মোদির ইসরাইল-প্রেম

এই প্রথম, ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনও প্রস্তাবে ভোট দিল না ভারত। গত বছর, গাজায় ইসরাইলী আগ্রাসন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের (ইউএনএইচআরসি) আনা প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল ভারত। যথারীতি দিল্লির বক্তব্য, ফিলিস্তিনিদের দাবির প্রতি সমর্থনে ভারতের দীর্ঘদিনের অবস্থানের কোনও ‘পরিবর্তন হয়নি’। অন্যদিকে, একে দিল্লির নীতির ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ পরিবর্তন হিসেবেই দেখছে তেল আবিব। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের কর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে সেদেশের দাপুটে পত্রিকা হারেৎজ জানিয়েছে বিস্ফোরক তথ্য, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি ভোটদানে বিরত থাকার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আরজি জানিয়েছিলেন। হারেৎজ ইসরাইলের সবচেয়ে পুরনো ও বনেদি পত্রিকা। নামটাও হিব্রু ভাষায়: হাদাশৎ হারেৎজ। ইসরাইলের ভূখণ্ড। নিউ ইয়র্ক টাইমস যেমন ভূমিকা পালন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, হারেৎজ তেমন ইসরাইলে। পত্রিকার বক্তব্য: ‘ভারতের এই ভোটদানে বিরত থাকা আসলে দিল্লির নীতির তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের প্রতিফলন। জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভারত এতদিন সমস্ত ইসরাইল-বিরোধী প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়ে এসেছে। শুক্রবারের ভোটদানে বিরত থাকা, ২০১৪তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনের পর থেকে ভারত ও ইসরাইলের সম্পর্ক উষ্ণায়নের আরও একটি লক্ষণ।’ স্বাভাবিক। বিজেপি সরকার তার প্রথম এক বছরে পশ্চিম এশিয়ার এই দাগী অপরাধী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করেছে- যারা বেপরোয়া ঢঙে লঙ্ঘন করে চলেছে জাতিসংঘের সনদ। ভারত এখন ইসরাইলী সমরাস্ত্রের বৃহত্তম ক্রেতা। আর এভাবেই ফিলিস্তিনিদের উপর সামরিক হামলার বৃহত্তম আর্থিক মদতদাতা। ইহুদী রাষ্ট্রটিকে খোলাখুলি অলিঙ্গন করে চলেছেন মোদি। ২০০৭ সালে গুজরাট গণহত্যায় তার ভূমিকার জন্য বহু দেশ যখন মোদিকে স্বাগত জানাতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে, তখন ইসরাইলই তাকে জানায় আমন্ত্রণ। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী, এখন সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেওয়ার সময়। ‘পূর্ব জেরুজালেম-সহ ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য দায়দায়িত্ব ও ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত’ করার এই প্রস্তাবটি অবশ্য শুক্রবার গৃহীত হয়েছে। ৪৭-সদস্যের জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে ৪১। ভারত ছাড়াও ভোটদানে বিরত ছিল চারটি দেশ। কেনিয়া, ইথিওপিয়া, প্যারাগুয়ে এবং মেসিডোনিয়া। একমাত্র বিরুদ্ধে ভোট দেয় ইসরাইলের মিত্র দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারত ভোটদানে বিরত থাকলেও, প্রতিবেশী চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ কিন্তু প্রস্তাবের পক্ষেই ভোট দিয়েছে। বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানির মতো ইউরোপীয় দেশগুলিও ভোট দিয়েছে প্রস্তাবের পক্ষে। বিজেপি’র এই ইসরাইল-মুখী অবস্থান আসলে রয়েছে হিন্দু মৌলবাদী শক্তির শিকড়ে। নিজেদের হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নের জন্য ধর্ম-ভিত্তিক ইসরাইলকে তারা দেখে একটি অনুকূল উদাহরণ হিসাবে। জায়নবাদের অর্থ-ও ধর্মীয় উন্মাদনা, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ইসলাম বিদ্বেষ। গত বছর জুলাই-আগস্ট। সাত-সপ্তাহ ধরে গাজায় ইসরাইলী আগ্রাসন। ৫৫০টি শিশুসহ ২২০০ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু। আহত ১১,২৩১। স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে যে ভারত ফিলিস্তিনিদের লড়াইয়ের প্রতি সংহতি জানিয়ে আসছে, এই প্রথম তারা ইসরাইলকে সরাসরি সমালোচনা করতে ব্যর্থ হয়। বিদেশমন্ত্রক বিবৃতিতে ‘সীমান্তপার প্ররোচনা পরিণতি থেকে রকেট হামলা’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। যা অতীতের সরকারি ঘোষণার পুরোপুরি বিপরীত অবস্থান। গাজায় ইসরাইলী হামলার সমালোচনা করে সংসদীয় প্রস্তাব নেওয়া পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করে বিজেপি সরকার। সেকারণেই ভোটদানে বিরত থাকার পর হারেৎজের ব্যাখ্যা: ‘সম্পর্ক উষ্ণায়নের আরও একটি লক্ষণ।’

No comments

Powered by Blogger.