বাংলাদেশই বেশি লাভবান হবে -বিশেষ সাক্ষাৎকারে : তোফায়েল আহমেদ by আব্দুল কাইয়ুম ও ফখরুল ইসলাম

তোফায়েল আহমেদ
চারদেশীয় মোটরযান চুক্তির পর আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রথম আলো মুখোমুখি হয় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল কাইয়ুমফখরুল ইসলাম
প্রথম আলো : আগেরবার যখন মন্ত্রী ছিলেন, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর চুক্তি করেও কিন্তু সফল হতে পারেননি। এখন করলেন চারদেশীয় চুক্তি। এবারও কি আগের মতো সমস্যা হতে পারে?
তোফায়েল আহমেদ: আসলে ১৯৯৬ সালে আমি যখন বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলাম, তখন নেপালের বাণিজ্যমন্ত্রী ও আমি মিলে পঞ্চগড়ে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর উদ্বোধন করেছিলাম। পরে সেটা কার্যকর হয়নি। কারণ, ভারতের সঙ্গে তখন সংযুক্তির (কানেকটিভিটি) চুক্তি ছিল না। এবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে সেই সমস্যার নিরসন হয়েছে। এখন সেই সমস্যা নেই।
প্রথম আলো : ওই সময় নেপালের ব্যবসায়ীরা বলেছিলেন, মহাসড়কে নিরাপত্তা না থাকায় পণ্য পাঠানো সমস্যা।
তোফায়েল আহমেদ: না। আসল কথা, তখন ভারতের সঙ্গে আমাদের চুক্তি ছিল না। কিন্তু এবার যে চুক্তি হয়েছে, তাতে ভারত, নেপাল ও ভুটানে সরাসরি পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা যাবে। শুধু তা-ই নয়, এখান থেকে যাত্রীরাও তিন দেশে যাওয়া-আসা করতে পারবেন।
প্রথম আলো : আমাদের পণ্য যাবে, ওদের পণ্য আসবে, নিরাপত্তার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেবে না?
তোফায়েল আহমেদ: এখন তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। আমাদের অংশে যেমন নিরাপত্তার সমস্যা নেই, তাদের অংশেও নেই। তবে এটা ঠিক, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
প্রথম আলো : ব্যাপারটা কি এমন যে আমাদের রাস্তার উন্নয়ন আমরা করব, আর তারা করবে তাদেরটা?
তোফায়েল আহমেদ: ঠিক তা-ই।
প্রথম আলো : আগে বলা হতো নেপাল ও ভুটানের পণ্য মংলা বন্দর দিয়ে আসবে?
তোফায়েল আহমেদ : আমাদের দুইটা বন্দর। তিন দেশই এ দুই বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। তাদের থেকে আমরা রাজস্ব পাব। সিঙ্গাপুরের উন্নতি ও লাভবান হওয়ার কারণ হচ্ছে দেশটির বন্দর বিশ্বের সবাই ব্যবহার করতে পারে। শ্রীলঙ্কাও অন্যদেরও বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে লাভবান হচ্ছে। বন্দর শুধু আটকে রাখলে হবে না। তাই বন্দরেরও আমরা আধুনিকায়ন করছি।
প্রথম আলো : আগে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, নেপাল-ভুটানের জন্য মংলা ব্যবহৃত হলে পশ্চিম বাংলার বন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
তোফায়েল আহমেদ : না, তা হবে না। যেমন পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছি ভারতের কাছ থেকে। চারদেশীয় চুক্তি যদি কাজে লাগাতে পারি, আমরা লাভবান হব।
প্রথম আলো : চুক্তির ফলে লাভবান বেশি হবে কারা?
তোফায়েল আহমেদ : বাংলাদেশ বেশি লাভবান হবে। আজকে বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের যুগে সংযুক্তি ছাড়া কোনো দেশেরই ব্যবসা-বাণিজ্য সফলতা লাভ করে না। এখন আমাদের চার দেশের মধ্যে সংযুক্তি হয়ে গেল। তারপর আমরা জোর দেব বিসিআইএমের ওপর। বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার—এই চার দেশের অর্থনৈতিক করিডর থেকেও আমরা সাংঘাতিক লাভবান হব। ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আলোচনাও চলছে। অবকাঠামো উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক, এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) বিনিয়োগ করবে।
প্রথম আলো : অনেকের সন্দেহ যে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে আমরা আসলেই লাভবান হব কি না?
তোফায়েল আহমেদ : যারা এ দেশে ভারতবিরোধী রাজনীতি করে, তারাই এসব কথা বলে। তাদের দল বা গোষ্ঠীবিশেষের জন্মই হয়েছে ভারতবিরোধিতা ও মৌলবাদিতার ওপর ভিত্তি করে। এগুলো আসলে স্রেফ ভারতবিরোধিতা।
নরেন্দ্র মোদির সফর দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। ৪১ বছরেও যে স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুমোদন হয়নি, সম্প্রতি ভারত তা সর্বসম্মতভাবে করেছে। তারপর আছে সমুদ্রসীমা। সমুদ্রসীমা নিয়ে মামলা করতে আমরা ইতস্তত করিনি। ভুটান ও নেপালে আমরা সরাসরি যেতে পারতাম না। আজ সেই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যারা বিরোধিতা করে, তারা কেন গঙ্গার পানি আনতে পারল না? শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা আনতে পারল না?
প্রথম আলো : ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি তো অনেক বেশি।
তোফায়েল আহমেদ : বাণিজ্য ঘাটতি সব সময় যে ক্ষতি করে, তা নয়। চীনের সঙ্গে আমাদের ৮০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য; চীন যদিও বলে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার। চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি আছে, পাশাপাশি চীনে আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে। ভারতের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
আবার ভিন্ন চিত্রটিও দেখুন। যুক্তরাষ্ট্রে আমরা ৫৫০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করি, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে করি ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য। যুক্তরাষ্ট্র বা ইইউ কিন্তু সে তুলনায় আমাদের কাছে রপ্তানি কম করে। এই বাণিজ্য ঘাটতির জন্য কি তারা খুব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? প্রায়ই বক্তৃতা দেওয়া হয়, বাণিজ্য ঘাটতি, বাণিজ্য ঘাটতি। আমি চাই, এটা নিয়ে প্রথম আলো লিখুক।
প্রথম আলো : কিন্তু আমাদের রপ্তানি যদি ভারত বা চীনে আরও বাড়ানো যেত ভালো হতো না?
তোফায়েল আহমেদ : তা হতো। কিন্তু আমরা চীন-ভারতের কাছ থেকে পণ্য এনে নিজেরা লাভবান হই। ভারত যদি তুলা, সুতা বা পেঁয়াজ-রসুন ইত্যাদি নিত্যপণ্য আমাদের কাছে বিক্রি না করে, আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। ভারত যদি এখন মনে করে তারা বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি করবে না। ক্ষতিগ্রস্ত কে হবে? বাংলাদেশ। আর ভারতে রপ্তানি করতে না পারার যে প্রশ্নটি এসেছে, সে বিষয়ে বলব, ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজার অনেক বড়। তাদের পণ্যের দাম কম। সেখানে আমাদের পণ্য রপ্তানি করে তেমন সুবিধা করা সহজ নয়।
প্রথম আলো : তাহলে তো যেখানে রপ্তানি করলে সুবিধা হবে, সেখানেই যাওয়া উচিত।
তোফায়েল আহমেদ : হ্যাঁ। সে জন্যই তো আমরা বিদ্যমান বাজারের পাশাপাশি দক্ষিণ আমেরিকা, ব্রাজিল, চিলিতে যাচ্ছি। তাদের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) হয়েছে।
প্রথম আলো : ট্রানজিটের শর্তের মধ্যে কি মাশুলের (ফি) হার নির্ধারণের বিষয়ে কিছু বলা আছে?
তোফায়েল আহমেদ : বিষয়টি আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ঠিক করা হবে। প্রতিটি দেশের মাশুল-হারের নিজস্ব হিসাব আছে, সেভাবে দিতে হবে। যেমন ইইউতে এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য যায়। তারা কীভাবে দেয়? এগুলো বিবেচনায় নেওয়া হবে। তবে শুল্ক দিতে হবে।
প্রথম আলো : এর আগে প্রয়াত যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বি ডি রহমতউল্লাহর নেতৃত্বাধীন কমিটির একটা সুপারিশ এসেছিল। বলা হয়েছিল, যেহেতু ট্রানজিট দেওয়া হলে ভারতের পণ্য পরিবহনের খরচ কমবে ৮০ শতাংশ, তাই এর একটা অংশ বাংলাদেশের পাওয়া উচিত।
তোফায়েল আহমেদ : আমরা বিভিন্নভাবে লাভবান হব। যেমন আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নে ভারত ২০০ কোটি ডলার সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে।
প্রথম আলো : ভারী ট্রাক আসা-যাওয়া করবে, কয়েক দিনের মধ্যে মেরামত করতে হবে। তখন?
তোফায়েল আহমেদ : এটা ঠিক না যে ভারী ট্রাকের কারণে রাস্তা ভেঙে যাবে। আমাদের প্রাণ গ্রুপ ত্রিপুরায় শিল্প করেছে। পূর্ব ভারতের প্রতিটি রাজ্যে প্রাণ পণ্য রপ্তানি করে। ওই রাজ্যগুলোতে আমাদের পণ্য ভারতের পণ্যের চেয়েও বেশি যাবে।
প্রথম আলো : কিন্তু ভারত ট্রানজিট পেলে পূর্ব ভারতে প্রাণ বাজার হারাবে কি না?
তোফায়েল আহমেদ : না, মোটেই না। কারণ, আমরা যত সহজে ও কম ব্যয়ে পূর্ব ভারতে পণ্য পাঠাতে পারব, দিল্লি বা ভারতের অন্য রাজ্য সেই সুবিধা পাবে না।
প্রথম আলো : তিস্তার পানি পেলাম না, অথচ ট্রানজিট দিয়ে দিলাম?
তোফায়েল আহমেদ : তিস্তার পানিও পাব আমরা। শুধু সময়ের ব্যাপার। প্রতিটি দেশেরই রাজনীতি আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুবার ঢাকা সফর করেন। পশ্চিম বাংলা চায় ২০১৬ সালের নির্বাচনের পর বিষয়টা সমাধান করতে। এটা হলো বাস্তব কথা।
প্রথম আলো : ভারতকে দুইটা বিদ্যুৎকেন্দ্র আমরা দিয়ে দিলাম দরপত্র আহ্বান ছাড়াই। এই সময়ে এসে এমন দায়মুক্তি দেওয়ার দরকার ছিল?
তোফায়েল আহমেদ : দেখুন, বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের দরকার। এখন ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ লোক বিদ্যুৎ পায়। আমরা সবার কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে চাই। কুইক রেন্টাল পাওয়ার যখন চালু করেছি, সমালোচকের কোনো অভাব ছিল না। তখন ছিল ঘরে ঘরে অন্ধকার। আর এখন আলোকিত বাংলাদেশ। কীভাবে হয়েছে?
সমালোচনা করবেন তখন, যদি দেখবেন বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছি। রামপালে আমরা কি এমন কোনো প্রকল্প করব, যা আমাদের স্বার্থের বিরোধী? আমরা কি দেশকে ভালোবাসি না? সবকিছু বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই করা হচ্ছে।
প্রথম আলো : আপনি উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বে ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। সেই সময়ের স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে?
তোফায়েল আহমেদ : বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দেশ স্বাধীন করার। সে জন্য তিনি অনেক জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। ফাঁসির কাষ্ঠে পর্যন্ত গিয়েছেন। তাঁর সেই স্বপ্ন এখন ধীরে ধীরে পূরণ হতে চলেছে। আমরা সে পথেই এগিয়ে যাচ্ছি। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হব এবং ২০৪১ সালের মধ্যে হব উন্নত দেশ।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
তোফায়েল আহমেদ : ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.