‘লুটনে যাবো কিভাবে, ঢুকলেই গ্রেপ্তার হবো’ -সিরিয়া থেকে মিনারা by ওয়েছ খছরু

‘মামলা করায় আমরা বিপাকে পড়েছি। এখন লুটনে যাবো কিভাবে। ঢুকলেই পুলিশ গ্রেপ্তার করবে।’-সিরিয়া থেকে টেলিফোনে লন্ডনে থাকা স্বজনদের উপর এভাবে ক্ষোভ জানান আবদুল মান্নানের দ্বিতীয় স্ত্রী মিনারা খানম। দেশে থাকা দেবর আবদুল লতিফের কাছে ফোনে এ কথা জানিয়েছিলেন মিনারা। আর ওই ফোনেই মিনারা জানিয়েছিলেন, তারা তুরস্ক হয়ে সিরিয়াতে চলে গেছেন। এবং দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। পুরুষ ও মহিলা বিভক্ত হয়ে পড়ার কারণে পরবর্তীতে কি করবেন-সে ব্যাপারে তারা দ্রুত সিদ্ধান্তও নিতে পারছেন না। সিরিয়া চলে গেছে যাওয়ার ২০ দিনের মাথায় দেশে থাকা স্বজনদের কাছে একবারই ফোন দিয়েছিলেন সিরিয়ায় থাকা মিনারা খানম। আর এই ফোনে সিরিয়া থেকে কেবল কথা বলেন- আবদুল মান্নানের দ্বিতীয় স্ত্রী মিনারা খানম। তারা ভাল আছেন জানিয়ে দেয়া ফোন কলে মিনারা জানান, লন্ডনে এখন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সুতরাং তারা লন্ডনে গেলেই গ্রেপ্তার হবেন। লুটন শহরে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের লন্ডন প্রবাসী আবদুল মান্নানের বাসা। দ্বিতীয় স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তুরস্ক হয়ে সিরিয়া হয়ে গেছেন। প্রায় দুই মাস হতে চললো পরিবারের ১২ সদস্যই অবস্থান করছেন যুদ্ধের ময়দান সিরিয়াতে। প্রবাসে থাকা স্বজনরা জানিয়েছেন, ১১ই মে আবদুল মান্নানসহ পরিবারের সদস্য বাংলাদেশ থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন। পথিমধ্যে তুরস্কতে ছিল তাদের তিন দিনের যাত্রা বিরতি। তুর্কি এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে তারা তিন দিনের যাত্রা বিরতি করবেন-সেটি দেশে থাকা স্বজনদের জানিয়েছিলেন আগেই। এর ফলে তারা তুরস্কতে তিন দিন অবস্থানের পর নিয়ম মতো ১৪ই মে লন্ডনে গিয়ে পৌঁছার কথা। কিন্তু ১৬ই মে পর্যন্ত তারা লন্ডনে না পৌঁছায় বৃটেনের পুলিশকেও ১৭ই মে প্রথমে বিষয়টি জানান আবদুল মান্নানের সন্তান সেলিম আহমদ। তিনি লুটন পুলিশকে বিষয়টি জানানোর পর পুলিশ তাদের বাসা দফায় দফায় তল্লাশি করে। আর তল্লাশির সময় পুলিশ হেলিকপ্টার দিয়ে বাসার উপরে টহল দেয়। এতে করে আবদুল মান্নানের বাসা নিয়ে ওই এলাকার স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। এরপর তাদের খোঁজ না পাওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী সেলিম আহমদ পিতাসহ পরিবারের সদস্যদের খোঁজ দাবি করে লুটন পুলিশে মামলা করেন। আর এই মামলা করায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন সিরিয়ায় অবস্থানরত মিনারা খানম। দেশে থাকা দেবরের কাছে ফোন করে এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেন। এদিকে, সিরিয়া থেকে ফোন করার খবর লুটন পুলিশের কাছে পৌঁছার পর লুটন মেট্রোপলিটন পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা কয়েক দিন আগে ফোন দিয়েছেন দেশে থাকা আবদুল লতিফ লুলু মিয়াকে। লুটন পুলিশ মূলত তাদের কাছে জানতে চেয়েছিল- সিরিয়া থেকে ফোন করে ওরা কি বলেছে। লুটন পুলিশের প্রশ্নের জবাবে যা যা কথা হয়েছে তা সবই বলেছেন আবদুল লতিফ লুলু মিয়া। এ সময় মামলা করার কারণে তারা যে বেকায়দায় পড়েছে সেটিও জানান তিনি। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাও গ্রামে অবস্থানকারী আবদুল লতিফ লুলু মিয়া সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লুটন মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্মকর্তা তাকে ফোন করেছিলেন। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘মামলা করার কারণে তারা কিছুটা রাগান্বিত। কিন্তু যখন তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না তখন লুটন পুলিশের কাছে মামলা করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। আর মামলা তো করা হয়েছে তাদের সন্ধানের জন্য। আমার অনুমতি নিয়েই ভাতিজা সেলিম লুটনের পুলিশকে বিষয়টি জানায়। ১৭ই মে এই মামলা করা হয়। আর মামলার পর বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে জানাজানি হয়।’ সিরিয়া থাকায় ১২ সদস্যদের সঙ্গে আবদুল লতিফের ছেলে আবুল কাশেম সাকেরও রয়েছে। আবদুল মান্নানের বড় মেয়ে মারিয়া খানমকে বিয়ে করেন আবুল কাশেম। এ কারণে আবদুল লতিফের পরিবারে আরও উদ্বেগ বাড়ছে। তবে, দেশে থাকা স্বজনরা জানিয়েছেন, তাদের উৎকণ্ঠার খবর বিশ্ব মাধ্যমে প্রচার হয়েছে। বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কর্মীরা ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাওয়ে ছুটে গেছেন। তারাও রিপোর্ট করেছেন। এ কারণে তারা কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছেন। দেশে থাকা স্বজনরা জানিয়েছেন, তারা বিভিন্ন মারফতে খবর পেয়েছেন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়া আবদুল মান্নানের পরিবারের সদস্যরা সিরিয়াতে এক হতে চাইছেন। এক সঙ্গে হওয়ার পর তারা ফেরার বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।
গ্রামের বাড়িতে নজরদারি: আইএসে যোগ দেয়া যুক্তরাজ্যের লুটন শহরের ১২ সদস্যের সিলেটী পরিবারের গ্রামের বাড়িতে গোয়েন্দা নজরদারি চলছে। ওই পরিবারের গ্রামের বাড়ি সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও গ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি চলছে। এ ছাড়া সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যরাও নজরদারি করছেন। লুটন শহরের ১২ সদস্যের যে পরিবারটি গত দেড়মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছে তারা হলেন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁওয়ের আবদুল মান্নান (৮২), তার স্ত্রী মিনারা খানম (৫৩), তাদের মেয়ে রাজিয়া খানম (২১), সেইদা খানম (২৭) ও তার স্বামী আবুল কাশেম সাকের (৩১), আবদুল মান্নানের ছেলে মোহাম্মদ জাঈদ হোসেন (২৫), মোহাম্মদ তৌফিক হোসেন (১৯), মোহাম্মদ সালেহ হোসেন (২৬), তার স্ত্রী রোশনারা বেগম (২৪) এবং ওই পরিবারের তিন শিশু সন্তান। গত ১১ই  মে তারা বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশ্যে ফেরার পথে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে তিন দিন যাত্রা বিরতির পর সেখান থেকে তারা উধাও হয়ে যান। পরিবারের সদস্যরা আইএসে যোগ দেয়ার খবরে আবদুল মান্নানের গ্রামের বাড়ি মাইজগাঁওয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। ফেঞ্চুগঞ্জ থানার ওসি নন্দন কান্তি কয়েক দিন আগে আবদুল লতিফের বাড়িতে গেছেন। তিনিও নিজে খোঁজ খবর নিয়ে এসেছেন। তিনি মানবজমিনকে জানান, ওই পরিবারের ১২ সদস্য আইএসে যোগ দেয়ার খবরে গ্রামের বাড়িতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তবে, সেটি আতঙ্কের কিছু নয়।

No comments

Powered by Blogger.