পাহাড়ে আওয়ামী লীগের স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে হবে, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব: ফিরোজা বেগম চিনু by হিমেল চাকমা

"৯০ দশকে পার্বত্যাঞ্চলে আওয়ামী লীগের স্বর্ণযুগ ছিল। সে যুগের কিছুটা ভাটা পড়েছে। আওয়ামী লীগের গৌরবময় রাজনীতি আবারো ফিরিয়ে আনতে হবে। এখানকার ক্ষুদ্র জাতিগুলো একসময় আওয়ামী লীগকে তাদের দল হিসেবে বুঝত। কিন্তু তারা এখন বিএনপি'র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এটি ভাবতে কষ্ট হয়। আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি করেছিল। তখন বিএনপি তীব্র বিরোধীতা করেছিল। চুক্তির বিরুদ্ধে বিএনপি লংমার্চ করেছিল। বিএনপির চুক্তি বিরোধী কার্যক্রম আওয়ামী লীগ পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগুলোকে সাথে নিয়ে মোকাবেলা করেছিল। কিন্তু  এখন সেই গৌরবময় দিনগুলো এখন আর কল্পনা করা যায় না।" সম্প্রতি ঢাকায় সরকারি বাসভবনে মানবকণ্ঠের রাঙামাটি প্রতিনিধি হিমেল চাকমার সঙ্গে একান্ত স্বাক্ষাতে এসব কথা বলেন পার্বত্য এলাকা থেকে একমাত্র সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য বেগম ফিরোজা বেগম চিনু। পাহাড়ে উন্নয়ন, সম্ভাবনা, রাজনীতিসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো বিষয়ে কথা বলেন এই নারী সংসদ সদস্য।
চিনু বলেন, পাহাড়ে স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের মধ্যে কিছু ভুল আর দূরদর্শীতার অভাবের কারণে এর মাসুল দিতে হয়েছে দলকে। স্বাধীনতা পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামে যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তার সবই আওয়ামী লীগ সরকার করেছে। এটি অকপটে সবাই স্বীকার করে। বিএনপি'র জিয়াউর রহমান কী করেছে তা সবার জানা। তিনি পার্বত্যাঞ্চলে মার, কাট টিউরি প্রয়োগ করেছেন। যার মাসুল এখন পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ি-বাঙালী সবাইকে পেতে হচ্ছে। এর আগে পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ি-বাঙালীর যে সম্প্রীতি ছিল তা শেষ করে দিয়েছিল জিয়াউর রহমান। তাই পাহাড়ের মানুষ আওয়ামী লীগ ছাড়া কিছু বোঝে না। কিন্তু  আমাদের দলের দুর্বলতার সুযোগে বিএনপি কিছু রাজনৈতিক সুবিধা নিয়েছে। এখন বিএনপিতে পাহাড়িরাও যুক্ত হচ্ছে। যা আমাদের কারোর কাম্য নয়। বিএনপি ক্ষমতায় আসলে কি হয়? কি হবে? এই এলাকার জন্য কি করেছে? তা সবার জানা।
সংসদ সদস্য হয়ে এলাকা উন্নয়নে ভূমিকা রাখার বিষয়ে চিনু বলেন, পার্বত্য এলাকায় শিক্ষাকে সবার আগে প্রাধান্য দিতে হবে। শিক্ষা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। মেধা প্রাধান্য দিয়ে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। দলপ্রীতি, স্বজন প্রীতি, ঘুষপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দিলে শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে না। এরপরে চিকিৎসা, নারী  কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। কাপ্তাই হ্রদ খনন, পার্বত্যাঞ্চলে কৃষিজদ্রব্য সহজে বাজারজাত করার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। এ জন্য আমি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করে যাচ্ছি।
সমতলে একটি বিদ্যালয় নির্মাণে ২৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হলে পার্বত্যাঞ্চলে তার দ্বিগুণ ব্যয় ধরতে হবে। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্গম হওয়ার কারণে এই ২৫ লাখ টাকা নির্ধারিত জায়গায় পৌছাতে পৌছাতে কাগজে কলমে পাকা ঘরটি বেড়া ঘরে পরিণত হয়। সে জন্য পার্বত্যঞ্চলে এলাকা দেখে বাজেট তৈরির জন্য সরকারের কাছে দাবি রেখে যাচ্ছি।
সুযোগ পেলে জেএসএস প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমাকে তুলোধুনো করেন কেন জানতে চাইলে চিনু বলেন, "আমি ব্যাক্তিগতভাবে সন্তু লারমাকে শ্রদ্ধা করি। মাঝে মাঝে তার কিছু দাবি দেখে আমরা বিভ্রান্ত হই। আমার বক্তব্যগুলো মিডিয়ায় কড়াভাবে উপস্থাপন করা হয়। যা ঠিক নয়। আমার ভুল দেখলে সন্তু আমাকে সমালোচনা করবে। আমি ভুল দেখলে সন্তু লারমার সমালোচনা করব এটাই তো গণতান্ত্রিক আচরণ। ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হয়। আমি  সময় সুযোগ পেলে তার সঙ্গে স্বাক্ষাত করি। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণে আমি সন্তু লারমার বাড়িতে যাই। গত বিজুতেও আমি তার বাড়িতে গিয়েছি। তিনি একজন ভাল নেতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন। পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন করতে হলে তাদের পরামর্শ অবশ্যই দরকার আছে। সব সময় নেতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গিতে দেখা ভাল নয়। পার্বত্য এলাকার শান্তি উন্নয়ন কারোর একার পক্ষে সম্ভব নয়। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা সম্ভব হবে। ব্যাক্তিগতভাবে আমি চিনু একার পক্ষে তা সম্ভব নয়।"
পাহাড়ের নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে চিনু বলেন, "পাহাড়ের নারীরা অন্যান্য অঞ্চলে নারীদের চেয়ে বেশি কর্মঠ। তারা খামার, হস্তশিল্পে বেশ সফলতা দেখিয়েছেন। তাদের সহজশর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। চাকুরীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা দরকার। কিন্তু ২০১৫-১৬ বাজেটে পার্বত্যাঞ্চলে নারীদের উন্নয়নে বিশেষ কোন বাজেট রাখা হয়নি। নারীদের জন্য বিশেষ বরাদ্ধ দেওয়া দরকার।"
কাপ্তাই হ্রদের বিষয়ে চিনু বলেন, "সৃষ্টির পর থেকে কাপ্তাই হ্রদ খনন করা হয়নি। পলি জমে হ্রদ ভরাট হয়ে গেছে। যে  হ্রদ দিয়ে রাঙামাটি সারা বিশ্বে পরিচিত সেই হ্রদের যদি এই অবস্থা হয় তা রাঙামাটিবাসী হিসেবে লজ্জা লাগে।"
হ্রদের তলদেশে পলি জমায় মাছের প্রজনন ক্ষেত্রগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। শুকনো মৌসুমে উপজেলাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। তাই তিনি হ্রদ খননের জন্য সরকারের কাছে বার বার দাবি রেখে যাচ্ছেন বলেও জানান।
ভবিষ্যতে রাঙামাটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচন করার পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে চিনু বলেন, "আমি স্বপ্নও দেখি না। আমি এই পর্যায়ে এসেই সন্তুষ্ট। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে এই অবস্থানে নিয়ে এসেছেন তাই আমি তার কাছে চির কৃতজ্ঞ।"
দীপংকর তালুকদারের সঙ্গে বর্তমানে সম্পর্ক কেমন জানতে চাইলে চিনু বলেন, "দীপংকর দাদার বিকল্প নেই। বলিষ্ট নেতৃত্বে দলকে আকরে ধরে রেখেছেন। দলের রাজনৈতিক কার্যক্রমে চালাতে গিয়ে অতীতে অজান্তে আমাদের কিছু ভুল ত্রুটি হয়েছে। এগুলো সংশোধন করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী দল। গৌরবময় দলটি বর্তমানে দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করছে। আগামীতেও করবে। তাই দলটির উজ্জল ভবিষ্যতের স্বার্থে দলে  শিক্ষিত, অভিজ্ঞদের  প্রাধান্য দিতে হবে।"
পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রের বিষয়ে চিনু বলেন, "অস্ত্র দিয়ে রাজনীতি হয় না। পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র আছে তা স্বীকার করতে হবে। যারা অস্ত্র নিয়ে রাজনীতি করছে এটাকে রাজনীতি বলা যাবে না। বলতে হবে সন্ত্রাসনীতি। যারা অস্ত্র দিয়ে রাজনীতি করছে তাদের স্ব ইচ্ছায় এগুলো ছেড়ে দিয়ে যুক্তিবাদী হতে হবে। পার্বত্য চুক্তির আগে শান্তিবাহিনীরা সুশৃঙ্খল বাহিনী ছিল। তাদের নির্ধারিত লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল। বর্তমানে যারা অস্ত্র ধরছে তাদের চাঁদাবাজি ছাড়া কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য নেই। তারা রাখাল বালক। তারা সমাজ থেকে বিতারিত হওয়ার পর  প্রতিশোধ নিতে অস্ত্র ধরেছে।"
পাহাড়ে আঞ্চলিক রাজনীতি বিষয়ে চিনু বলেন, "আঞ্চলিক বলে বিভক্ত করতে নেই।  সবাইকে জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া দরকার।  আঞ্চলিক রাজনীতি বিভেদ সৃষ্টি করে। দেশটি আমাদের সবার। দেশের উন্নয়ন, দেশের মঙ্গল কামনা করা নাগরিক দায়িত্ব। জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে অধিকার আদায় করে নিতে হবে।"
পাহাড়ে কখন স্থায়ী শান্তি আসবে বলে মনে করেন কি না জানতে চাইলে চিনু বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে শান্তি বিরাজ করে তা দেশে কোথাও নেই।  মাঝে মাঝে কিছু উগ্রবাদী গোষ্ঠী পাহাড়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির অপচেষ্টা করে। তারা কারোর বন্ধু হতে পারে না। এদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এখানে জঙ্গি কার্যক্রম হওয়ার সম্ভাবনা নেই। হলে পাহাড়ি-বাঙালী সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করবে। সেই পরিবেশ বজায় আছে। বৈচিত্রময় এই এলাকার স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। এর জন্য পার্বত্য চুক্তি হয়েছে। সরকার এই চুক্তি  ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করছে। আকাশের চাঁদ চাইলে কেউ পায় না। চুক্তি বাস্তবায়নে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারকে সহযোগীতা করতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হব।"

No comments

Powered by Blogger.