মুজাহিদের ফাঁসি বহাল

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল এবং সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে তাকে দেয়া ট্রাইব্যুনালের সাজা বহাল রেখে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ গতকাল এ রায় দেয়। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা ছিলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। রায়ের প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামী আজ সকাল ৬টা থেকে আগামীকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিয়েছে।
এই প্রথম যুদ্ধাপরাধের কোন মামলায় আপিল বিভাগের বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে রায় দিলো। এর আগে তিনটি মামলার রায়ই ঘোষণা করা হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে। গতকাল রায় ঘোষণার পরপরই আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমি মনে করি এ মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ ছিল না। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পেলেই রিভিউ আবেদন দায়ের করা হবে। অন্যদিকে, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এ রায়ে বাংলাদেশের সবাই খুশি হবে।
নিয়ম অনুযায়ী, রায় কার্যকরের জন্য এখন রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। রায়ের কপি পাওয়ার পর আসামিপক্ষ ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন দায়ের করতে পারবে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তির পর রায় বহাল থাকলে আসামিকে প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য যৌক্তিক সময় দেয়া হবে। ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি নিষ্পত্তির পরই রায় কার্যকর হবে। অ্যাটর্নি জেনারেল অবশ্য বলেছেন, রায়ের কপি পাওয়ার পরপরই রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। আসামি রিভিউ আবেদন দায়ের করলে ওই কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যাবে।
২০১৩ সালের ১৭ই জুলাই মুজাহিদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল। একই বছর ১১ই আগস্ট ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন তিনি। গত ২৯শে এপ্রিল থেকে আপিলের শুনানি শুরু হয়। নয় কার্যদিবসে শুনানি শেষ হয়। আসামিপক্ষে এসএম শাহজাহান ছাড়াও সিনিয়র অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন শুনানি করেন। তাদের সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট শিশির মুহাম্মদ মুনির। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের মামলায় দেখা যায়, প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণের পর হত্যা এবং ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবীসহ গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। একই রায় এসেছিল সপ্তম অভিযোগে, ফরিদপুরের বকচর গ্রামে হিন্দু সমপ্রদায়ের ওপর হামলা চালিয়ে হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায়। আপিল বিভাগের রায়ে প্রথম অভিযোগের ক্ষেত্রে আসামির আপিল মঞ্জুর করে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। সপ্তম অভিযোগে তার সাজা কমিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখে মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আপিল বিভাগ।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ৩০শে আগস্ট রাত ৮টায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি মুজাহিদ, ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী ঢাকার নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলের আর্মি ক্যাম্পে যান। সেখানে তারা আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাদের গালাগাল করেন। একপর্যায়ে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে বলেন যে, প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। মুজাহিদ অন্যদের সহায়তায় আটকদের একজনকে ছাড়া অন্য বন্দিদের অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করেন এবং তাদের লাশ গুম করেন। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। আপিল বিভাগের রায়ে সেই সাজাই বহাল আছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে তৃতীয় অভিযোগে ফরিদপুর শহরের খাবাসপুরের রণজিৎ নাথকে অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় মুজাহিদকে। আপিল বিভাগও ওই সাজা বহাল রেখেছে। দ্বিতীয় অভিযোগে ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে হিন্দু গ্রামে গণহত্যা এবং চতুর্থ অভিযোগে আলফাডাঙ্গার আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলেও তাতে মুজাহিদের সংশ্লিষ্টতা প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে না পারায় ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে খালাস দিয়েছিল।
এখন পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি মামলায় রায় ঘোষণা করেছেন আপিল বিভাগ। এর মধ্যে আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং আবদুল কাদের মোল্লার। আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় ভোগ করছেন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। মৃত্যুর কারণে আপিল পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় গোলাম আযম ও আবদুল আলিমের মামলায়।
হিটলারের সঙ্গে এদের তফাৎ নেই: অ্যাটর্নি জেনারেল
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেছেন, মুজাহিদের ফাঁসির রায় এসেছে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে। এই রায়ে বাংলাদেশের সবাই খুশি হবে। বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে যে ক্ষতি করেছে, তা এক শতাব্দীতেও পূরণ হওয়ার নয়। হিটলারের যে হিংস্রতা আর এদের হিংস্রতার কোন তফাৎ আমি দেখি না। নিজ কার্যালয়ে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, এক শতাব্দীতে এরকম বুদ্ধিজীবী তৈরি হবে না। তবে এটুকু সান্ত্বনা বিচার পাওয়া গেলো। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আজ আমি শর্ট অর্ডার চাইনি। আগেরবার চেয়েছিলাম, দেয়া হয়নি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই আজ চাইনি। আশা করছি শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ রায় পেয়ে যাবো।
আমরা ন্যায় বিচার পাইনি: মুজাহিদের ছেলে
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন দায়ের করা হবে বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি বলেছেন, রায়ের কপি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই রিভিউ আবেদন দায়ের করা হবে। এদিকে, আপিল বিভাগের দেয়া রায়ে ন্যায় বিচার পাননি বলে জানিয়েছেন আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, যেহেতু ট্রাইব্যুনালে আমরা ন্যায়বিচার পাইনি, সেহেতু ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছিলাম। কিন্তু এখানেও ন্যায় বিচার পাইনি। আমরা সংক্ষুব্ধ। এখন আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে, সেখানে কাকে হত্যা করা হয়েছে তা অভিযোগে নেই। কোন ভিকটিম পরিবারের সদস্য এসে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়নি। এ অভিযোগে কিভাবে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলো তা আমার কাছে মিসট্রেরিয়াস।
আপিলেও ন্যায়বিচার পাইনি: মুজাহিদ পুত্র
আপিল বিভাগের দেয়া রায়ে ন্যায় বিচার পাননি বলে অভিযোগ করেছেন আলী আহসান মুজাহিদের পুত্র আলী আহমেদ মাবরুর। ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগের দেয়া রায়ের প্রতিক্রিয়ার মুজাহিদ পুত্র বলেন, যেহেতু  ট্রাইব্যুনালে আমরা ন্যায়বিচার পাইনি, সেহেতু ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম  কোর্টে আপিল করেছিলাম। কিন্তু এখানেও ন্যায়বিচার পাইনি। আমরা সংক্ষুব্ধ। এখন আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো। তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে, সেখানে কাকে হত্যা করা হয়েছে তা অভিযোগে নেই। কোন ভিকটিম পরিবারের সদস্য এসে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেননি। এ অভিযোগে কিভাবে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলো তা আমার কাছে মিসট্রেরিয়াস (রহস্যময়)। এদিকে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহালের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা মহানগরীর রমনা জামায়াত কর্মীরা মগবাজার চৌরাস্তায় বিক্ষোভ করে। মহানগরীর মজলিসে শূরা সদস্য আ.জ.ম কামাল উদ্দিন ও ড. আহসান হাবিবের নেতৃত্বে বিক্ষোভে উপস্থিত ছিলেন- রমনা থানা জামায়াতের সেক্রেটারি জিল্লুর রহমান, বনানী সেক্রেটারি সাইফুল ইসলাম, জামায়াত নেতা ইউসুফ আলী, আতাউর রহমান সরকার, শিবির নেতা জামিল মাহমুদ, আশরাফ উদ্দিন প্রমুখ।
জামায়াতের হরতাল আজ
আজ সকাল ৬টা থেকে আগামীকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত টানা ২৪ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী। গতকাল মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ আপিল বিভাগে বহাল রাখার ঘটনায় হরতালের ডাক দেন জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ। এক বিবৃতিতে মকবুল আহমাদ দাবি করেন, ‘সরকার জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও কাল্পনিক অভিযোগে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করে বিচারের নামে প্রহসনের আয়োজন করছে। সরকারি ষড়যন্ত্রের শিকার আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। তার আপসহীন নেতৃত্বে দিশাহারা হয়ে সরকার তাকে হত্যার উদ্দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের মিথ্যা অভিযোগে মামলা দায়ের করে। আপিল বিভাগের এ রায়ে মুজাহিদ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। দেশের জনগণ এ রায়ে হতাশ।’ জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর বলেন, ‘সরকারের দায়ের করা মামলাটি সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রমূলক। এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত মুজাহিদের বিরুদ্ধে ফরিদপুর জেলসহ বাংলাদেশের কোন থানায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত কোন অপরাধের জন্য মামলা হয়েছে- এমন কোন তথ্য তিনি পাননি। মামলার আইও এটাও স্বীকার করেছেন, মুজাহিদ আল বদর, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল শামস বা এ ধরনের কোন সহযোগী বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন- এমন কোন তথ্য তিনি তার তদন্তকালে পাননি। এরপরও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে সরকারের সাজানো মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। তিনি জুলুমের শিকার হয়েছেন।’ মকবুল আহমাদ বলেন, ‘আলী আহসান মুজাহিদ এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করবেন। রিভিউ আবেদনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হলে তিনি খালাস পাবেন বলে আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করি।’

No comments

Powered by Blogger.