এক লাশের দুই দাবিদার by আল-আমিন

উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ৬/এ নম্বর সড়ক। সড়কের পাশেই বড় একটি স্যুয়ারেজের লাইন। ঢাকনাবিহীন ওই স্যুয়ারেজের নালা থেকে অজ্ঞাত এক তরুণীর পচন ধরা লাশ ভাসতে দেখেন পথচারীরা। পুলিশ গত বৃহস্পতিবার রাতে ওই নালা থেকে লাশটি উদ্ধার করে। ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে। ওই লাশ উদ্ধারের খবরটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরেই আনিস নামে এক যুবক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মর্গে যান। লাশ দেখে তিনি বলেন, ওই তরুণী তার বোন। সেনাবাহিনীর চাকরিরত সিপাহীর স্ত্রী। পুলিশও তাদের কথার সত্যতা নিশ্চিত করে ওই তরুণীর লাশ তাদের কাছে হস্তান্তর করেন। ওই তরুণীর ভাই দাবিদার আনিস ও স্বামী পরিচয় দানকারী ফারুক আলম ওই তরুণীর লাশ নিয়ে দাফনের উদ্দেশ্যে অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামের বাড়ি মাগুরাতে রওনা দেন। কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে বিপত্তি। পুলিশের কাছে শিরিন নামে আরেক নারী দাবি করে বসেন, ওই তরুণী তার বোন। এতে বিপাকে পড়ে যায় পুলিশ। ফিরিয়ে আনা হয় সেই লাশ। এক লাশের দুই পরিবারের টানাটানিতে পুলিশ সেই লাশের ডিএনএ পরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
পুলিশ জানায়, লাশ উদ্ধারের সময় নিহত ওই তরুণীর পরনে ছিল খয়েরী রংয়ের সালোয়ার কামিজ। তার গলায় ও পিঠে চিহ্ন ছিল। হতভাগ্য ওই তরুণীকে দুর্বৃত্তরা শ্বাসরোধে হত্যা করে তার লাশ সেখানে ফেলে রেখে গেছে। ওই তরুণীর পরিচয় পাওয়া গেছে। বিস্তারিত ঘটনা জেনে দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নেয়া হবে।
সূত্র জানায়, লাশ উদ্ধারের পরে ওই তরুণীর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। এরপর আনিস নামে এক যুবক সাংবাদিকদের কাছে দাবি করে জানান, তার বোনের নাম সাবিনা আক্তার। সাবিনা আক্তারের স্বামীর নাম ফারুক আলম। সেনাবাহিনীর সিপাহী হিসাবে সাভার ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত আছেন। তাদের গ্রামের বাড়ি মাগুরা জেলার শ্রীপুরের মাঝাইল এলাকায়। তিনি আরও জানান, সাবিনা আক্তার সাভারের স্টাফ কোয়ার্টারে ডেইরি ফার্মে স্বামীর সঙ্গে থাকতেন। গত তিনবছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। কোন সন্তান ছিল না। সাবিনা গত বছর অনার্স সম্পন্ন করেছেন। চাকরির জন্য কয়েকস্থানে তিনি আবেদন করেছিলেন। অলি ও সবুজ নামে তার নিকটতম দুই আত্মীয় তাকে চাকরির আশ্বাস দেয়। বিনিময়ে তারা ৩ লাখ টাকা দাবি করে। আত্মীয় হওয়ার কারণে সাবিনা তাদের বিশ্বাসও করেন। গত ২৫ তারিখ সকালে সাবিনার মোবাইল ফোনে অলি কল দেয়। তাকে টাকা নিয়ে খিলক্ষেত বিদ্যুৎ অফিসে আসতে বলে। ওই ৩ লাখ টাকা নিয়ে সাবিনা খিলক্ষেতে যায়। এরপর আর সাবিনা বাড়িতে ফেরেনি। তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়। পরিচিত আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এতে পরিবারের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। শুক্রবার টেলিভিশনের খবর দেখে মর্গে গিয়ে বোনের লাশ শনাক্ত করেন তিনি। তার বোনের পরনের জামা ও নাকফুল দেখে তিনি নিশ্চিত হন। আনিস বলেন, পুলিশ আমাদের কাছে তার বোনের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান। আমরাও ঘটনার বিস্তারিত বলি। আনুষ্ঠানিকতা শেষে পুলিশ লাশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর আমরা তার লাশ দাফন  করার জন্য গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিলাম। ঢাকার ধামরাই পার হওয়ার সময় উত্তরা-পূর্ব থানার ওসি আবুবকর সিদ্দিকীর  নির্দেশে ওই স্থানের টহল পুলিশের একটি দল লাশবাহী ওই অ্যাম্বুলেন্সকে আটকায়। টহল পুলিশের দলটি আমাদের কাছে জানায় যে, উদ্ধারকৃত তরুণীর লাশটির স্বজন বলে আরেকজন নারী পুলিশের কাছে দাবি করেছে। তাদেরকে আবারও উত্তরা পূর্ব থানায় যেতে হবে। এরপর আবার উত্তরা পূর্ব থানায় আসি। এ সময় আমার বোনকে এক মহিলা তার বোন বলে পরিচয় দেয়। তখন উভয়ের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে পুলিশ দুই পক্ষকে শান্ত করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে ওই লাশের ডিএনএ করার উদ্যোগ নেন। উদ্ধারকৃত ওই তরুণীই তার বোন বলে তিনি দাবি করেন। ডিএনএ পরীক্ষায় তা প্রমাণিত হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। ওই তরুণীর বোন পরিচয় দানকারী শিরিন আক্তার জানান, তার বোন রিতা উত্তরখান এলাকায় বড় মসজিদের পাশের একটি বাড়িতে থাকতো। তাদের গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া এলাকায়। তার বোন একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা। এক যুবকের সঙ্গে তার প্রেম ছিল। তাদের সঙ্গে উত্তরখান এলাকায় থাকেন। গত দুইদিন ধরে তিনি বাড়ির বাইরে ছিলেন। এতে পরিবারের মধ্যে উদ্বেগ বেড়ে যায়। এরপর টেলিভিশনের স্ক্রলে দেখতে পায় যে, উত্তরা থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত ওই তরুণী তার বোন কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে যায়। কিন্তু, মর্গের কর্মীরা জানায় যে, ওই তরুণীর লাশ স্বজন দাবি করে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে গেছে। এরপর পুলিশের কাছে বিষয়টি আবেদন জানালে অ্যাম্বুলেন্সটি আবার থানায় নিয়ে আসা হয়। এরপর লাশ দেখে আমার বোন বলে আমি নিশ্চিত হই। তার বোনের খয়েরী পোশাক দেখে তিনি শনাক্ত করতে পেরেছেন। উত্তরা পূর্ব মডেল থানার ওসি আবুবকর মিয়া জানান, দুই পরিবারের লাশ নিয়ে টানাটানিতে পুলিশ বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে। পরে ওই লাশের ডিএনএ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, দুই পরিবারের লোকজন এমনভাবে আবেগ প্রকাশ করেছে তাতে মনে হয়েছে ওই তরুণীর লাশ যে কোন একটি পরিবারের হবে। এ ঘটনায় থানায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। লাশটির ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার পর তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ জানান, ওই তরুণীর ডিএনএ পরীক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে। তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। আগামী রোববার ওই প্রতিবেদন দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.