অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি, চাপ ও অপূর্ণাঙ্গ তথ্য সংকটের কারণ by শরিফুজ্জামান ও মোশতাক আহমেদ

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ধানমন্ডি কলেজের ঠিকানা দেওয়া আছে ধানমন্ডির ৪ নম্বর সড়কের ২৯ নম্বর বাড়ি। ওই ঠিকানায় গতকাল রোববার গিয়ে দেখা যায়, কোনো কলেজ নেই, আরবান গ্যালাক্সি নামের একটি বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে। ভবনের দারোয়ান মানিক বললেন, তিনি তিন বছর ধরে এখানে চাকরি করছেন। এ সময় ওই নামে কোনো কলেজের কার্যক্রম দেখেননি। তবে গত কয়েক দিন কয়েকজন শিক্ষার্থী এসে কলেজের খোঁজ নিয়ে না পেয়ে ফিরে গেছে।
অথচ এই কলেজের নামে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ১০৬ জন শিক্ষার্থীকে মনোনীত করেছে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। এই কলেজের পক্ষে ভর্তির কার্যক্রম চলছে ৭৮ গ্রিন রোডে ‘থ্রি ডক্টরস’ নামের কোচিং সেন্টারে। সেখানে গেলে ওই কলেজের শিক্ষক পরিচয় দেওয়া এম ই এইচ মামুন হায়দার মজুমদার বললেন, গতকাল (রোববার) পর্যন্ত ১৪ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। মোবাইল ফোন নম্বর নিয়ে এই কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল মজিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তাঁরা চাননি, তবু বোর্ড শিক্ষার্থী দিয়েছে। এখন কলেজের জন্য বাড়ি খুঁজছেন।
ঢাকা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক আশফাকুস সালেহীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ রকম তো হওয়ার কথা নয়, বিষয়টি দেখছি।’ এদিকে ঢাকা বোর্ডের সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট মঞ্জুরুল কবীর বললেন, এ পর্যন্ত ধানমন্ডি কলেজে ১১ জনের ভর্তির তথ্য বোর্ড পেয়েছে।
একাদশ শ্রেণিতে প্রথমবারের মতো পছন্দক্রম দিয়ে অনলাইনে ভর্তির ক্ষেত্রে হয়েছে এই ভুল। এ ছাড়া আরও নানা ভুলভ্রান্তি, অব্যবস্থাপনায় ভোগান্তি পোহাচ্ছে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শিক্ষা বোর্ডগুলোর অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি, বোর্ডগুলোতে থাকা কলেজগুলো সম্পর্কে অপূর্ণাঙ্গ তথ্য, ১ জুলাই থেকে ক্লাস শুরুর চাপের কারণে তাড়াহুড়ো করে মনোনীতদের তালিকা প্রকাশের কারণে এমন সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, প্রথমে ৩০০ শিক্ষার্থী রয়েছে—এমন কলেজে অনলাইনে ভর্তির সিদ্ধান্ত হলেও শেষ মুহূর্তে মন্ত্রণালয় পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই সব কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির কার্যক্রম অনলাইনেই শুরু করে। কিন্তু ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শকের কার্যালয়ে কলেজের আসন, শাখা, অস্তিত্ব ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য ছিল না। এ ছাড়া কারিগরি সহায়তা দেওয়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কম্পিউটার টেকনোলজির (আইআইসিটি) এই বিপুল শিক্ষার্থীর ভর্তি কার্যক্রম এত অল্প সময়ে শেষ করার মতো সক্ষমতা ছিল না। এ জন্য মনোনীতদের তালিকা প্রকাশে চারবার সময় পেছাতে হয়। পরে অবশ্য বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষক এই কর্মযজ্ঞে অংশ নিয়ে কাজে গতি আনেন। ভর্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্ধতি নতুন হওয়ায় শিক্ষার্থীরাও আবেদনে প্রচুর ভুল করে।
গতকাল সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও বলেন, ‘কম ঢাল-তলোয়ার নিয়ে বড় যুদ্ধে নেমেছি। প্রযুক্তিগত ক্ষমতা ও দক্ষতার সীমাবদ্ধতায় এই বিশাল কর্মকাণ্ডে কিছু ত্রুটি হয়েছে।’ তিনি এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ভবিষ্যতে আরও সতর্ক থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
শিক্ষা বোর্ডগুলোর বিভিন্ন সূত্র বলছে, ঢাকাসহ প্রায় সব বোর্ডে কলেজগুলোর হালনাগাদ তথ্য না থাকার দৈন্য অনলাইন ভর্তি সম্পন্ন করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে। কলেজের কাছাকাছি নাম, একই কলেজের ভিন্ন ভিন্ন শাখা, একাধিক পালা, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম এবং সহশিক্ষার বিষয়গুলো সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ঘাটতি ভুল-ভ্রান্তির কারণ।
মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সারা দেশে কলেজ স্তরে প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আবেদন করেছে ১১ লাখ ৫৬ হাজার ২৫৩ জন ছাত্রছাত্রী। গতকাল পর্যন্ত ৯ লাখ ২৩ হাজার ১০৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি সম্পন্ন করেছে। বাকি প্রায় ২ লাখ ৩৩ হাজার ছাত্রছাত্রী এখনো অপেক্ষায় আছে। এদের মধ্যে ৬২ হাজার ৮৫০ জন প্রথম মেধাতালিকায় কোনো কলেজেই মনোনীত হয়নি। এদের মধ্য থেকে আজ সোমবার দ্বিতীয় মেধাতালিকা প্রকাশ করা হবে।
শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের অনেকেই বলছেন, ভুলের কারণে তাঁরা হয়রানির পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতিরও সম্মুখীন হবেন। কারণ, পছন্দ না হলেও প্রথমে মনোনীত কলেজে ভর্তি হতে হয়েছে। এরপর কলেজ পরিবর্তনের আবেদন করতে হয়েছে। এখন দ্বিতীয় কলেজেও ভর্তির টাকা দিতে হবে। অবশ্য মন্ত্রণালয় বলছে, প্রথম কলেজ থেকে শিক্ষার্থী টাকা ফেরত পাবে।
চার দফা পিছিয়ে গত ২৮ জুন মধ্যরাতে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য মনোনীতদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু ভুলভ্রান্তি হওয়ায় এ নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে ক্ষোভ ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। ভর্তি-বাণিজ্য ও কোচিং-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত একটি চক্র এবং শিক্ষা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রকাশ্যে না হলেও পরোক্ষভাবে অনলাইন ভর্তির বিপক্ষে ছিল। এঁরাও শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছেন।
ক্যান্টনমেন্ট, আইডিয়াল ও মডেল কলেজ নিয়ে বিভ্রান্তি: দেশে বেশ কয়েকটি ক্যান্টনমেন্ট কলেজ রয়েছে। কিন্তু ভর্তি-ইচ্ছুকদের অনেকেই ক্যান্টনমেন্ট কলেজ পছন্দ দিলেও কোন কলেজে ভর্তি হতে চায়, তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেনি। এ কারণে চট্টগ্রামের ক্যান্টনমেন্ট কলেজে যে ভর্তি হতে চায়, সে মনোনীত হয়েছে যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে।
ঢাকা শহরে ২৪টি কলেজের নামের সঙ্গে ‘আইডিয়াল’ শব্দটি রয়েছে। একইভাবে নামের সঙ্গে ‘মডেল’ শব্দ রয়েছে বেশ কয়েকটি কলেজে। আবার অনেক কলেজে প্রভাতি ও দিবা শাখা রয়েছে। এসব কারণেও বিভ্রান্তি হয়েছে।
ঢাকার কালাচাঁদপুর কলেজ ও নারায়ণগঞ্জে মেয়েদের একটি কলেজে কয়েকজন ছেলেকে ভর্তির জন্য মনোনীত করা হয়েছে। গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষক মো. ওয়াছেল আলী এসেছিলেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে জুবায়ের আহমেদ গত ৩০ জুন ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়। কিন্তু শনিবার খুদে বার্তায় তাদের জানানো হয়, শিক্ষা কোটায় জুবায়ের মনোনীত হয়েছে। কিন্তু এই কোটা তাকে দেওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্য কলেজ বলছে, সে যেন কাগজপত্র নিয়ে যায়।
ওয়াছেল আলী বলেন, ‘আমরা তো কোটার জন্য আবেদনই করিনি। অথচ বোর্ড কোটায় মনোনীত করে। এখন ছেলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে।’
কেউবা যে কলেজে ভর্তির জন্য আবেদনই করেনি, সেই কলেজে তাকে ভর্তি হতে বলা হয়েছে। কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন না করলেও তাকে মনোনীত করা হয়েছে সেই কোটায়। কিশোরগঞ্জের জামাল উদ্দিন বকশীবাজারে ঢাকা বোর্ডের কার্যালয়ে এসেছেন বোনের সমস্যা নিয়ে। তিনি জানান, তাঁর বোন মুক্তিযোদ্ধা কোটার না হলেও তাকে এই কোটায় মনোনীত করায় এখন কলেজ ভর্তি নিচ্ছে না।
এ রকম নানা সমস্যা নিয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থী-অভিভাবক আসছেন ঢাকা বোর্ডে। অনেকে লিখিত আবেদন দিচ্ছেন, অনেকে মৌখিকভাবে করণীয় জেনে যাচ্ছেন। রামপুরা থেকে আসা এক ছাত্রীর মা ফেরদৌসি ইসলাম বললেন, দারোয়ানকে ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে কলেজ পরিদর্শক শাখায় একজন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে।
বিজ্ঞান কলেজে বাণিজ্যের শিক্ষার্থী: রাজধানীর সরকারি বিজ্ঞান কলেজ শুধু বিজ্ঞান শাখায় ১ হাজার ২০০ আসনের চাহিদা দিয়েছিল। কিন্তু তালিকা প্রকাশের পর দেখা যায়, এই কলেজে ২০১ জন শিক্ষার্থীকে ব্যবসায় শিক্ষা শাখার জন্য মনোনীত করা হয়েছে। এ জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষও প্রথমে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে রাজি হয়নি। ‘শিক্ষক দেওয়া হবে’ এমন আশ্বাসে সরকারি এই কলেজটি সরকারি আদেশ মেনে বাণিজ্যে ভর্তি করাতে রাজি হয়েছে। শনিবার প্রথম দফায় ভর্তির শেষ দিনে ওই কলেজে গিয়ে জানা যায়, ব্যবসায় শিক্ষায় ভর্তি হয়েছে ৯৫ শিক্ষার্থী। কলেজের অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষক দিলে সংকট থাকবে না।
ছিল গুজব ও গুঞ্জন: জিপিএ-৫ পাওয়া প্রায় সব শিক্ষার্থীর লক্ষ্য ছিল সেরা কলেজে ভর্তি হওয়া। এ জন্য তারা শুধু পাঁচটি ভালো কলেজে ভর্তির পছন্দক্রম দিয়েছে। কিন্তু আসনস্বল্পতায় স্বাভাবিকভাবেই সবার ভর্তির সুযোগ মেলেনি। ফলে তারা বেশি উদ্বিগ্ন হয়। একই সঙ্গে গুজব-গুঞ্জনও বাড়ে।
এ বছর সারা দেশে জিপিএ-৫ পেয়েছে প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার ছাত্রছাত্রী। কিন্তু তাদের সবাই যেসব ভালো কলেজে ভর্তি হতে চায়, সেগুলোর আসন বড়জোর ১৫ হাজার। অভিযোগ রয়েছে, কেউ কেউ ভালো ফল করেও ভালো কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়নি, কিন্তু তুলনামূলকভাবে খারাপ ফল করেও কেউ কেউ ভালো কলেজে ভর্তি হয়েছে।
শেষ মুহূর্তে এ কাজে যুক্ত হওয়া বুয়েটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ প্রথম আলোকে বলেন, ভর্তি-ইচ্ছুক অনেকেই সঠিক তথ্য না দেওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন কারণে সঠিক তথ্য না পাওয়ায় নির্ভুল ফল প্রকাশ করা যায়নি।
মন্ত্রী-সচিব মতবিরোধ: ভর্তির বিষয়কে কেন্দ্র করে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খানের মতবিরোধ অনেকটাই প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। যদিও গতকাল তাঁরা একসঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করে কলেজ ভর্তি নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
‘নিয়মটি ভালো’: কয়েক বছর ধরে বোর্ডগুলো খুদে বার্তায় ভর্তি সম্পন্ন করছে। তখন ভর্তি-ইচ্ছুকদের মেধাতালিকা তৈরি করে তা সংশ্লিষ্ট কলেজে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু এবার একজন শিক্ষার্থীকে তার এসএসসির ফল বিবেচনা করে একটি কলেজেই ভর্তির জন্য মনোনীত করা হয়।
অধ্যাপক কায়কোবাদ বলেন, পদ্ধতি হিসেবে অনলাইনে ভর্তির নতুন নিয়মটি ভালো। এবারের অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যতে এই পদ্ধতি সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা গেলে শিক্ষার্থীরা হয়রানি ও আর্থিক ক্ষতি থেকে রেহাই পাবে।
শিক্ষামন্ত্রী বললেন, ‘উন্নয়নের বেদনা’: গতকাল সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ভর্তি নিয়ে শিক্ষার্থীরা যে সমস্যায় পড়েছে, সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এই সমস্যা ‘উন্নয়নের বেদনা’। তিনি বলেন, এই সমস্যার কারণে কোনো শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। সবাই ভর্তি হতে পারবে। বিলম্ব ফি ছাড়া আগামী ২১ দিন পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা কলেজে ভর্তি হতে পারবে। ছুটি শেষে পরবর্তী ক্লাস যখন শুরু হবে তখন আর সমস্যা থাকবে না।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষাসচিবও বক্তব্য দেন।

No comments

Powered by Blogger.