পাকুন্দিয়ার তিন গ্রামে আতঙ্ক by আশরাফুল ইসলাম

অজ্ঞান করে স্বর্ণালঙ্কারসহ মালামাল লুটের
সময় এলাকাবাসীর হাতে ধরা পড়ে দুই সদস্য
ভয়ংকর খেলায় পর্যুুদস্ত পাকুন্দিয়ার তিন গ্রামের মানুষ। দস্যুচক্রের হানায় তছনছ এসব গ্রামের মানুষের স্বাভাবিক জীবন। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার গ্রহণেও গ্রামবাসীর মাঝে কাজ করছে চরম আতঙ্ক। অভিনব কায়দায় ঘরের রান্না করা খাবারে চেতনানাশক উপাদান মিশিয়ে দস্যুচক্র লুটে নিচ্ছে সর্বস্ব। অনেকের বিপন্ন হচ্ছে জীবন ও স্বাস্থ্য। উপজেলার খালিশাখালী, কাওয়ালীকান্দা ও ঠুটিরজঙ্গল এই তিন গ্রামে এভাবেই একের পর এক পরিবার খুঁইয়েছে নগদ টাকা-পয়সাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। চেতনানাশক মিশিয়ে পরিবারের সব সদস্যকে অজ্ঞান করে গত দুই বছর ধরে প্রায় নিয়মিত ভাবেই ঘটছে এমন দস্যুতার ঘটনা। তারপরও থামছে না এ মরণখেলা। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরও এখন পর্যন্ত ধরা পড়েনি চক্রের হোতা বা কোন সহযোগী।
পারিবারিক প্রয়োজনে একখণ্ড জমি কেনার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ টাকা জমাচ্ছিলেন কাওয়ালীকান্দা গ্রামের কৃষক আবদুল হাই খান। এরপরও প্রয়োজনীয় টাকার সংস্থান করতে না পেরে জমি বন্ধক দিয়ে ২ লাখ টাকা জোগাড় করেন তিনি। নিরাপদ স্থান মনে করে সেই টাকা ঘরের টেবিলের বক্সে রেখে তালা দিয়ে দেন। এ ঘটনা গত ৩০শে মে সকালের। কিন্তু ওইদিন রাতেই ঘটে এক অদ্ভুত ঘটনা। রাত ৮টার দিকে খাবার খাওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যেই একে একে ঘুমের কোলে ঢলে পড়েন পরিবারের ৩ সদস্যের সবাই। রাত দেড়টার দিকে আবদুল হাই খানের ঘরে তালা ভাঙার শব্দে প্রতিবেশী এক স্বজনের ঘুম ভাঙলে তিনি ওই বাড়ির দরজায় ৪-৫ জন অজ্ঞাত ব্যক্তির অবস্থান টের পান। এ সময় তার ডাকচিৎকারে অন্য প্রতিবেশীরাও এগিয়ে আসলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। তবে এর আগেই তারা লুটে নেয় টেবিলের বক্সে রাখা ২ লাখ টাকা। ঘরে তখনও বেহুঁশ বৃদ্ধ আবদুল হাই খান (৬৫), তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম (৫৬) ও ছেলে জিল্লুর রহমান (৩০)। তাদের চেতনাহীন অবস্থা বুঝতে পেরে প্রতিবেশীরা উদ্ধার করে পার্শ্ববর্তী হোসেনপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে দু’দিন চিকিৎসার পর জ্ঞান ফিরে তাদের। কেবল আবদুল হাই খানের পরিবারই নয় স্থানীয় দস্যু চক্রের এমন ভয়ংকর উৎপাতে কাওয়ালীকান্দা গ্রাম ছাড়াও খালিশাখালী ও ঠুটিরজঙ্গল গ্রামেরও প্রায় প্রতিটি পরিবারই অতিষ্ঠ। একই কায়দায় কাওয়ালীকান্দা গ্রামের আতাহার মিয়ার পরিবারের ৬ সদস্য, সুরুজ মিয়ার পরিবারের ৩ সদস্য, মুসলেহ উদ্দিনের পরিবারের ৩ সদস্য, আবদুল খালেকের পরিবারের ৩ সদস্য, বোরহান মিয়ার পরিবারের ৩ সদস্যের সবাইকে ঘরের রান্না করা খাবারে চেতনানাশক উপাদান মিশিয়ে অজ্ঞানের পর সেসব পরিবারের মূল্যবান সামগ্রী ও নগদ টাকা লুটে নিয়েছে দস্যুচক্র। এছাড়া খালিশাখালী গ্রামের ৩ সদস্যের আবুবক্করের পরিবার, ৫ সদস্যের মজলু মিয়ার পরিবার, ৬ সদস্যের মানিক মিয়ার পরিবার, ৫ সদস্যের ফারুক মিয়ার পরিবার ও ৪ সদস্যের বকুলা আক্তারের পরিবার এবং ঠুটিরজঙ্গল গ্রামের ২ সদস্যের গফুর মিয়ার পরিবার, ৪ সদস্যের হাফিজ উদ্দিনের পরিবার, ৪ সদস্যের কামাল মিয়ার পরিবার ও ৪ সদস্যের আলামিনের পরিবার একই রকম লুটের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। কাওয়ালীকান্দা গ্রামের আবদুল হাই খান জানান, তাদের গ্রামের মৃত ফজলুর রহমানের ছেলে খোকন এই অজ্ঞান চক্রের হোতা। খোকনের সহযোগীরা গ্রামের মানুষের বাড়িতে রান্না করার সময় খাবারে চেতনানাশক ওষুধ মেশাতে কৌশলে ওত পেতে থাকে। সুযোগ বুঝে তারা যে বাড়ির খাবারে সে ওষুধ মেশাতে পারে, সে বাড়ির সর্বনাশ আর কেউ ঠেকাতে পারে না। এরকম ভাবে চক্রটি নিজগ্রামসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে ভয়ংকর এ অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে অজ্ঞান চক্রের সদস্যদের দ্বারা পরিবারগুলো আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও অনেকের জীবন ও স্বাস্থ্য বিপন্ন হচ্ছে। আবদুল হাই খান আরও জানান, তার পরিবার আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরই তিনি প্রতিকার চেয়ে পাকুন্দিয়া থানায় অভিযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। পরবর্তীতে পুলিশ সুপারের নিকট আবেদন করেও অদ্যাবধি কোন প্রতিকার পাননি বলে তিনি মন্তব্য করেন। এদিকে জেলা শহরের চরশোলাকিয়া এলাকায় দস্যুচক্রের কয়েক সদস্য বাসা ভাড়া নিয়ে একই কায়দায় দস্যুতা করে আসছিল। সোমবার রাতের খাবারে একই বাসার ভাড়াটিয়া ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন দয়ালের পরিবারের রান্না করা খাবারে চেতনানাশক মিশালে তা খেয়ে পরিবারের চার সদস্যই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে কৌশলে দরজা খুলে স্বর্ণালঙ্কার ও ২টি মোবাইল সেট লুট করে পালানোর সময় রাত ৩টার দিকে স্থানীয়দের হাতে চক্রের লিজা (১৯) নামে এক নারী সদস্য ও হেলাল মিয়া (৪০) নামে এক সহযোগী ধরা পড়ে। তবে এ সময় কৌশলে চক্রের অন্যতম সক্রিয় সদস্য সোহেল পালিয়ে যায়। পরে তাদের পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
আটককৃতদের মধ্যে হেলাল মিয়া সদরের রঘুনন্দপুর গ্রামের মৃত হাফিজ উদ্দিনের ছেলে এবং লিজা উত্তর বৌলাই রাজকুন্তি গ্রামের সোহেলের স্ত্রী। এ ব্যাপারে থানায় দেলোয়ার হোসেন দয়াল বাদী হয়ে মামলা করেছেন বলে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মীর মোশারফ হোসেন জানিয়েছেন।
এর আগে ১৪ই জুন রাতে কিশোরগঞ্জে নিজাম উদ্দিন (১৭) নামে এক চালককে অজ্ঞান করে তার অটোরিকশা ছিনতাই করে নিয়ে যায় অজ্ঞান চক্রের সদস্যরা। জেলা শহরের গাইটাল এলাকা থেকে শহরতলীর লতিবাবাদ এলাকায় যাওয়ার জন্য নিজামের অটোরিকশা ভাড়া করে অজ্ঞান চক্রের ৪/৫ সদস্য। পথে অটোচালক নিজামকে তাদের সঙ্গে থাকা কলা ও রুটি খাওয়ায়। কলা ও রুটি খেয়ে নিজাম লতিবাবাদ ইউপি সংলগ্ন এলাকায় অজ্ঞান হয়ে পড়লে তার অটোরিকশাটি ছিনতাই করে নিয়ে যায় সংঘবদ্ধ চক্রটি। পরে রাস্তা থেকে অজ্ঞান অবস্থায় করিমগঞ্জ উপজেলার গাংগাইল গ্রামের বাসিন্দা নিজামকে পথচারীরা উদ্ধার করে জেলা হাসপাতালে ভর্তি করে।
এ ব্যাপারে পাকুন্দিয়া থানার ওসি হাসান আল মামুন জানান, অজ্ঞান চক্রের হোতা হিসেবে খোকনকে শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সে পলাতক রয়েছে। পুলিশ তাকে ধরতে চেষ্টা করে যাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.