উত্তরাঞ্চলের উন্নয়ন দেশের সমৃদ্ধির গতিকে বেগবান করবে

সম্প্রতি দেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর জেলায় সফরে গিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দলের নির্বাচনী স্লোগান হবে- ‘এবারের সংগ্রাম উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নের সংগ্রাম’ (যুগান্তর, ২৩ মার্চ)। তিনি তার বক্তব্যে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের রেল ও সড়ক যোগাযোগের দুরবস্থার অবসান, উত্তরাঞ্চলের খনিজসম্পদ উত্তোলন এবং জাতীয় উন্নয়নে সেগুলোর ব্যবহার, ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর বালাসী-বাহাদুরাবাদ এলাকায় সেতু নির্মাণ ও বাংলবান্ধা, বুড়িমারী, সোনাহাট, হিলিসহ উত্তরাঞ্চলের সব স্থল-শুল্কবন্দর উন্নয়নে অগ্রাধিকার প্রদানের জন্য সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন। যুগান্তের প্রতিবেদন মোতাবেক রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের রেল ও সড়ক যোগাযোগের দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে এইচএম এরশাদ বলেছেন, এখনও রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলার মানুষ প্রয়োজন অনুপাতে ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
এ অঞ্চল থেকে ঢাকা যেতে ট্রেনে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা সময় লাগে। তার শাসনামলে রংপুরে দুটি আন্তঃনগর ট্রেন চালু ছিল। এখন তা বন্ধ। শুধু একটি ট্রেন চালু আছে, ‘রংপুর এক্সপ্রেস’, তা-ও আবার সারা দিনে একবার ঢাকায় যায়। আবার ঢাকা থেকে একবার রংপুরে আসে। সেখানে বগি সংকট। বগিগুলো পুরনো। লাইট জ্বলে না। ফ্যান ঘুরে না। পানি থাকে না। দরজা-জানালা, বসার জায়গা-বেঞ্চ-চেয়ার ভাঙা, জরাজীর্ণ। সেই ট্রেন রংপুর থেকে ঢাকা পৌঁছতে সময় লাগে ১২ ঘণ্টা। শান্তাহার ঘুরে যেতে হয়। যদি রংপুর থেকে গাইবান্ধা ও বগুড়া হয়ে সরাসরি বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ঢাকা যাওয়া যেত, তাহলে রংপুর থেকে ঢাকা যেতে সময় লাগত ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হতো না। এজন্য প্রয়োজন মতো রেললাইন স্থাপন করা প্রয়োজন; কিন্তু তা না করায় বঙ্গবন্ধু সেতুর সুবিধা থেকে এ অঞ্চলের মানুষকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সড়কপথের দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে সাবেক এ রাষ্ট্রপতি বলেন, সড়কপথগুলো কম প্রশস্ত। তাই প্রায় সময় ঢাকা থেকে উত্তরের জেলাগুলোয় যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিন প্রাণহানি ঘটছে। শুধু তাই নয়, প্রায়ই ওই সড়কে যানজট লেগে থাকে। মানুষের কর্মঘণ্টা যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি জ্বালানি ব্যয় বাড়ছে। এজন্য ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ সড়কগুলো চার লেনে উন্নীত করা জরুরি। তাহলে এ অঞ্চলের শিক্ষা, অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর বালাসী-বাহাদুরাবাদ এলাকায় সেতু নির্মাণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এরশাদ বলেন, এ সেতুতে রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা হলে উত্তরের মানুষের ঢাকায় যাতায়াতে সময় আরও কমে আসবে। উল্লেখ্য, ক্ষমতাসীন সরকার বেশ কয়েকটি বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ফাস্ট-ট্রাকভুক্ত করেছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প, পদ্মা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার এবং রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প (এমআরটি), পায়রাবন্দর নির্মাণ প্রকল্প, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোলফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট, মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মধ্যে মাত্র একটি প্রকল্প (রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র) দেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। ‘উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য কোনো সরকার পরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ ও উন্নয়ন কাজে মনোযোগী না’ উল্লেখ করে এইচএম এরশাদ বলেন, দেশের মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনির পাথর উন্নত। এ পাথর দিয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণকাজে ব্যয় করা গেলে নির্মাণ ব্যয় সাশ্রয় হবে; কিন্তু জানা গেছে, যান্ত্রিক সমস্যার কারণে দেড় বছর ধরে ওই খনির পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। ফলে ভারত থেকে পাথর আমদানি করে দেশের বিভিন্ন প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে। রংপুরের পীরগঞ্জের খালাসপীরে উন্নতমানের কয়লাখনি রয়েছে। এ নিয়ে পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীনতার পর বহুবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে; কিন্তু আজও তা উত্তোলনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পীরগঞ্জ থেকে কয়লা উত্তোলন করা হলে রংপুর অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলের মানুষগুলোর জীবনমানের উন্নয়ন হবে। প্রাচীনকাল থেকে উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন কৃষি। অনেকের মতে, প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই উত্তরাঞ্চলে কৃষির গোড়াপত্তন হয়েছে এবং তা ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়েছে। প্রাচীনকালে এ অঞ্চলে উৎপন্ন কৃষিপণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ধান, পাট, মরিচ, হলুদ, আদা, রসুন, তুলা, রেশম, আখ, পান, সুপারি ও বিভিন্ন ফলমূল। মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামলে কৃষিপণ্য উৎপাদনের এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। এসব কৃষিপণ্যের দাম সস্তা হওয়ায় (উদাহরণস্বরূপ ১ মণ চালের দাম ১ আনা ৯ পাই) মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্দশাগ্রস্ত ছিল। ইংরেজ শাসনামলে এ অঞ্চলে যোগ হয় নীল চাষ; কিন্তু এ নীল চাষ থেকে চাষীরা অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হননি। ব্যবসা-বাণিজ্য মাড়োয়ারি, অন্যান্য বিদেশী ব্যবসায়ী ও স্থানীয় কিছুসংখ্যক মহাজনের নিয়ন্ত্রণে থাকায় ব্যাপক জনগোষ্ঠী এতে লাভবান হয়নি।
কেননা পণ্যের স্থানীয় মূল্য কখনোই রফতানি মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়েনি। পাকিস্তান আমলে উত্তরাঞ্চলসহ তৎকালীন পূর্ব পকিস্তানে কৃষি খাত ছিল স্থবির। বাংলাদেশ আমলে চাষাধীন জমির পরিমাণ বাড়লেও জমিতে বিরামহীনভাবে চাষাবাদ করায় ও কম উর্বর জমি চাষাবাদের আওতাভুক্ত হওয়ায় একর প্রতি গড়পড়তা ফলনও তেমন বাড়েনি। তাছাড়া উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও উন্নত বিপণন ব্যবস্থার অভাবে কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। ফলে তাদের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না। দেশের উত্তরাঞ্চলটি যুগ যুগ ধরে শিল্প খাতে রয়ে গেছে অনুন্নত। ইংরেজ আমলের কথা বাদ দিলেও পাকিস্তান আমলে শিল্প খাতে যেটুকু অগ্রগতি হয়েছিল, তা ছিল ভারি শিল্প খাতে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা ও দুটি বড় সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ সহজগম্য না থাকায় সঙ্গত কারণে উত্তরাঞ্চলে বৃহৎ শিল্পের প্রসার ঘটেনি। বাংলাদেশ আমলেও এখানে বড় বা মাঝারি ধরনের শিল্পের তেমন প্রসার ঘটেনি। অবকাঠামোগত সুবিধার অভাব, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা, পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের অভাবে উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগে গ্যাসভিত্তিক শিল্প স্থাপনে শিল্পোদ্যোক্তারা বড় ও মাঝারি শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসছেন না। বিশেষ করে গ্যাস সরবরাহ না থাকায় গ্যাসভিত্তিক ইউরিয়া সার কারখানা, সিরামিক শিল্প, ওষুধ শিল্প, তৈরি পোশাক শিল্প, অটো অ্যাসেম্বলি শিল্প ইত্যাদি গড়ে উঠতে পারছে না। ফলে বাড়ছে না এখানকার মানুষের কর্মসংস্থান, লাঘব হচ্ছে না তাদের আর্থিক দুরবস্থা। প্রাচীনকাল থেকে মূলত কৃষির ওপর নির্ভরশীল উত্তরাঞ্চলের অধিবাসীদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে চার দশকে প্রায় অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বিশ্বব্যাংক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও বিশ্বখাদ্য সংস্থা কর্তৃক যৌথভাবে তৈরি এবং ২০১৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের পভার্টি ম্যাপ বা দারিদ্র্য মানচিত্র থেকে। দেশে যখন জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার কম-বেশি ৩০ শতাংশ, তখন দেশের উত্তরাঞ্চলে রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের হার ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশের প্রশাসনিক বিভাগগুলোর মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি। আবার দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি রংপুর বিভাগের আওতাধীন কুড়িগ্রাম জেলায়। এ জেলায় দারিদ্র্যের হার ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ, অর্থাৎ জাতীয় দারিদ্র্য হারের দ্বিগুণ।
উত্তরাঞ্চলের আরেকটি বিভাগ রাজশাহীর অবস্থাও সুবিধাজনক নয়। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে যখন দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে ২৬ ও ২৮ শতাংশ, তখন রাজশাহী বিভাগে দারিদ্র্যের হার ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ইকোনমিক সেন্সাস ২০১৩-এর প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘The findings shwo that at the division level, large variation still persists in economic activities’, যার অর্থ দাঁড়ায় ইকোনমিক সেন্সাস রিপোর্ট ২০১৩ অনুযায়ী বিভাগীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বৈষম্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা বিভাগে যখন ‘ইকোনমিক ইউনিটের’ সংখ্যা ২৫,৯৯,৩৭২টি, তখন রংপুর বিভাগে এ সংখ্যা ১০,৮৮,২৫৫টি। ১৩,৮৪,৭৫৭টি ইকোনমিক ইউনিট নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সার্বিক কৃষি খাত তিস্তার পানি প্রবাহের ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০০ বছর আগে তিস্তা উত্তরাঞ্চলে বৃহত্তম নদী হিসেবে পরিচিত ছিল। করতোয়া, আত্রাই, যমুনেশ্বরী ইত্যাদি নদী তিস্তার বিপুল জলরাশি নিয়ে প্রবাহিত হতো। এক সময়ের উচ্ছলা যৌবনা তিস্তা এখন অপমৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদী নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে তিস্তার ভারত অংশে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়েছে। পানি সরিয়ে সেচ কাজ এবং বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে পানির প্রবাহ ভীষণভাবে কমে গেছে। ফলে বাংলাদেশের ১২৫ কিলোমিটার তিস্তা অববাহিকায় সার্বিক কৃষি খাত ও জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। তাছাড়া শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ দারুণভাবে কমে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। সার্বিকভাবে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিয়েছে। ভারত সরকার নানা অজুহাতে তিস্তার পানির ন্যায্য বণ্টনে চুক্তি সম্পাদনে এগিয়ে আসছে না। সবশেষে যা বলা দরকার তা হল, উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি ও মানুষকে দেশের উন্নয়নের মূল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ অঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। উত্তরাঞ্চলের উন্নয়ন দেশের উন্নয়নের গতিকে বেগবান করবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.