মুড়ি ফোটার শব্দে জীবনের ছন্দ by মজিবর রহমান

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার মহব্বতনগর গ্রামে সনাতন
পদ্ধতিতে মুড়ি ভাজছেন দুই কারিগর। l প্রথম আলো
ঠাকুরগাঁওয়ের গিলাবাড়ী ও মহব্বতপুর গ্রাম। গ্রামের মানুষেরা কেউ লাকড়ি কুড়াচ্ছেন, কেউ মুড়ির জন্য শুকাচ্ছেন চাল। কেউবা মাটির খোলায় চাল গরম করছেন। গরম বালুর স্পর্শে তা মুড়মুড় করে ফুটে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু মুড়ি।
এ যেন মুড়িরই গ্রাম। মুড়ি ফোটার শব্দে যেন জীবনের ছন্দ আনে।
সারা বছর খুব একটা খোঁজখবর না থাকলেও রোজার মাসে মুড়ি ছাড়া চলেই না। শহর থেকে গ্রাম, ফুটপাত থেকে অভিজাত হোটেল—সবখানে ইফতারির তালিকার অপরিহার্য পণ্য এই মুড়ি।
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে গিলাবাড়ী ও মহব্বতপুর গ্রাম। জীবন-জীবিকার তাগিদে এ দুই গ্রামের লোকজন মুড়ি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। নারীরা মুড়ি তৈরির জন্য চাল শুকানো থেকে ভাজার কাজ করে থাকেন। আর পুরুষেরা সেসব বিক্রি করতে নিয়ে যান বাজারে। সনাতন পদ্ধতিতে হাতে মুড়ি ভেজে গিলাবাড়ী ও মহব্বতপুর গ্রামের প্রায় ৭০টি পরিবার সংসার চালাচ্ছে। এ দুই গ্রামের মতোই মালিগাঁ, বাকুন্দা, জামালপুর, হরিহরপুর, মোহাম্মদপুর, রায়পুর গ্রামের অনেক নারী-পুরুষের জীবিকা হয়ে উঠেছে হাতে মুড়ি ভেজে বিক্রি করা।
দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি মুড়ি ভাজা ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত আছেন হরেন গণেশ। মহব্বতপুরের এই প্রবীণ ব্যক্তি জানালেন, সারা বছরই এ গ্রামে মুড়ি ভাজার কাজ চলে। তবে রমজান মাস এলে চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। তাই এ সময় পরিবারের সবাই মিলেই নেমে পড়তে হয় এ কাজে।
গিলাবাড়ী গ্রামের মুড়ি ব্যবসায়ী অনিতা রানী বলেন, রমজানে হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা অনেক। কিন্তু পুঁজির অভাবে ঠিকমতো মুড়ি সরবরাহ করতে পারছেন না। হরিহরপুরের শোভা রানী জানান, ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত মুড়ি ভেজে বিকেলে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। এ টাকা দিয়েই চলে সংসারের খরচ। ছেলে-মেয়েরাও স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে।
শুক্রবার গ্রামগুলোতে গেলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কথাও জানালেন কেউ কেউ। হরিনারায়ণপুর গ্রামের রঞ্জনা বালা বলেন, গ্রামের যাঁদের পুঁজি নেই, তাঁরা অনেকে মহাজনদের সঙ্গে মুড়ি ভেজে দেওয়ার চুক্তি নেন। এ ক্ষেত্রে মহাজনেরা শুধু চাল, লবণ জোগান দেন। বাকি সব উপকরণ গ্রামবাসীকেই দিতে হয়। প্রতি কেজি মুড়ি ভাজার জন্য তাঁরা পান ১০ টাকা। আর মহাজনেরা সেসব মুড়ি বিক্রি করেন প্রতি কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা।
সনাতনী প্রক্রিয়ায় মুড়ি ভাজা সম্পর্কে মহব্বতপুরের ধামো বালা বলেন, মুড়ির চাল পানিতে ধুয়ে ধুলাবালি পরিষ্কার করতে হয়। এরপর পরিমাণমতো লবণ মিশিয়ে রোদে শুকানোর পর ভাজতে হয়। গরম বালুর ভেতর চাল ঢেলে নাড়তে থাকলে চাল ফুটে মুড়ি তৈরি হয়। পরে বালু আলাদা করলেই পাওয়া যায় সুস্বাদু মুড়ি। এক মণ ধানে ১৯-২০ কেজি মুড়ি পাওয়া যায়।
বাকুন্দা গ্রামের মুড়ি ব্যবসায়ী জসদা রানী বলেন, বাজারে বড় ও ধবধবে সাদা মুড়ির চাহিদা বেশি। তাই অনেক কারিগর লবণের বদলে চালে ইউরিয়া সার ও হাইড্রোজ মিশিয়ে মুড়ি ভাজছেন। ইউরিয়া ও হাইড্রোজ সরবরাহ করছেন মুড়ি ব্যবসায়ীরা। ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে হাতে ভাজা মুড়ির আসল স্বাদ। এ ছাড়া, কারখানায় যেসব মুড়ি উৎপাদন করা হয়, তারও বেশির ভাগ ইউরিয়া ও হাইড্রোজ মিশিয়ে করা হয়।
সতর্কতা: দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান বিকাশ চন্দ্র সরকার বলেন, বর্তমানে বাজারে যেসব ধবধবে সাদা ও ফোলানো মুড়ি পাওয়া যায়, তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। মুড়িতে মেশানো রাসায়নিক পদার্থ কোনোভাবেই হজম হয় না। সেগুলো অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট, শরীর ফুলে যাওয়াসহ কিডনির রোগের সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

No comments

Powered by Blogger.