অত্র নিয়ে যত্রতত্র প্রসঙ্গ নিয়ে প্রাসঙ্গিক by রণজিৎ বিশ্বাস

‘অত্র’ নিয়ে শুরু করবো তারপর ‘প্রসঙ্গ’ নিয়ে কথা বলবো। ধীরে ধীরে লতিকার মতো আরো অনেক কথা আসবে। কিছু কিছু বিষয় আছে খুব কৌতুককর।
‘অত্র অফিস’ লিখে কিংবা বলে আপনি বোঝাতে চাচ্ছেন এ অফিস বা এ কার্যালয়। কিন্তু বুঝিয়ে ফেলছেন এখানে অফিস।
‘অত্র অফিসের কাজকর্ম ভালো চলছে না’ অথবা ‘অত্র অফিস রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে’ বলতে কি বুঝাতে চাচ্ছি ও তা কেমন হাস্যকর হচ্ছে অনুমান করার বিষয়।
প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন অফিসে ১৯৮১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত চৌত্রিশ বছর দু’ মাস ছাব্বিশ দিন কাজ করার সময় ভ্রমের বিভিন্ন কণ্টক আমি বড় মনোযোগে সংগ্রহ করেছি, করতে গিয়ে বহুবার স্নায়ুর পরীক্ষা দিয়েছি ও স্থানিক এবং অবস্থানিক সুবিধার কিছু মানুষের কাছে অপ্রিয় হয়েছি। কারো কাছে অনাদৃত ও কারো কাছে সমালোচিত। কৌতুকের সঙ্গে আরো একটি বিষয়ও লক্ষ্য করেছি। এমনটি অবধারিতভাবে ধরে নেয়ার কারণ নেই যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র বাংলায় ভালো, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র তার বিষয়ে চমৎকার।
এর কারণও আমি নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছি। আনন্দের শিক্ষা, শৃঙ্খলার শিক্ষা ও বাধ্যতার শিক্ষা এক রকম নয়। তিনের মধ্যে গুণগত তফাৎ আছে। শিক্ষায় শৃঙ্খলা থাকতেই পারে। কিন্তু তাতে বিকল্পহীন বাধ্যতার জোয়াল চাপিয়ে দিলে তা আনন্দটা কেড়ে নেয় ও শুষে নিয়ে ছোবড়া বানায়। বাধ্যতার শিক্ষা পাস করায়, আনন্দের শিক্ষা জ্ঞান দেয়। সংলাপে সংলাপে আলাপে-আলাপে আড্ডায়-আড্ডায় কথা এগোনোর প্রস্তাবে আগ্রহী এক সহকর্মীকে অবশ্য আগ্রহী লোকের আকাল বড়, একদিন বললাম বলুন না। আপনার প্রয়োজন আমি কতটুকু মেটাতে পারবো জানি না। তবে, আপনার সঙ্গে আমি অংশগ্রহণ করতে পারবো। সে অংশগ্রহণ অনেকক্ষণের জন্যও হতে পারে।
প্রথম বিষয়টা হচ্ছে অত্র অফিস, কেউ কেউ আরো উৎসাহী হয়ে লিখছেন ‘অত্রাফিস’। এগুলো কেমন ব্যবহার?
ভুল ব্যবহার। বেজায় ভুল। মারাত্মক ভুল ও ‘মাল্টিপল’ ভুল। একাধিক ভুল এখানে জড়িয়ে প্যাঁচিয়ে আছে। আছে বড় সোহাগী বন্ধনে। অত্র শব্দটির অর্থ হচ্ছে এখানে অথবা এ স্থানে। এর যত্রতত্র ব্যবহার যে সমীচীন হচ্ছে না, আমাদের কেউ বোঝাতে পারছে না। যাদের এটুকু বোঝার আগ্রহ ও প্রস্তুতি নেই, তাদের জন্য সন্ধিযুক্ত ‘অত্রাফিস’-এর ভ্রমসন্ধান একটি বাড়তি বোঝার মতো। অত্র বঙ্গভাষিক শব্দ, অফিস ইন্দভাষিক; এ দুয়ে সন্ধিবদ্ধ হওয়ার যুক্তি ও চুক্তি নেই, এদের মুক্তি পৃথক পৃথক। সেপারেট-সেপারেট।
ঝাড়া চৌত্রিশ বছর হেলাফেলায় শ্রম শূন্যতায় আর কর্মবিমুখতায় এবং বেতন-বোনাসে-ভোজনে, কখনো কখনো রোদনেবঞ্জনে পার করে দেয়ার পর ৩০ এপ্রিল ’১৫ বিদায় নেয়ার দিনও সহকর্মীদের বলে এলাম সময় বড় জোরে ধায়, এর পাখনা বড় দ্রুত ওড়ায়। সে আজিকে হলো কত কাল/তবু মনে হয় যেন সেদিন সকাল!
মনে তেমন হওয়ারই কথা। সচিবালয়ের কোন টিনশেডের কোন রুমে কেমন টেবিলের সামনে বসে যোগদানপত্রে স্বাক্ষর করলাম, ভাষিক শুদ্ধতায় সামান্য আগ্রহের জন্য কোন কোন কার কার বকা খেলাম, সবই মনে আছে সব যতিচিহ্নসহ।
প্রথম বকাটি যার কাছে খেলাম, তিনি পরে আমাকে ভালোও বেসেছিলেন। একটা সময় এলোগেলো, ঘণ্টার আধা চলে যায় কিন্তু কথা তার হারায় না, কথা তার ফুরায় না। খুব ভালো ছাত্র ছিলেন, রাজশাহী বোর্ড থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছিলেন, প্রথম তিনের মধ্যে নাম ছিল। পরে ঢাকা থেকে ইকোনমিক্সে অনার্স-মাস্টার্স। স্মৃতির জোর ছিল সাংঘাতিক। আইনকানুন ও দাফতরিক অনেক বিষয়ে তিনি ছিলেন ‘চলাতফিরতি’ এক জ্ঞানকোষ। এখন অজানালোকের বাসিন্দা তিনি।
তাকে বোঝাতে গিয়ে বারবার আমি উচ্চ সাফল্যে ব্যর্থ হয়েছি কেন চিঠিপত্রের বিষয়ের ঘরে ‘প্রসঙ্গ’ শব্দটি বসবে না। ‘অর্কের বিদেশগণ প্রসঙ্গে’ ‘ঊশ্রীর মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রসঙ্গে’, ‘যুদ্ধাপরাধীদের যথাপ্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়া প্রসঙ্গে’ ‘মানবতাবিরোধীদের হুঙ্কার হিস্রতা ও কেলানো দাতের আস্ফালন প্রসঙ্গে’ এ জাতীয় গঠনের বাক্য কেন বিষয় হিসেবে আসবে না, কাউকে কাউকে এখন বয়স, অভিজ্ঞতা ও পরিবর্তিত বর্ণের চুলের আশ্রয়ে বোঝাতে পারি, তখন একেবারেই পারতাম না। নরম নরম ভয়ে ভয়ে কিন্তু মজবুত মজবুত যুক্তিতে বলেছি বিষয় হচ্ছে মানুষের নামের মতো, নামবাচক বিশেষ্যর মতো, প্রপার নাউন’-এর মতো। তাই বিষয়গুলোর অবয়ব হবে ‘অমুকের বেতন ভাতা’, ‘তমুকের শাস্তি বিধান’ ও ‘সমুকের পুরস্কার’ জাতীয়।
‘প্রসঙ্গ’ হচ্ছে বিষয়, ‘প্রসঙ্গ’ হচ্ছে কোনো কিছু সম্পর্কে। এ কারণেই বিষয়ের সঙ্গে ‘প্রসঙ্গে’ নামের নেজটি যুক্ত হবে না। কোনো রকম একটি সমঝোতা কিংবা আপসরফা হতে পারে এ-কার বাদ দিয়ে। প্রসঙ্গ শব্দটি যেভাবেই হোক ব্যবহার না করলে যদি কারো পেটের ভাত চাল হয়ে যায়, তিনি লিখতে পারেন ‘অমুকের বেতন ভাতা প্রসঙ্গ’ জাতীয় কিছু। নিরুপায় হয়ে কমপ্রোমাইজ ফর্মুলা মেনে নেয়ার মতো।
আমার যুক্তিবর্ম, বিশেষ প্রকৃতির শ্রমজীবনের প্রথম সপ্তাহে, অগ্রবর্তী ওই মেধাবী সহকর্মীর সামনে কোনো কাজ করেনি। বারবার তা ভোঁতা হয়ে ফিরে এসেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে এক দুষ্পাচ্য ও যুক্তিরহিত বক্তব্য। ‘এসব তোমার সাহিত্যের ভাষা নয়। যা দিয়েছি, তাই যাবে, তাই থাকবে, সাহিত্য সব জায়গায় চলে না।’
সাহিত্যের সঙ্গে আমার ছোটখাটো হার্দিক সম্পর্কের কথা ওই ক’দিনেই তিনি জেনে গিয়েছিলেন পাক’-এ গুরু এমন কঠিন মন্তব্য। আমি যতবার বুঝতে গেছি, ততবারই হয়রান হয়েছি এখানে সাহিত্যের অপরাধটা কোথায়! বুঝতে পারিনি সাহিত্যের ভাষা ও দাফতরিক ভাষার সঙ্গে শুদ্ধতার বিরোধ এবং অসহযোগটা কোন জায়গায়? পারি না, এখনো বুঝতে পারি না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও রম্য লেখক

No comments

Powered by Blogger.