বিচারপতি খায়রুলের রায় ও মায়ার মন্ত্রিত্ব by মিজানুর রহমান খান

দণ্ডিত হলে মন্ত্রিত্ব ও সংসদের সদস্যপদ যায় কি যায় না, সেটি রাষ্ট্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যে রাষ্ট্র ন্যূনতম আইনের শাসনে বিশ্বাস করে না, তার পক্ষে আদালতের রায়কে শিরোধার্য করে চলা কেবল কঠিন নয়, এটা বাস্তবসম্মতও নয়। বিচার বিভাগ পৃথক্করণ ও ক্ষমতার পৃথক্করণ কী বস্তু, তা নিয়ে শিক্ষিতজনের মধ্যেই যথেষ্ট দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। নিম্ন আদালতই বিচারিক আদালত, এই আদালতের স্বাধীনতা না মানলে, তাঁকে স্বাধীনতা না দিলে আইনের শাসনের প্রবেশদ্বারটাই রুদ্ধ থাকে। কেউ স্বীকার করুক আর না-ই করুক, নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা প্রশ্নে সব থেকে গুরুতর চক্রান্ত চলমান রয়েছে। আমলাতন্ত্রের যে অংশটি গণবিরোধী, যারা স্বাধীনতার পরে ড. কামাল হোসেনের কথায়, ‘ক্ষমতা ও মর্যাদা হারানোর ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, তাদেরই আমরা পৃথক্করণের উদ্যোগকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করতে দেখে চলছি। দণ্ডিত ব্যক্তির মন্ত্রী থাকা ওই রুগ্ণ আমলাতন্ত্রের জন্য সুখকর, যারা মনে করে তারাই সরকার টেকায়, তারাই সরকার চালায়।’
তবে ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তি মন্ত্রী থাকতে পারেন কি না, এটা যে দেশে বিতর্কের বিষয় এবং বিশেষজ্ঞরা মত-দ্বিমত করতে পারেন, সেটাই আসলে বলে দেয়, এ বিষয়টি বাংলাদেশের একান্ত নিজস্ব গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের ধারণার (যা বর্তমানে বহাল) সঙ্গে খাপ খায় না। যে আদর্শগত ভাবনা থেকে বাহাত্তরের সংবিধানে দণ্ডিতের মন্ত্রিত্ব বা সংসদ সদস্য না থাকার বিধান লেখা হয়েছিল, সেই রাজনীতি দেশে নেই। সেটা পুনরুজ্জীবনের কোনো আকাঙ্ক্ষাও সমাজে আপাতত অনুপস্থিত।
আমাদের উচিত হবে সেই অপারগতাটা স্বীকার করা। তাহলে আমরা কখনো সমাধানের দিকে যেতে পারি, কিন্তু কিছু মহল যখন অপারগতাকে মানতে চান না, বরং তা নিয়ে বড়াই করেন, এমনকি তাকে আইন দেখান, তখনই তা বড় করুণ ও দুর্ভাগ্যজনক হয়ে ওঠে। তবে একজন বিদগ্ধ লেখক আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সামনের রাজনীতিতে বিএনপির ওপর এই ব্যাখ্যার বিরাট তাৎপর্য আছে। সরকারি দলকে দু-একজন মায়ার মায়া কাটাতে হবে। কিন্তু বিএনপি তো শ্মশান হবে, শীর্ষ নেতারা তো নির্বাচনেই দাঁড়াতে পারবেন না। নিম্ন আদালতে দণ্ডিত ব্যক্তি যদি আপিল না করে প্রার্থী হতে না পারেন, তাহলে তাতে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সব থেকে বেশি শঙ্কিত হতে পারে। এই বাস্তব যুক্তির জোর অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কিন্তু সংবিধানের একটি বিধানের বিকৃত ব্যাখ্যার ওপরে দাঁড়িয়ে ‘গণতন্ত্রচর্চার’ যুক্তি মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। ক্ষমতাসীনদের মতো বিএনপি হলো সেই শক্তি, যারা ক্ষমতার পৃথক্করণ ও বিচার বিভাগ পৃথক্করণ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। নিম্ন আদালতব্যবস্থা ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়েই চলমান রয়েছে। সেখানেই দেশের অধিকাংশ অপরাধের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। সাধারণ মানুষ তা মেনে নেয়। বিচারব্যবস্থার ত্রুটি যাতে না সারে, সে জন্য পদ্ধতিগতভাবে পৃথক্করণের বিরোধিতাকারী গোষ্ঠী, যাদের আমরা ১৯৯০ থেকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে পেয়েছি, আরও সংক্ষেপে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বুঝে থাকি, তাহলে তারা কেন সেই একই বিচারব্যবস্থার ফলভোগী হবে না? কেন তাঁরা নিজেদের মতো করে সংবিধানের ব্যাখ্যা দিয়ে দণ্ডিত হয়েও মন্ত্রী থাকবেন এবং আমাদের তা মানতে বাধ্য হতে হবে। আমরা তো চাইব, তাঁরা আগে নিজের চরণ দুটি ঢাকুন, মানে বিচারব্যবস্থার ত্রুটি দূর করুন, তাহলে আর ধরণি ঢাকতে না হবে, মানে তাহলে আর নিম্ন আদালতের দণ্ড না মেনে খারাপ নজির স্থাপন করতে হবে না। নিম্ন আদালতের রায় হলেই সরকারি কর্মকর্তাসহ অনেক নাগরিকের ওপর তার প্রভাব পড়ে, তাহলে মায়ার ওপর পড়বে না কেন, না পড়লে কারও ওপর পড়বে না।
মায়ার বিষয়টি কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়। এটা একটা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নৈতিকতার প্রশ্ন। মায়ার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে হাজি সেলিমের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। গত জানুয়ারিতে আপিল বিভাগ নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায় বাতিল করেছেন। যদি সত্যিই মায়ার মন্ত্রিত্ব না যায়, হাজি সেলিমের সংসদ সদস্যপদ শূন্য ঘোষণা করা সম্ভব না হয়, তাহলে সরকারি দলের উচিত হবে ৬৬ অনুচ্ছেদটা সংশোধন করে নেওয়া। এতে একটু কম প্রতারণা ঘটবে, তখন সেটা মানা যাবে, কিন্তু সংবিধানের অসত্য ব্যাখ্যা মানা যাবে না। বিএনপিকেও বলতে হবে, সবাই মিলে আমরা এমন রাষ্ট্র গড়েছি, যেখানে দণ্ডিতকে মন্ত্রী থাকতে হবে, নইলে শিশু গণতন্ত্র কষ্ট পাবে!
দুদকের অন্যতম কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন সাংবাদিকদের গত ২৮ জুন বলেছেন, দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান মায়ার অযোগ্যতার বিষয়ে যে মত দিয়েছেন, তা নৈতিকভাবে ঠিক। আবার তিনি মনে করেন, তাঁর ব্যক্তিগত মত হলো, আইনগতভাবে মায়ার মন্ত্রিত্ব আছে। তার মানে দাঁড়াল, তিনি বলতে চাইছেন, বাংলাদেশে এ বিষয়ে এখন যে ‘আইন’ আছে, তা নৈতিকতাবিবর্জিত।
কিন্তু সত্য হলো বিদ্যমান আইন নৈতিক। এর ব্যাখ্যা ও অনুশীলন যেটা ঘটে চলেছে, সেটাই অনৈতিক ও গর্হিত। মামলা প্রত্যাহারে আপিল বিভাগের তিরস্কার সত্ত্বেও শাহাবুদ্দিন কেন মামলা তুলে নিতে চেয়েছিলেন? অনাবশ্যক ব্যক্তিগত মতামত দেওয়ার চেয়ে দুদক কমিশনারের উচিত এই কৈফিয়তটা আগে দেওয়া।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক দৃঢ়তার সঙ্গে মনে করেন, নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া মাত্রই কোনো ব্যক্তি এমপি পদে থাকতে আপনাআপনি অযোগ্য বলে গণ্য হবেন। আপিলের খোঁড়া যুক্তি দিয়ে মন্ত্রী ও এমপি পদে বহাল থাকা চলবে না। কারণ তাঁর কথায়, ‘সংবিধানপ্রণেতারা এই বিধান করেছিলেন, এমপিকে সাধারণের থেকে তফাত করতে। রাষ্ট্র পরিচালকরা আপিলে খালাস পেতে পারেন, আবার নাও পারেন, কিন্তু দণ্ডিত হওয়ার কারণে তাঁর সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তাই তিনি অযোগ্য বলে গণ্য হবেন।
বিচারপতি খায়রুল হক নানা কারণে আলোচিত। ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার সুবাদে তিনি বিএনপির অনেকের কাছে চক্ষুঃশূল। আবার ক্ষমতাসীন দলের অনেকের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত। কিন্তু চূড়ান্ত অর্থে তাঁর বিচারিক অভিজ্ঞানকে রাজনীতিকেরা এখন পর্যন্ত তাঁদের নিজস্ব রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের বাইরে নিয়ে যেতে পারেননি। এটা বেশি করে সত্য ক্ষমতাসীন দলের জন্য। তাঁর সব বিচারিক অভিমতের সঙ্গে সবাই একমত নাও হতে পারে, কিন্তু তাঁর অনেকগুলো মাইলফলক সিদ্ধান্ত রয়েছে, যার প্রতি শাসক দলের দৃষ্টিভঙ্গি পীড়াদায়ক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ক্ষমতাসীন এবং তাদের মিত্রদের যে ভালো লেগেছে, তার পুনরুল্লেখ বাহুল্য। এই বিচারপতি কতটা জ্ঞানী, তা যদি আপনি এই দুটি বিশেষ রায়ের আলোকে প্রশ্ন করেন, তাহলে ক্ষমতাসীনদের তরফে উৎফুল্ল প্রতিক্রিয়া পাবেন। আবার যদি প্রশ্ন করেন, সেই একই ব্যক্তি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে এ পর্যন্ত যত রকম সুপারিশ করেছেন, তার কতটা বাস্তবায়ন করেছেন, তাহলে বিষাদময় প্রতিক্রিয়া দেখবেন। কারণ, তাঁর দেওয়া সুপারিশের এখন পর্যন্ত দুআনাও বাস্তবায়নযোগ্য মনে করে না সরকার। এখন আরেকটি জ্বলন্ত প্রমাণ হলো, জনতা টাওয়ার মামলায় ৬৬ অনুচ্ছেদের যে ব্যাখ্যা দিতে তিনি ঠাসা ২০টি পৃষ্ঠা (১০ বিএলটি এইচসিডি ২০০২) খরচ করলেন, সেটা মেনে নিলেই আর মায়ার মন্ত্রিত্ব থাকে না। কিন্তু ক্ষমতাসীন ও তদীয় মিত্রদের এমন কাউকে পাবেন না যে বা যাঁরা বলবেন, ওই রায় তাঁরা আদৌ পাঠ করেছেন কি না।
মায়ার মন্ত্রিত্বের প্রশ্নের সঙ্গে গোটা মন্ত্রিসভার নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত। আইনি প্রশ্নটা কীভাবে জড়িত, সেটা বিচারপতি খায়রুলের রায়ের আলোকে আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের ইতিহাসে একমাত্র তিনিই ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ২ দফার ঘ উপ-দফা ব্যাখ্যা করেন। এই বিধানে বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হবেন না, যদি ‘‘তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুবছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়ে থাকে”।’
২০০১ সালে হাইকোর্টে আওয়ামী লীগের অ্যাটর্নি জেনারেল কে এস নবী যুক্তি দিয়েছিলেন: ‘ওই বিধানে ‘‘দোষী সাব্যস্ত’’ অর্থ ‘‘চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত’’ পড়তে হবে। কারণ আপিলের অধিকার থাকলে তা একেবারে রিভিউ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকবে।’ বিচারপতি খায়রুল তা যথার্থই প্রত্যাখ্যান করেন। আমাদের দেশে সাধারণভাবে এই ভ্রান্ত মত আর কেবল কোর্ট-কাছারির গণ্ডিতে নেই, বেশ জনপ্রিয় হয়ে পড়েছে। অনেক আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীরা বিভ্রান্ত।
বিচারপতি খায়রুলের যুক্তি হলো, সংবিধান প্রতিবন্ধকতামূলক বিধান করেছে। দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেই হলো, সেটা আপিলে খালাস না হওয়া পর্যন্ত টিকে থাকবে। আপিল করলেন তো কী হয়েছে? এমনকি আপিলে নির্দিষ্টভাবে যদি দণ্ড স্থগিত করা হয়, তাহলেও সংবিধানের ওই তলোয়ারের কোপ থেকে তার নিস্তার নেই। আর ইতিমধ্যে আপিল বিভাগের রায়ে আমরা দেখছি তাঁর দণ্ড স্থগিত করা হয়নি বরং নতুন করে শুনানি করতে বলা হয়েছে। দণ্ডিত হওয়া মাত্রই গর্দানটা যাবে, জায়গার মুণ্ডু জায়গায় আসবে চূড়ান্তভাবে খালাস ঘোষণার পরে, তার আগে নয়। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা সম্প্রতি ঠিক একই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে, নিজেদের মেরুদণ্ড সোজা করে খায়রুলের রায় জরুরি ভিত্তিতে অনুসরণ করা, সংসদের দুটি আসন শূন্য করে উপনির্বাচন দেওয়া।
ভারতে হিমাচল প্রদেশের দণ্ডিত রাকেশ সিং ১৯৯০ সালে সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিনে বেরিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে রিটে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হয়, সুপ্রিম কোর্টই বলেন, ‘রাকেশকে আমরা জামিন ও তাঁর দণ্ড স্থগিত করেছিলাম বলে তিনি প্রার্থী হতে পারেন না।’ বিচারপতি খায়রুল এই উদাহরণ টেনেই ক্ষান্ত হননি। তিনি বলেছেন, এর অন্যথা করে বাংলাদেশ সংসদ কোনো আইন তৈরি করতে পারে না।
দণ্ডিতের মর্যাদা নিয়ে একমুহূর্তের জন্য মন্ত্রী বা সাংসদ থাকার কোনো যোগ্যতা কারও নেই। যে যত উঁচু পদে থাকুন, এ বিষয়টি কারও সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করা সংবিধানসম্মত নয়। তাই বলি, মায়া মন্ত্রী নন, কারণ তিনি সাংসদ নন। আর হাজি সেলিমের পদও শূন্য হয়ে গেছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.