বড়হাটে দিনভর মুহুর্মুহু গুলি বিস্ফোরণ

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানায় ‘অপারেশন হিট ব্যাক’ শেষ হওয়ার পর একই উপজেলার বড়হাটে অপর আস্তানায় ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’ শুরু করেছে সোয়াত। শুক্রবার সকাল ৯টা ৫২ মিনিট থেকে এ অভিযান শুরু হয়। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে অভিযানটি স্থগিত করা হয়। এর আগে দিনভর আস্তানার ভেতর থেকে মুহুর্মুহু গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। এ সময় এক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা, বড়হাটের এ আস্তানায় ৪-৫ জন প্রশিক্ষিত জঙ্গি রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন আফগান ফেরত বোমা বিশেষজ্ঞ। তবে তার পুরো পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সোয়াতের অপারেশন চলাকালে ওই আস্তানায় ক্যামেরাসংবলিত ড্রোন দিয়ে সার্চ করা হয়েছে। ড্রোন দিয়ে তোলা ছবিগুলো পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এর আগে সিলেটের শিববাড়ীর আতিয়া মহলে এবং নাসিরপুরের আস্তানায় অভিযান চালানোর সময়ও ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম আস্তানার কাছে সাংবাদিকদের জানান, অন্ধকার থাকায় অভিযান স্থগিত করা হয়েছে। আজ সকালে আবহাওয়া ভালো থাকলে পুনরায় অভিযান শুরু হবে।
আস্তানায় প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা এখান থেকে শুনেছেন ভেতরে বিস্ফোরণ হয়েছে। বেশকিছু বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে জঙ্গিরা। সোয়াতের টিম যখনই প্রবেশ করার চেষ্টা করেছে তখনই তারা বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। তাদের কাছে প্রচুর পরিমাণে বিস্ফোরক রয়েছে বলে ধারণা করছি।’ এ অপারেশনটি একটু জটিল জানিয়ে তিনি বলেন, জঙ্গিরা যে বাড়িতে অবস্থান নিয়েছে সেই বাড়িটিতে অনেক কামরা রয়েছে। আরও একটি নির্মাণাধীন ভবন রয়েছে। এ কারণে একটু সময় লাগছে। ভেতরে কতজন রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একাধিক ব্যক্তির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সিটিটিসির একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ধারণা করছি ভেতরে একজন বোমা বিশেষজ্ঞ আফগান ফেরত জঙ্গি রয়েছে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জঙ্গি আস্তানায় তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। তার চেহারা দেখতে বিদেশীদের মতো। সে নব্য জেএমবির একজন শীর্ষ নেতা বলেও ধারণা করা হচ্ছে। তবে এখনও এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, ওই আফগান ফেরত জঙ্গি সীতাকুণ্ডের আস্তানায় বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকতে পারে। তবে এসব বিষয়ে নিশ্চিত করে বলতে আরও একটু সময় লাগবে। ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জঙ্গিরা আত্মঘাতী হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, এখনও বোঝা যাচ্ছে না। সকাল থেকে মুহুর্মুহু গুলি : বড়হাটের জঙ্গি আস্তানায় সকাল থেকে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শোনা গেছে। কখনও কখনও বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে জঙ্গি আস্তানার আশপাশে অবস্থান নেয় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) বিশেষায়িত টিম সোয়াত। এর প্রায় দুই ঘণ্টা পর ৯টা ৫২ মিনিট থেকে গুলির শব্দ শোনা যায়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলে গোলাগুলি। এরপর থেমে থেমে কিছুক্ষণ গুলির শব্দ পাওয়া যায়। সকাল সোয়া ১০টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন সদস্যকে ইলেকট্রিক করাত, রশি, দা, কুড়াল নিয়ে জঙ্গি আস্তানার দিকে যেতে দেখা গেছে। দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে।
এর ২৫ মিনিট পর ১২টা ৩৫ মিনিটে আবারও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। এর ৫ মিনিট পর দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে আবারও মুহুর্মুহু গুলির শব্দ পাওয়া যায়। গোলাগুলি চলাকালীন দুপুর ১২টা ৫২ মিনিটে আবার দুটি বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। এরপর দুপুর সোয়া ১টার দিকে গোলাগুলি বন্ধ হয়। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আবারও গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেছে। গোলাগুলি শুরুর ২ মিনিট পর বিকট শব্দে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। এরপর বিকাল ৫টা ৫ মিনিটে আবারও বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। পরে সন্ধ্যা পৌনে ৬টার পর আবারও গোলাগুলি শুরু হয়। বড়হাটের বাসিন্দারা জানান, বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে তারা জঙ্গি আস্তানার কাছ থেকে বিকট শব্দে বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। তারপর তারা থেমে থেমে গুলির শব্দ শুনেছেন। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যেও গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। পুলিশ বলছে, বড়হাট এলাকার আবুশাহ দাখিল মাদ্রাসা গলির দোতলা একটি বাড়িতে জঙ্গি আস্তানাটির অবস্থান। মঙ্গলবার রাত থেকে জঙ্গি আস্তানাটি শনাক্ত করে ঘিরে রাখে পুলিশ। বুধবার ওই আস্তানা থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়া হয়। ওই জঙ্গি আস্তানা থেকে ১০০ গজ দূরে দোতলা একটি বাড়ির মালিক মুক্তিযোদ্ধা শেখ আনসার আলী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, তারা খুবই আতংকের মধ্যে আছেন। ৩ দিন ধরে ওই আস্তানা থেকে তারা গোলাগুলি এবং বিস্ফোরণের শব্দ পাচ্ছেন। তিনি বলেন, ওই বাড়ির একজন ভাড়াটিয়ার সঙ্গে ২০ দিন আগে তার কথা হয়েছে। তবে তার নাম তিনি জানেন না। এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখে ওই ব্যক্তির পরিচয় জানতে চান তিনি। তখন প্রাণ-আরএফএল কোম্পানিতে চাকরি করেন বলে জানিয়েছিলেন ওই ব্যক্তি। তার বয়স ৪০ বছর হবে। জটিল হওয়ায় অভিযানের নাম ম্যাক্সিমাস : সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম। অভিযান চলাকালে জঙ্গি আস্তানার বাইরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বড়হাট এলাকায় জঙ্গি আস্তানার অবস্থা বেশ জটিল। বাড়ির ভেতর একাধিক কামরায় চার থেকে পাঁচ জঙ্গি রয়েছে। তার মধ্যে একজন বোম্ব এক্সপার্ট রয়েছে বলেও আমাদের ধারণা। ঘেরাওর সময় থেকেই একাধিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তারা। গুলিও করেছে। অভিযানের নাম ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’ কেন জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, সার্বিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে এবং জটিলতার ব্যাপকতা বোঝাতে এ নাম রাখা হয়েছে। আস্তানার জানালার গ্লাস মজবুত : বড়হাটের জঙ্গি আস্তানার গ্লাসগুলো মজবুত বলে জানান সিসিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সোয়াতের ছোড়া গুলিতে কাচ ভাঙছে না। পুলিশ সদস্য আহত : দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে জঙ্গি আস্তানায় জোড়া বিস্ফোরণের ঘটনার ৩ মিনিট পর এক পুলিশ সদস্যকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যেতে দেখা যায়। তখন তার গলা দিয়ে রক্ত ঝরছিল। তিনি কনস্টেবল কয়সর উদ্দিন। তাকে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। এ বিষয়ে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রওশন উজ জামান যুগান্তরকে বলেন, জঙ্গি আস্তানার ভেতরে বিকট শব্দে জোড়া বিস্ফোরণের পর জানালার ভাঙা কাচ কয়সরের শরীরে লাগে। এতে তিনি সামান্য আহত হন। তিনি শংকামুক্ত। জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে মঙ্গলবার রাত থেকে মৌলভীবাজার পৌরসভার বড়হাট এলাকায় একটি বাড়ি এবং শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে খলিলপুর ইউনিয়নের সরকার বাজার এলাকার নাসিরপুর গ্রামে আরও একটি বাড়ি ঘিরে রাখে পুলিশ ও সিটিটিসি। পরে সিসিটির সোয়াত টিম বুধবার বিকাল থেকে নাসিরপুরের আস্তানায় অভিযান শুরু করে। অভিযানের নাম দেয়া হয় অপারেশন হিট ব্যাক। বৃহস্পতিবার বিকালে এ অভিযান শেষ হয়। এতে জঙ্গি আস্তানায় এক পুরুষ, দুই নারী এবং চার শিশু মারা যায়। পুলিশ বলছে, অভিযান শুরুর পরপরই আত্মঘাতী বিস্ফোরণে তাদের সবার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ওই অভিযানের পর শুক্রবার সকাল থেকে বড়হাট এলাকায় আস্তানায় অপারেশন ম্যাক্সিমাস শুরু করেন সোয়াত সদস্যরা।
‘এমন বীভৎস লাশের ময়নাতদন্ত আর করিনি’ : ‘লাশের ছিন্নভিন্ন অংশ দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। সব লাশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। আমার ১২ বছরের চিকিৎসা জীবনে এমন বীভৎস লাশের ময়নাতদন্ত আর করিনি। কোনো লাশের শরীরে অর্ধেক অংশ নেই, কোনো লাশের শুধু মাথা আছে। এখানে চারটি শিশু ছিল। শিশুদের বীভৎস লাশ দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলাম না।’ মৌলভীবাজার সদরের খলিলপুর ইউনিয়নের নাসিরপুর গ্রামের একটি জঙ্গি আস্তানায় সোয়াতের অভিযানের পর উদ্ধার হওয়া ৭টি লাশের ময়নাতদন্ত শেষে এভাবেই বলছিলেন চিকিৎসক দলের প্রধান ডা. আবু ইমরান। শুক্রবার বিকালে ময়নাতদন্ত শেষ হয়। চিকিৎসকরা জানান, ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বোমা বিস্ফোরণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। লাশগুলোর সুরতহাল প্রস্তুতকারী পুলিশ কর্মকর্তা মৌলভীবাজার মডেল থানার এসআই আবদুল মালিকও লাশগুলো দেখে হতবাক হয়ে যান। শুক্রবার বিকালে তিনিও যুগান্তরকে বলেন, অনেক লাশের সুরতহাল করেছি। এমন সুরতহাল আর কখনোই করিনি। বৃহস্পতিবার রাতে সুরতহাল করার পর থেকে আমি খেতেও পারছি না। জানালার গ্রিলের মধ্যে ছিন্নভিন্ন লাশের বিভিন্ন অংশ দেখতে পেয়েছি। পরে এগুলো সংগ্রহ করে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানান, সাতজনের মধ্যে চারজন শিশু, দু’জন নারী এবং একজন পুরুষ রয়েছে। এর মধ্যে দুই থেকে তিন মাস বয়সী শিশু রয়েছে। ওই শিশুটি ছেলে না মেয়ে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। শিশুটির শুধু মাথার অংশটি পাওয়া গেছে। অন্য তিন শিশুর সবাই মেয়ে। তাদের একজনের বয়স ২ বছর। অন্য দুজনের বয়স ৭ এবং ১০। তাদের লাশেরও একই অবস্থা। দু’জন নারীর মধ্যে একজনের বয়স ২৫ এবং অপরজনের বয়স হবে ৩৫ বছর। একজন নারীর শরীরের অর্ধেক চিহ্নিত করা গেছে এবং অপরজনের শুধু মাথা ছিল। পুরুষের বয়স ৩৫ বছরের মতো হবে। তার পেটের অংশ ছিন্নভিন্ন ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, তার শরীরে সুইসাইডাল ভেস্ট বাঁধা ছিল। সব লাশের শরীরে তার ও স্পি­ন্টার ছিল। মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. পার্থ সারথী দত্ত কানুনগো যুগান্তরকে জানান, পুরুষের মুখে ছোট দাড়ি রয়েছে। বোমা বিস্ফোরণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। চারজনের একটি মেডিকেল টিম ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে। টিমের প্রধান ছিলেন আবু ইমরান। অন্যরা হলেন অশোক ঘোষ, সুব্রত কুমার রায় ও পলাশ রায়।

No comments

Powered by Blogger.