ঈদের বাজারে ‘মোদি’, ‘কিরণমালা’ by ইমরান আহম্মেদ

ঈদের বাজারে ‘মোদি’, ‘কিরণমালা’
‘কিরণমালা’, ‘রাজকুমারী’, ‘ইচ্ছে নদী’, ‘ছুঁয়ে দিলে মন’, ‘জলকন্যা’—এসব বাহারি নাম শুনলে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের বিভিন্ন সিরিয়ালের কথা মনে পড়ে যায়। তবে নামগুলো এখন আর ছোট পর্দায় আটকে নেই। ঈদের পোশাকের গায়ে জুড়ে বসেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এই তালিকা থেকে বাদ যাননি।
রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি বিপণিকেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, এবারের ঈদের বাজারে বেশি চলছে ‘কিরণমালা’ নামের পোশাকটি। পোশাকের এ নামের কারণ জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের ফ্রেন্ডস মার্কেটের নিউ অভি ট্রেডার্সের মালিক সুজিত সাহা বলেন, আসলে প্রতিবছরই ভারতীয় পোশাকগুলোর নতুন নাম দেওয়া হয়। কয়েক বছর আগে ‘মাসাককালি’ নামের পোশাক দিয়ে শুরু হয়। এরপর আসে ‘জিপসি’, তারপর ‘সানি লিওন’; গতবার ছিল ‘পাখি’, এবার ‘কিরণমালা’। ভারতীয় সিরিয়াল ‘কিরণমালা’র নায়িকা এমন নকশার পোশাক পরেন বলে কিরণমালা নাম দেওয়া হতে পা‌রে বলে মনে করেন তিনি। পাশের দোকান মেগা ফেব্রিকসে গিয়ে কিরণমালা আছে কি না—জানতে চাইলে মালিক আবির হোসেন পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আসলটা না দেশিটা? আমার কাছে দুটোই আছে। কোনটা দেখবেন? ’
আবিরের ভাষ্যমতে, আসল কিরণমালা পোশাকে লং ড্রেসের ওপরে থাকে কটি, নিচে ঘের, এরপর ফলস, পেছনে নকশা আর দুই পাশে দুটি ঝুমকা। এ পোশাকের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। তিন থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত।
দেশি কিরণমালার ব্যাপারে আবিরের ভাষ্য, সাধারণত মেয়ে ও শিশুরা এসে কিরণমালা পোশাক চায়। অনেক বিক্রেতাই এ রকম নকশার পোশাক আনতে পারেননি। তাই যেকোনা নকশার পোশাক বের করে তাঁরা বলেন, এটা ‘কিরণমালা’। কোনো পোশাকে পুঁতি বা পাথরের কাজ করা থাকলেই নাম ‘কিরণমালা’। এই নাম না বললে ক্রেতারা নিতে চান না।
নারায়ণগঞ্জের সমবায় মার্কেটের এক বিক্রেতার সহকারী জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘“কিরণমালা” সিরিয়ালের যত পর্ব আমি দেখেছি, এতে কিরণমালাকে আমি তো কখনো এমন লং থ্রিপিস পরতে দেখি নাই। ও তো সব সময় ফতুয়া আর ধুতি পায়জামা পইরা থাকে। তার পরও পোশাকের নাম কিরণমালা যে কেমনে হয়! মেয়েরা আইসাই বলে, কিরণমালা পোশাক দেখান। দেশি কোনো পোশাক দেখাইতে চাইলে উইঠা চইলা যায়। এ জন্য এহন আমাগো দেশি পোশাকও বিভিন্ন ভারতীয় সিরিয়ালের নাম দিয়ে বিক্রি করতে হয়।’
ঢাকার রাজধানী সুপার মার্কেটের মৌ কালেকশনে গিয়ে দেখা যায়, এক সারিতে বেশ কয়েকটি মেয়েদের পোশাক টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। বিচিত্র সব নাম। ‘কিরণমালা’, কোনোটিতে ‘ইচ্ছে নদী’, ‘পামেলা’, ‘জলকন্যা’, ‘পাতালপুরি’, ‘ছুঁয়ে দিলে মন’, ‘রাজকুমারী’ বা ‘বউ কথা কও’—এসব নাম নিয়ে ঝুলছে রকমারি পোশাক। দোকানের বিক্রেতা সুজন বলেন, ‘মেয়েরা এসে এসব নামে পোশাক চায়। এ জন্য ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে কোনটা কী—বলতে না হয়। এসব নাম আমরাই দিয়েছি। ভারতীয় এসব পোশাক কেনার পর আমরাই বিক্রির ধরন দেখে নাম দিই। আবার পরিবতর্নও করি।’
গতবারের ‘পাখি’ পোশাক কেমন চলছে—জানতে চাইলে ওই দোকানের আরেক বিক্রেতা ইমন বলেন, ‘পাখি ব্যাকডেটেড। এবার পাখি চলছে না। তাই নতুন পোশাক “পাখি রিটার্নস”।’
নিউমার্কেটে ছেলেদের পোশাক দেখতে গিয়ে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। ছোট ও কিশোর বয়সী ছেলেদের পোশাকের গায়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে ‘মোদি-১ ’, ‘মোদি-২ ’, ‘মোদি-৩ ’, ‘দাবাং-৩ ’, ‘পাগলু-২ ’। এমন নামকরণ সম্পর্কে ওই দোকানের মালিক আসলাম হোসেন বলেন, ‘পাইকারি কেনার সময় মোদি, পাগলু নামগুলো ক্যাশ মেমোতে লেখা হয়েছে। আর বাকি নামগুলো আমরাই দিয়েছি।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা ছবির নাম না দিয়ে বাংলাদেশের ছবি বা নায়ক-নায়িকার নাম দেওয়া হলো না কেন—এমন প্রশ্নে আসলাম বলেন, ‘মাথা খারাপ! দেশি নাম দেখলে কেউ ছুঁয়েও দেখে না। ভারতীয় এসব নাম দেওয়ায় বেশি দামে বিক্রি করা যায়। ৫০০ টাকার পোশাক এক হাজার টাকায় মানুষ কেনে।’
ঈদের বাজারে ‘মোদি’, ‘কিরণমালা’
নিউমার্কেটে সাবিনা ও হুমায়রা নামের দুই তরুণী ‘কিরণমালা’ পোশাক কিনতে এসেছেন। তাঁরা তিনটি দোকান ঘুরে ওই পোশাকটি দেখেন। কেন ‘কিরণমালা’ কিনবেন—জানতে চাইলে সাবিনা বললেন, ‘অন্য বান্ধবীরা কিনেছে, এ জন্য কিনতে চাই।’
‘কিরণমালা’ পোশাকটি আসলে কেমন? এ প্রশ্নের উত্তরে হুমায়রা বলেন, ‘সেটি ঠিক বলতে পারব না, দোকানিরা তো বললেই দেখায়।’ সেগুলো আবার ভিন্ন ভিন্ন নকশার বলেও জানান তিনি।
রাজধানী সুপার মার্কেটে ছোট মেয়েদের একটি পোশাকের গায়ে ‘পায়রা’ আরেকটিতে ‘ইচ্ছে নদী’ নামের দুটি ট্যাগ লাগানো। বিক্রেতা রাব্বির সরল উক্তি, ‘পায়রা যখন পাখা মেলে, তখন গোল হয়ে যায়, এ পোশাকটি পরলে ছোট মেয়েকে গোল দেখাবে, যা পায়রার মতো।’
ময়ূর পেখম মেললেও তো গোল হয়ে যায়, তাহলে ওটার নাম ময়ূর রাখা হলো না কেন—এ প্রশ্নের জবাবে রাব্বি বলেন, ‘ভালো কথা বলছেন তো। দাঁড়ান, আরেকটার নাম ময়ূর দিতেছি।’
ঈদের পোশাকে ভারতীয় সিরিয়ালের নাম দেওয়ায় বিরক্ত চাঁদনি চক মার্কেটের পোশাক বিক্রতা আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা হলাম হুজুগে বাঙালি। আজাইরা একটা নাম দেছে “কিরণমালা”। দেশি ভালো কাপড় বইলা যতই বুঝান, অ কেউ নেবে না। শুধু বলবেন, ভারতীয় “কিরণমালা”, দেখবেন এক হাজার টাকার জিনিস তিন হাজার টাকায় কিনবে। এমন অবস্থা হইলে মিথ্যা কথা না বইলা আর ব্যবসার উপায় আছে, বলেন?’

No comments

Powered by Blogger.