ফেসবুকে অশালীন মন্তব্যের ছড়াছড়ি কেন

ফেসবুকে বা সামাজিক অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে কাউকে হেয়-প্রতিপন্ন করে স্টেটাস বা পোস্ট দেয়ার ঘটনা বাংলাদেশ নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবার জাতীয় দলের একজন ক্রিকেটার নাসির হোসেনের একটি ছবিতে ব্যাপক নেতিবাচক ও রচিহীন মন্তব্যের ঘটনায়, তিনি নিজেই সরিয়ে নিয়েছেন তার পোস্ট করা ছবিটি। ফেসবুকে ক্ষুব্ধ ক্রিকেটার নাসির হোসেনের পোস্ট সেইসাথে স্টেটাস দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, এ ধরনের ফ্যান বা সমর্থক তার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে এমন আচরণ দেখা যায় প্রায়ই। কিন্ত কেন? ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেট সিরিজ শেষে ঢাকা থেকে রংপুর ফিরছিলেন ক্রিকেটার নাসির হোসেন। বিমানের সিটে বসে ছোট বোনের সাথে তোলা একটি সেলফি পোস্ট করেন ফেসবুকে নিজের অফিশিয়াল ফ্যান পেইজে। অনেকটা বোনের অনুরোধেই লাখ লাখ ভক্ত সমর্থকের সাথে ছবিটি শেয়ার করেন নাসির। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই সেই ছবিটি সরিয়ে নিতে বাধ্য হলেন ক্রিকেটার নাসির হোসেন। কারণ ততক্ষণে এই ছবিকে ঘিরে তার ফলোয়ারদের বিভিন্ন রুচিহীন, বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য এবং পোস্টে ছেয়ে গেছে তার ফ্যান পেইজ। এরপর হতাশ জাতীয় দলের এই খেলোয়াড় ফেসবুকে ফ্যানপেইজে আরেকটি স্টেটাস দেন যেখানে তিনি বলেন, এমন সমর্থক বা ফলোয়ার তার প্রয়োজন নেই। স্টেটাসে নাসির লেখেন:“আপনাদের খারাপ মন্তব্য দেখে অনেক কষ্ট পেলাম। আমার ছোট বোনের আবদার মেটাতে তার সাথে আমার ছবি পেজে পোস্ট করেছিলাম। তাই বলে আপনারা অনেকেই বাজে মন্তব্য করেছেন। যেটা নিয়ে অনেকেই ফান পোস্টও করছেন। পোস্টটা ডিলিট করে দিলাম, এখন খুশি তো? আপনাদের মতো ফ্যান আমার দরকার নাই। আমাকে যারা পছন্দ করেন না তারা আমার ছবিতে লাইক দিবেন না। আমাকে ফলো করবেন না। ধন্যবাদ।” ক্রিকেটার নাসির হোসেনের ফ্যান পেইজে মোট লাইক দিয়েছেন ৩৪ লাখ মানুষ। শনিবার পোস্ট করা তার একটি ছবিতে দেখা যায় আড়াই লাখের বেশি লাইক পড়েছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই। কিন্তু ফ্যান পেইজের ফলোয়াড়দের ভূমিকায় তিনি ভীষণ হতাশ। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে বোর্ডের অনুমতি না থাকায় মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি । তবে টেলিফোনে আমাকে বলছিলেন, তার বোন নেতিবাচক বিভিন্ন কমেন্ট পড়ে কান্নাকাটি করেন এবং এরপরে তিনি ছবিটি সরিয়ে নেন। কথা প্রসঙ্গে নাসির হোসেন কেবল একটি প্রশ্নই উচ্চারণ করেন, “আমরা কি বোনের সাথে একটি ছবিও আপলোড করতে পারি না?” খেলায় পরাজয়ের পর ফেসবুকে খেলেয়াড়দের গালাগালি, বিদ্রুপাত্মক পোস্ট তো আছেই। এর বাইরে অন্যান্য অঙ্গণের সেলিব্রেটি বা বিখ্যাত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। কিন্তু প্রায়ই তা গিয়ে ঠেকে গালাগালিতেও। বলছিলেন, সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট আনিসুল হক । তার ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়েছেন আট লাখের বেশি লোক। আবার এই সব সমর্থক বা ফলোয়াড়ের দ্বারাই তাকে অনেক সময় পড়তে হয় বিভিন্ন আক্রমণাত্মক মন্তব্যের মুখে। আনিসুল হক বলেন, “আমার ফেসবুক পেজে সারাক্ষণই বাজে বিভিন্ন কমেন্ট পড়তে থাকে। আমার পেইজের যারা অ্যাডমিন দেখেন তারা এগুলো ডিলিট করতে থাকেন। অনেকসময় এগুলো সাধারণ যে সভ্যতা-ভব্যতা নিয়ম কানুন আচে তার বাইরে চলে যায়। শুধু আমার পাতাই নয় আমি সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল বা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পাতায় গিয়ে দেখেছি, যেকোনো পোস্টের নিচে যে কমেন্টগুলো তাকে তার মধ্যে অনেক অপ্রকাশযোগ্য, অমুদ্রণযোগ্য কমেন্টস থাকে।” তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন আর স্মার্ট ফোনের সহজলভ্যতার কারণে যোগাযোগ মাধ্যমের সাইটগুলো এখন সবার হাতের নাগালে। যারা ফেসুবক ব্যবহার করেন তারা বিষয়টি নিয়ে কি ভাবছেন? ফেসবুক ব্যবহারকার বুয়েটের শিক্ষার্থী বলেন, এটা রুল করে নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি জানি না। কারণ ফেক আইডি তৈরি করে এগুলো করা হচ্ছে। মেয়েদের সাথে এমনটি বেশি করা হচ্ছে। তারকা জগতের লোকজন এমন হয়রানির শিকার বেশি হচ্ছেন। আরেকজন বলছেন এটা যার যার মূল্যবোধের ব্যাপার। একজন নারী বলছেন, এ কারণেই আমি আমার ফেসবুক পেজ শুধু বন্ধুবান্ধব আর বিশ্বস্ত লোকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। অনেকেই বলছেন, সেলিব্রেটি লোকজনেরা যেমন এই ধরনের বিদ্রুপ বা আক্রমণের মুখে পড়ছেন, তেমনি ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণে সাধারণের মাঝেও দেখা যাচ্ছে বুলিং এর সংস্কৃতি। তবে মেয়েরাই এ ধরনের ভার্চুয়াল আক্রমণের শিকার বেশি হন, এমনটাই বলছিলেন এই তরুণ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। কিন্তু বেশিরবভাগ ক্ষেত্রেই যারা ফেসবুক ব্যবহার করছেন তারা তো শিক্ষিত সচেতন নাগরিক। তারপরও এমন আচরণ কেন? লেখক আনিসুল হক বলেন, আপনি যদি উইকিপিডিয়ায় একটি ছবি দিতে যান আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হবে এর কপিরাইট কার? নিশ্চিত না হয়ে কিন্তু তারা ছবি পোস্ট করতে দেবে না। কিন্তু ফেসবুকে এসব নেই। তিনি বলেন, “এই অবাধ ব্যবহারের কারণেই ফেসবুক জনপ্রিয় হয়েছে। এটা তাদের ব্যবসায়িক মুনাফার মূল কারণ । অনেক সভ্য মানুষই নিজেদের ভেতরে অন্ধকার দিকগুলোকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি এখনো। ফলে যখন তারা অনলাইনে একাকী থাকে তখন তাদের ভেতরের অন্ধকার দিকটি বেরিয়ে আসে। তারই প্রকাশ ঘটে এমন সব রুচিহীন, আক্রমণাত্মক বিদ্রুপাত্মক কমেন্ট এর মধ্য দিয়ে। সারা বিশ্বেই এভাবে সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার হচ্ছে।” মানুষের এহেন আচরণ নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া দরকার বলেও মনে করেন আনিসুল হক। ফেসবুকে নজরদারির কোনো ধরনের সুযোগ না থাকায় যে কেউ যে কারও বিরুদ্দে যে কোনও বক্তব্য লিখতে বা পোস্ট করতে পারছে। মুহুর্তে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে হাজারো লাইক আর শেয়ারের মাধ্যমে। কেউ কেউ নিজেদের প্রফাইল বা টাইমলাইন হয়তো সীমাবদ্ধ রাখছেন হাতে গোনা বন্ধু বা পারিবারিক গণ্ডীর মাঝে। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রের নামকরা লোকজনের পক্ষে তেমনটি সম্ভব হয় না। ফলে তাদের এমন আচরণের শিকার হতে হয় প্রায়শই।– বিবিসি

No comments

Powered by Blogger.