আরিচা নামের ঘাটটি by রিপন আনসারী

একসময় যানজটে লাখো যাত্রীর চরম ভোগান্তির আরেক নাম ছিল আরিচা ঘাট। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগের একমাত্র অবলম্বন সেই আলোচিত আরিচা ঘাটটি আজ সুনসান। রাতে ফেরির সেই সার্চ লাইটের আলোর ঝলকানি নেই, নেই যাত্রী, হকার ও ফেরিওয়ালাদের হৈ-হুল্লড়। এছাড়া নেই হোটেল ও বোর্ডিংয়ের রমরমা ব্যবসা। বাস-ট্রাকে ভরপুর আরিচা ঘাটের টার্মিনালগুলোতে এখন বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। জনশ্রুতি রয়েছে, ভারত-পাকিস্তান বিভাগের আগে থেকেই যমুনা নদীর পাড়ে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার আরিচা ঘাট ছিল দেশের একটি বড় নৌ-বন্দর। কলকাতা-আসাম রুটের জাহাজ স্টিমার এই ঘাটেই ভিড়তো। এখানে ছিল বড় বড় পাটের গুদাম। এই ঘাটকে ঘিরে আরিচায় গড়ে উঠেছিল জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্র। পাকিস্তান আমলে এই ঘাটের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।
১৯৬৪ সালে ঢাকা-আরিচা সড়ক চালু হওয়ার পর থেকে আরিচা থেকে যমুনা পাড় হয়ে নগরবাড়ী এবং আরিচা থেকে যমুনা-পদ্মা পাড় হয়ে গোয়ালন্দ ঘাটের সঙ্গে চালু করা হয় ফেরি সার্ভিস। সেই সাথে আরিচা-নগরবাড়ী হয়ে উঠে উত্তরবঙ্গ এবং আরিচা-গোয়ালন্দ হয়ে উঠে দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের সড়ক যোগাযোগের অন্যতম প্রধান প্রবেশ পথ।
১৯৬৩ সালে ৩১শে মার্চ কর্ণফুলী নামে একটি ফেরি সার্ভিস দিয়েই আরিচা-দৌলতদিয়া নৌরুটের যাত্রা শুরু হয়। দেশ স্বাধীন হওয়া পর দ্রুত বাড়তে থাকে আরিচা ঘাটের গুরুত্ব। একপর্যায়ে আরিচা ঘাটকে নৌবন্দরের মর্যাদা দেয়া হয়। এই ঘাট দিয়ে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার যানবাহন পারপার হতো। যাতায়াত ছিল গড় ৫০ হাজার মানুষের।
ওই সময় এই আরিচায় গড়ে উঠে বিশাল দুটি ট্রাক টার্মিনাল। এই টার্মিনালের ধারণ ক্ষমতা ছিল এক হাজার ট্রাকের। ধারণক্ষমতার অধিক যানবাহনের চাপে যানজট ছিল নিত্য-দিনের ঘটনা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো যাত্রীদের।
এখানে গড়ে উঠেছিল শতাধিক আবাসিক হোটেল। ঘাটে কুলি ছিল হাজারেও বেশি। সহস্রাধিক ফেরিওয়ালা ও হকারদের কোলাহল ছিল। সব মিলিয়ে আরিচা ঘাটকে ঘিরে প্রায় ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান ছিল।
১৯৯৮ সালে যমুনা সেতু চালু হওয়ার পর আরিচা ঘাটের গুরুত্ব কমে যায়। তার ওপর আরিচা ঘাটের কাছে যমুনা নদীতে নাব্যতা কমে যায়। এর পর সার্বিক দিক বিবেচনা করে ২০০২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আরিচা ফেরি ঘাট নিয়ে যাওয়া হয় পাটুরিয়াতে। সেই সঙ্গে মৃত্যু হয় এক সময়কার প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর আরিচা ঘাটের। শুধু রয়ে যায় কিছু লঞ্চ আর ইঞ্জিন চালিত নৌকা। তার পর থেকেই আরিচা ঘাটে নেমে নিরবতা। বন্ধ হয়ে যায় শ’ শ’ হোটেল-রেস্টুরেন্ট। ধস নেমে আসে বোর্ডিং ব্যবসায়। আর বেকার হয়ে পড়ে শ’ শ’ কুলি। হকাররা বাধ্য হয়ে পাটুরিয়া ঘাটে অবস্থান নেয়। যেখানে এক সময় আরিচা টার্মিনালে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকতো ট্রাকের বহর,এখন সেখানে গরুর খোঁয়াড়।

No comments

Powered by Blogger.