেত; কিন্তু আজকে তিনি বেঁচে নাই। যদি একটু ভালো কাজ করি, নিশ্চয়ই তার আত্মা তো শান্তি পাবে।
তিনি নিশ্চয়ই দেখেন, নিশ্চয়ই জানেন, তিনি নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করতে পারেন। কাজেই, আজকে আমি এটুকুই বলব যে, এই লেখার মধ্য দিয়ে অনেক কিছু জানতে পারবেন। তবে, এখানেই শেষ না, তার লেখা আরও আছে। সেগুলোও আমরা ধীরে ধীরে প্রকাশ করব এবং সেগুলোও মোটামুটি প্রস্তুত এবং যেহেতু ২০২০ সালে জন্মশতবার্ষিকী, এই জন্মশতবার্ষিকীর মধ্যেই এ লেখাগুলো সব আমরা প্রকাশ করব। সেই সঙ্গে এসবির যে রিপোর্ট- বহু নেতার বিরুদ্ধে এসবির রিপোর্ট আছে- কিন্তু আপনারা অবাক হবেন যে, একজন মানুষ তার বিরুদ্ধে প্রায় ৪৮ খানার মতো ফাইল যেখানে ৩০-৪০ হাজার পাতা তার বিরুদ্ধেই লিখেছে। কিন্তু সেই বিরুদ্ধে লেখার মধ্য দিয়েই একদিকে যেমন তার জীবনীটা পাওয়া যায়, অপরদিকে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের অনেক কথা এখানে জানা যায়। সেটাও আমরা তৈরি করেছি, সেটারও কাজ চলছে এবং আমরা এগুলো ডিক্লাসিফাইড করে দিয়েছি। আগে এটাকে আমরা ছাপাব, বের করব একটা ডকুমেন্ট হিসেবে। তবে অফিসিয়াল অনেক লেখা আমরা বাদ দিচ্ছি। কিন্তু মূল কথাগুলো, মূল জিনিসগুলো যাতে থাকে এবং কীভাবে তিনি কাজ করেছেন, কীভাবে রাজনৈতিক দলটা গড়ে তুলেছেন, কীভাবে সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন- সবকিছু সেখানে সুন্দরভাবে লেখা আছে। সেটাও আমরা প্রকাশ করতে চাচ্ছি। খুব শিগগিরই প্রকাশ করব। সেই সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা- এই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তার বিরুদ্ধে একশ’টা অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেখান থেকে দুটি অভিযোগ দিয়ে মামলা করা হয়। তার সব ডকুমেন্ট আমরা তৈরি করে ফেলেছি। সেগুলোও আমরা প্রকাশ করব। এটা বাংলাদেশের ইতিহাস যারা জানতে চাইবে, তারা হয়তো এ ডকুমেন্টগুলো পড়লেই জানতে পারবে। আর কীভাবে তিনি একটা দেশকে স্বাধীন করেছেন, এখানে সেই ছয় দফা দিয়ে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া, আট দফা কী ছিল সেটা তার এ লেখার ভেতরে আছে। তাছাড়া অনেক তথ্য আপনারা এ লেখাগুলোর মধ্য থেকে পেতে পারবেন। আপনারা এ বইটা পড়লে দেখবেন তিনি অন্তত দুটি জায়গায় উল্লেখ করেছেন- একটা হচ্ছে, ’৬৬ সালের তার খাতায় লেখা যেখানে তিনি ’৬৬ সালের ২৪ জুলাই একবার লিখেছেন,
‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’
আবার ’৬৭ সালে সেই ২৩-২৭ এপ্রিল তার যে লেখা খাতাটা, সেই খাতাটায়ও আবার একই কথার পুনরাবৃত্তি আছে,
‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’ কাজেই, যে আত্মবিশ্বাস ও ভালোবাসা, যে দায়িত্ব নিয়ে তিনি এ দেশকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন কিন্তু দুর্ভাগ্য এখানে যে, তিনি দেশটাকে গড়ে দিয়ে যেতে পারলেন না। হয়তো একটু সময় পেলে পরে এ দেশটা বহু আগেই একটা উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ হতে পারত। বিশ্বের বুকে একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে দাঁড়াতে পারত। কিন্তু তিনি তো নিজের জীবনকে কষ্টের জীবন হিসেবেই বেছে নিয়েছেন। কষ্টের জীবন বেছে নিয়েছিলেন এ দেশের মানুষের মুক্তির জন্য, আর সেই মুক্তি তিনি দিয়ে গেছেন। এখন এটা রক্ষা করার দায়িত্ব এ দেশের মানুষের সবার। মানুষের শান্তি, মানুষের নিরাপত্তা, মানুষের উন্নতি, অর্থনৈতিক মুক্তি- সব কাজ আজকে সবাই মিলেই করতে হবে। আজকে যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে কোনো কাজ করতে যাই, তখন দেখি প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সবই তো করে দিয়ে গেছেন। এ দেশের প্রতিটি, একটা স্বাধীন দেশের উপযুক্ত সব প্রতিষ্ঠান গড়ে দিয়ে গেছেন। আইনগুলো করে দিয়ে গেছেন। শুধু বাস্তবায়ন করা, একে একে সেটা আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি আমাদের সাধ্যমতো। রেহানা আসতে পারেনি। আপনারা জানেন, কয়েকদিন আগেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যেসব জঙ্গি হামলা বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হল, রেহানার মেয়ে টিউলিপ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মেম্বার, সে ওখানে আটকা ছিল। তার ছোট্ট শিশুকন্যাটা সেও ওখানে ছিল। রেহানা ওই খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পরদিন সকালেই রওনা হয়ে চলে গেছে। এ অনুষ্ঠানটায় ওর থাকার কথা ছিল। আমি আসার আগে ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলে এসেছি। কারণ ও আমার পাশে থাকুক সেটাই সব সময় চেয়েছি। আমার এ কাজে যারা সাহায্য করেছিলেন সব সময়, একে একে সবাইকেই হারিয়ে ফেলেছি। ড. এনায়েত রহিম সাহেব জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ছিলেন। মূলত তাকে নিয়েই প্রথমে কাজটা শুরু করি। তিনি মারা গেলেন। বেবী আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বন্ধু, সব সময় ও আমার পাশে পাশে থাকত, আমরা দু’জন এক সঙ্গে মনের আনন্দে কাজ করতাম, সেও ছেড়ে চলে গেল। প্রফেসর সামসুল হুদা হারুন সাহেব, তিনি এনায়েত রহিম সাহেবের মৃত্যুর পর ট্রান্সলেশনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে আমাকে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইমার্জেন্সিতে গ্রেফতার করল, কারাগারে বসে শুনলাম তিনিও আর নেই, তিনিও চলে গেছেন। এভাবে একে একে সবাইকে হারালাম। শুধু শামসুজ্জামান সাহেব, জামান ভাই শুরু থেকে আমাদের সঙ্গে আছেন। সেই ২০০২ সালের পর থেকে তিনি সব সময় সাহায্য করেছেন, উপদেশ দিয়েছেন। আর সেই সঙ্গে আমাদের, এমনকি শাকিল মাঝখানে সেও সাহায্য করত, ও আপনারা জানেন সে মৃত্যুবরণ করেছে। এভাবে একে একে সবাইকে হারিয়ে মাঝে মাঝে মনে হয় যেন এভাবে সবাইকে কেন হারাচ্ছি জানি না। যা হোক, অবশেষে বইটা আমরা বের করতে পেরেছি। আর আপনাদের হাতে দিতে পেরেছি, জনগণের হাতে দিতে পেরেছি। কারণ জাতির পিতা তো আমার একার পিতা শুধু নয়। তিনি তো বাংলাদেশেরই, বাংলাদেশের জনগণের। তাই তার সবকিছু আমরা জনগণকে বিলিয়ে দিয়েছি। ওই বাড়ি থেকে শুরু করে সবকিছু জনগণকে ফিরিয়ে দিয়েছি।
এখন শুধু একটাই কাজ, দেশটাকে যদি সেভাবে গড়ে তুলে দিয়ে যেতে পারি সেটাই বড় কথা। কাজেই আমি আশা করি, এ বইয়ের মধ্য দিয়ে আপনারা আরও ভালোভাবে জানতে পারবেন, এ দেশকে জানতে পারবেন, মানুষগুলোকে জানতে পারবেন এবং আরেকটা কাজ আমি করেছি, এখানে অনেকের কথা তিনি লিখেছেন। কত ভালো ভালো কথা লিখেছেন; কিন্তু এর মধ্যে অনেকেই তো পরে বেইমানি করে চলে গেছেন। কিন্তু তিনি যার সম্পর্কে যেভাবে যত ভালো কথা লিখেছেন, আমি কিন্তু কোনো কথা বাদ দেইনি। একটি কথাও কাটিনি, ঠিক সেইভাবেই আছে এবং অনেকে হয়তো বেঁচে নেই, অনেকে বেঁচে আছেন। জানি না তারা এখন পড়লে নিজেরাই লজ্জা পাবেন কিনা। কিন্তু আমরা তিনি যাকে যেভাবে দেখেছেন, যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন, যেভাবে ভালো কথা লিখেছেন, সব ঠিক হুবহু ওইভাবে রেখে দিয়েছি। কারণ সব মানুষের সত্য কথাটা জানা উচিত। আর এত সাহস আমার নেই যে, আমরা তার লেখায় হাত দেব। কাজেই যেভাবে লিখেছেন সেইভাবে আমরা রাখার চেষ্টা করেছি। আমরা আশা করি, সবাই এ বইটি পড়বেন এবং এর মধ্য দিয়ে আপনারা কারও সমালোচনা করতে হলে করবেন, কারও কিছু বলার থাকলে বলবেন। আজকের দিনে বারবার আমার বাবা-মায়ের কথা মনে হচ্ছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে সেটুকুই চাই যে, ১৫ আগস্টে তাদের হারিয়েছি, আল্লাহ তাদের বেহেশত নসিব করুন। আর বাংলাদেশ তিনি দিয়ে গেছেন, বাংলাদেশ থাকবে, উন্নত হবে, সমৃদ্ধশালী হবে, তার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ ইনশাআল্লাহ আমরা গড়ে তুলব। গত ২৮ মার্চ ‘কারাগারের রোজনামচা’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত ভাষণ

No comments

Powered by Blogger.