নতুন প্রস্তাব দিল গ্রিস

সব ব্যাংক বন্ধ। এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলা ছাড়া আর
কোনো উপায় নেই গ্রিসের বাসিন্দাদের। রাজধানী এথেন্সের
মধ্যাঞ্চলের এই এটিএম বুথের মতো দেশজুড়ে সব বুথের
সামনেই গতকাল ছিল গ্রাহকদের লাইন l ছবি: এএফপি
আইএমএফের ১৬০ কোটি ইউরো ঋণ পরিশোধ করার সময়সীমার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে গতকাল মঙ্গলবার রাতে গ্রিস সরকার আর্থিক পুনরুদ্ধারে নতুন চুক্তির অনুরোধ জানিয়েছে। নতুন চুক্তির ওই প্রস্তাবে গ্রিস নতুন করে দুই বছরের জন্য প্রায় তিন হাজার কোটি ইউরো সাহায্য চেয়েছে।
ইউরোজোনের অর্থমন্ত্রীরা গ্রিসের বিষয়ে গতকাল রাতে টেলিকনফারেন্সে আলোচনায় বসেন। তাঁরা গ্রিসের আর্থিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচি অনুমোদন করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে নতুন চুক্তির প্রস্তাবের আলোকে আজ বুধবার পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। খবর এএফপি, বিবিসি ও রয়টার্সের।
দাতাদের দেওয়া আর্থিক পুনরুদ্ধার (বেইলআউট) কর্মসূচি প্রস্তাবের ওপরে গণভোট ডেকে বড় বাজিই ধরেছেন গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাস। তিনি চান এথেন্সকে ইউরোতে রাখতে। কিন্তু এ জন্য দাতাদের দেওয়া শর্ত মেনে নিতে রাজি নন। তাই সিদ্ধান্তের বোঝাটা ঠেলে দিয়েছেন জনগণের দিকে।
তবে আগামী রোববারের ওই গণভোটে এথেন্সের ইউরো থেকে বেরিয়ে যাওয়া ঠেকানো গেলে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে ইউরোপেরই। তারাও চায় গ্রিস ইউরোতে থাকুক। কিন্তু গ্রিসকে দাতাদের দেওয়া শর্ত মেনে নিতে হবে।
ফরাসি বিনিয়োগ ব্যাংক নাতিক্সিসের অর্থনীতিবিদ ফিলিপ ওয়েস্তার বলেন, ‘গ্রিস ও তার অংশীদারদের প্রশ্নে আমরা একটি চরম জটিল সপ্তাহে প্রবেশ করছি। রোববারের গণভোটেই দেশটির ভবিষ্যৎ ঠিক হবে। কিন্তু এর আশু পরিণতি এখনো অজানা।’
বেইলআউট প্রস্তাবের ওপর সপ্তাহান্তে গণভোটের ঘোষণা দিয়ে গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস একটি আকস্মিক বিস্ময় উপহার দিয়েছেন। ব্যয়-সংকোচনবিরোধী অবস্থান নিয়ে গত জানুয়ারিতে নির্বাচিত হওয়া তাঁর সরকার শুরু থেকেই এমন প্রস্তাবের বিরোধী। কারণ, এতে করে বাড়তি করারোপ ও ব্যয় কর্তনের পথে হাঁটতে হবে।
গ্রিসের ইউরোজোনের অংশীদারেরা এরই মধ্যে আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছে। আর ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইসিবি) তার জরুরি সহায়তা আরও বাড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ফলে গ্রিসকে তার ব্যাংকগুলো এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দিয়ে পুঁজি নিয়ন্ত্রণের পথ ধরতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস গণভোটে সবাইকে ‘না’ ভোট দিয়ে প্রস্তাবটি আটকে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় নেতারা ‘হ্যাঁ’ ভোট দিতে গ্রিসের নাগরিকদের প্রতি অনুরোধ করেছেন।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান জ্যঁ-ক্লদ ইয়ুংকার বলেন, ‘আমি গ্রিসের জনগণকে “হ্যাঁ” ভোট দিতে বলব। প্রশ্নটা যা-ই হোক, “না” ভোট জেতার অর্থ হবে, গ্রিস ইউরোপকে “না’ বলে দিল।’ আর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ বলেন, ‘প্রশ্নটা হলো...গ্রিকের নাগরিকেরা ইউরোতে থাকতে চান...নাকি ছেড়ে চলে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চান, সেটি জানা যাবে।’
গণভোটের আহ্বান করার আগেই গ্রিসের সাপ্তাহিক পত্রিকা ভিমার জন্য একটি মতামত জরিপ চালায় গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাপা। এতে দেখা গেছে, গ্রিসের ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ নাগরিকই বেইলআউট প্রস্তাবের পক্ষে এবং ৩৩ শতাংশ বিপক্ষে। আর ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ কোনো দিকেই মত দেননি।
মূল কথা হচ্ছে, কর বৃদ্ধি ও বেতন কর্তন নিয়ে গ্রিসের নাগরিকেরা এত দিন উদ্বিগ্ন থাকলেও এখন তাঁদের ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং অর্থ উত্তোলনের ওপর কড়াকড়ির মতো সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গ্রিস ইউরোজোন থেকে বিদায় নিলে এই পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হতে পারে। এ কারণেই ‘হ্যাঁ’ ভোটের হালে পানি পাচ্ছে।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান মনে করেন, গ্রিসের বেইলআউট সহযোগী ত্রয়ী ইইউ, আইএমএফ এবং ইসিবি-ই তাদের বেইলআউট প্রস্তাবের মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাসকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে।
দেনা শোধ না দিলে কী হবে?
ঋণদাতা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) গ্রিসের দেড় বিলিয়ন ইউরো (১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) শোধ করার কথা ছিল গতকাল মঙ্গলবারের মধ্যেই। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এথেন্স এই দেনা শোধ করতে পারছে না বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। এতে করে একটি ঝুঁকিপূর্ণ পথে পা বাড়াতে হচ্ছে দেশটিকে।
এরই মধ্যে আইএমএফের দ্বিতীয় আর্থিক পুনরুদ্ধার (বেইলআউট) কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে গ্রিস। এমন প্রেক্ষাপটে এথেন্স এখন ঋণ শোধ না করতে পারলে তাৎক্ষণিকভাবেই আইএমএফের সেবা ও সুবিধাদি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাত্ত্বিকভাবে দেখলে, দেশটিকে আন্তর্জাতিক এই আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়নের পথ ধরিয়েও দেওয়া হবে।
আইএমএফের কাছ থেকে নেওয়া সাড়ে ৫ বিলিয়ন ইউরো এ বছরের মধ্যেই শোধ দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এথেন্স। সময়সীমার মধ্যে দেনা শোধ দিতে না পারলে এথেন্সকে খেলাপি ঘোষণা করবে আইএমএফ। এই ঘোষণার অর্থ, আইএমএফের সম্পদে গ্রিসের প্রবেশাধিকার সঙ্গে সঙ্গে স্থগিত হয়ে যাবে।
আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালন ক্রিস্তিনা লগার্দে জানিয়ে দিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ে গ্রিস দেনা শোধ না করলে ৩০ দিন পর বিষয়টি আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। এই বোর্ড আইএমএফের ১৮৮ সদস্য দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। ঋণ শোধের সময়সীমার তিন মাস পর বোর্ড বিষয়টি বিবেচনা করবে। বোর্ডে সেটি গৃহীত হলে গ্রিস আইএমএফের মুদ্রা এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস) ব্যবহারের অধিকার হারাবে। পরিস্থিতি এভাবেই চলতে থাকলে বোর্ড অসহযোগিতা ঘোষণা করতে পারে। এতে করে আইএমএফে গ্রিসের ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব স্থগিত হবে। ভোটাধিকার স্থগিত হওয়ার ছয় মাস বা ঋণখেলাপি হওয়ার ২৪ মাস পেরোলে বোর্ড গ্রিসকে আইএমএফ থেকে বহিষ্কারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করবে।

No comments

Powered by Blogger.