কোকেন কাণ্ড: চট্টগ্রামে ল্যাটিন আমেরিকার একাধিক কনটেইনার নজরদারিতে by মহিউদ্দীন জুয়েল

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা একাধিক কনটেইনার নজরদারিতে আনা হচ্ছে। তরল কোকেনসহ একাধিক মাদক থাকার আশঙ্কায় পরীক্ষার জন্য গঠন করা হয়েছে পোর্ট কন্ট্রোল ইউনিটও। বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চিলি, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, প্যারাগুয়ে, পেরু, উরুগুয়ে, ভেনেজুয়েলাসহ ওই অঞ্চলের একাধিক দেশ থেকে প্রতিদিন আসছে প্রচুর সংখ্যক পণ্যবাহী কনটেইনার।
দেশগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে কোকেন ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠায় চট্টগ্রাম বন্দরকে তাই রুট হিসেবে ব্যবহার করার খবরে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশেও। বন্দর ও কাস্টমসের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এমনি তথ্য।
কাস্টমস সূত্র জানায়, তরল কোকেনের মতো নিষিদ্ধ কেমিক্যাল মাদক সরাসরি শনাক্ত করার কোন মেশিন নেই! ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে কনটেইনারগুলোকে নিয়ে যাওয়া হয় পরীক্ষার জন্য। কিন্তু সেখানেও অত্যাধুনিক যন্ত্রের অভাবে ধরা পড়ে না ভোজ্যতেলে মাদক থাকার মতো কোন ঘটনা।
তরল মাদক ও চোরাচালান ঠেকাতে তাই কর্তৃপক্ষ গত ২০ বছরে এই প্রথমবারের মতো রিস্ক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমকে ঢেলে সাজানোর কথা জানিয়েছে। গতকাল এ বিষয়ে কথা বলতে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে গেলে মাদক শনাক্তের বিষয়ে পাওয়া যায় নানা তথ্য।
ধারণা করা হচ্ছে, বেশির ভাগ চালান ধরা পড়ার পর তা প্রথমে নজরে আসে কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তাদের। কিন্তু পরীক্ষার জন্য কোন মেশিন না থাকায় অনেক সময় সেগুলো পার পেয়ে যাচ্ছে। সানফ্লাওয়ার তেল ঘোষণা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসা ১০৭টি কনটেইনারের একটিতে গত ২৭শে জুন তরল কোকেনের অস্তিত্ব মিলে। ঢাকার বিসিএসআইআর ও বাংলাদেশ ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে পাঠানোর পর তারা কোকেন থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
অথচ এর আগে গত ৮ই জুন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও নৌবাহিনীর ল্যাবের প্রাথমিক পরীক্ষায় কোন তরল কোকেন না থাকার কথা জানিয়েছিলেন কর্মকর্তারা! কাস্টমস ও বন্দরের পরীক্ষাগারে এই ধরনের কোন যন্ত্রপাতি না থাকায় ঘটনাটি ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে তরল কোকেন ধরা পড়ার পর অনেকটা নড়েচড়ে বসেছে কর্তৃপক্ষ। তাই মাদক শনাক্তের জন্য বিশেষ করে তরল কোকেনের মতো চোরাচালান ঠেকাতে তাই জাতিসংঘের কাছে বিশেষ ডিটেক্টরের জন্য আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
তারা আরও জানান, জাতিসংঘের ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম কর্তৃপক্ষ এর আগে মাদক নিরুপণের জন্য কাস্টমস কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিলেও তাতে কোন কাজ হচ্ছে না। কেননা ডিটেক্টরের অভাবে কোনভাবেই ধরা যাচ্ছে না ভোজ্যতেল আমদানির আড়ালে আসলে কি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারো পণ্যবাহী কনটেইনার আসার পর সেগুলো রেনডম সিলেকশন ও রিস্ক ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতিতে ঝুকিপূর্ণ মনে হলে কায়িক পরীক্ষা করা হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে গোপন সংবাদই শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ভরসা।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে কথা হয় চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার হোসেন আহমেদের সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো থেকে যেসব কনটেইনার আসবে সেগুলো বিশেষ নজরদারিতে আনা হয়েছে। এর কারণ সেখানে তরল মাদক সরবরাহের ঝুঁকি রয়েছে। আমরা এ নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে কথা বলেছি। যেহেতু একটি ঘটনা ধরা পড়েছে। তাই হালকাভাবে দেখা হচ্ছে পুরো বিষয়টি।
তিনি আরও বলেন, পোর্ট কন্ট্রোল ইউনিট এই বিষয়ে কাজ করবে। তারা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলেই তা পরীক্ষা করতে পারবেন। কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ হচ্ছে। তবে এই ক্ষেত্রে আমি মনে করি আরো উন্নত প্রযুক্তি কিংবা যন্ত্রপাতি থাকলে চালান ধরার কাজটি আরও সহজ হতো বলে আমি মনে করি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার গোপন তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দরে ভোজ্যতেলের আড়ালে কোকেন পাচারের ঘটনা ফাঁস হয়। এর আগে চালানটি ছাড়িয়ে নিতে আমদানিকারক খান জাহান আলী লিমিটেডকে জানানো হলে প্রতিষ্ঠানটির মালিক নূর মোহাম্মদ এর কোন দায়ভার নিতে রাজি হননি। তখন তিনি বলেছিলেন তার প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙিয়ে কেউ এই কাজটি করেছে।
এতে সন্দেহ আরও বাড়ে। শেষমেশ চালানটির রপ্তানিকারক বলিভিয়ার সান্তা ক্রুজ কোম্পানি থেকে খাতুনগঞ্জের নবী মার্কেটের খান জাহান আলীর প্যাড ব্যবহার করে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সোহেল সান ফ্লাওয়ার তেলের চালানটি আমদানি করেন বলে নিশ্চিত হন পুলিশ।
যদিও তখন সেখানে থাকা ১০৭টি ড্রাম থেকে নমুনা সংগ্রহ করে প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েও কোকেন পাওয়া যায়নি বলে জানানো হয়েছিল। পরে সেগুলো ঢাকায় পাঠানোর পর একটি ড্রামে থাকার বিষয়টি ধরা পড়ে।
বর্তমান বাজার দর অনুসারে প্রতি কেজি কোকেনের দাম ৫০ কোটি টাকা। সেই হিসেবে ড্রামে থাকা এক-তৃতীয়াংশ কোকেনের পরিমাণ পড়ছে প্রায় ৬১ কেজি। যার মূল্য ৩ হাজার কোটি টাকা।

No comments

Powered by Blogger.