যৌন সহিংসতা, ‘ভারতকন্যা’র আয়নায় by কুর্‌রাতুল–আইন–তাহমিনা

দিল্লির গণধর্ষণের এক ঘটনাকে ঘিরে বিবিসির সহপ্রযোজনায় তথ্যচিত্র নির্মাণ এবং ভারতে সেটা নিষিদ্ধ হওয়া, এসব নিয়ে লিখছি। মনে হচ্ছে, ঢাকায় পয়লা বৈশাখে গণ যৌন হয়রানি, মাইক্রোবাসে আদিবাসী মেয়েটির ধর্ষণের শিকার হওয়ার মতো ঘটনাগুলোর কথাই লিখে চলেছি। অনেকগুলো প্রশ্ন, ক্রোধ আর বিষাদ বুদ্ধিকে আউলে দিচ্ছে।
১...
লন্ডননিবাসী চলচ্চিত্রকার লেসলি আডউইনের ইন্ডিয়া’স ডটার দিল্লির ‘নির্ভয়া’ গণধর্ষণ ও হত্যার পুরো বিভীষিকা মাথার মধ্যে ভরে দেয়। আরও অনেক অনেক ঘটনার ছায়া উঠে আসে। বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে।
তথ্যচিত্রটিতে ওই ঘটনার দায়ে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া এক আসামির খোলামেলা সাক্ষাত্কার রয়েছে। মার্চের গোড়ায় ছবির প্রচারপর্বে সেটা প্রকাশিত হলে ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার টনকটি নড়ে ওঠে। তবে দিল্লির হাকিমের নিষেধাজ্ঞা ভিনদেশে ছবিটার বৈধ সম্প্রচার তো বটেই, এমনকি ভারতেও এটার ‘অবৈধ’ দেখা ঠেকাতে পারেনি। ছবিটা প্রথম দেখায় বিবিসি যুক্তরাজ্যে, ৪ মার্চ। তারপর ইউটিউবসহ ভিডিও ভাগাভাগির সাইটগুলোতে কর্তৃপক্ষের নিবারণী তত্পরতার সঙ্গে ইঁদুর-বিড়াল খেলতে খেলতে এ তথ্যচিত্র ছড়িয়ে পড়ে।
আডউইন ঘটনাটি ধরে ধর্ষণের কারণ ও মানসিকতার খোঁজ করেছেন। ঘটনাটির প্রতিবাদে বিস্ফোরিত জনবিক্ষোভের গতিপথে তিনি আশার দিশা খুঁজেছেন। কিছু অতিসরলীকরণ সত্ত্বেও ছবিটা সত্যকে দেখায়।
এ তথ্যচিত্রের পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা ও বাক্-স্বাধীনতার প্রশ্ন সেটাকে গুলিয়ে তুলেছে। তর্ক-বিতর্কগুলো মূল বিষয়ের জটিলতাকেই দেখায়। বিষাদ গভীর হয়। বিষাদ, ‘নির্ভয়া’দের জন্য। বিষাদ, জগেজাড়া বাস্তবতা নিয়ে।
২...
দক্ষিণ দিল্লিতে ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যারাতে এক পুরুষবন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরতে বাসে উঠেছিলেন ফিজিওথেরাপির ইন্টার্ন মেয়েটি। বাসে ছিলেন চালক ও তাঁর ভাই-বন্ধু-সহকারী মিলে মোট ছয়জন, একজন তখনো অপ্রাপ্তবয়স্ক। চলন্ত বাসে বন্ধুটিকে গণমার মেরে তাঁরা মেয়েটিকে ক্ষতবিক্ষত করে ধর্ষণ করেন। হাত আর লৌহদণ্ড দিয়ে মেয়েটির অন্ত্র টেনে বের করেন। তারপর দুজনকেই রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেন। ১৩ দিনের মাথায় সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে মেয়েটি মারা যান।
ঘটনার পরপরই দিল্লিতে জনবিক্ষোভ শুরু হয়, চলে মাসাধিককাল। ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য শহরেও। সরকার বাধ্য হয় যৌন নিপীড়ন-সংক্রন্ত আইন খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিতে। চার মাসের মধ্যে আইন কঠোর হয়।
অন্যদিকে, অভিযুক্ত ছয়জন দ্রুত গ্রেপ্তার হন। বছর ঘোরার আগেই নিম্ন আদালত ঘটনাটিকে বিরলের মধ্যে বিরলতম বলে বাসচালক মুকেশ সিংসহ চারজনকে ফাঁসির দণ্ড দেন। দিল্লির হাইকোর্ট রায়টি বহাল রাখেন। এখন সর্বোচ্চ আদালতে এঁদের আপিল শুনানির অপেক্ষায় আছে। মুকেশের ভাইটি আগেই জেলের ভেতরে কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, আত্মহত্যা করেছিলেন। অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেটিকে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড তিন বছরের জন্য সংশোধনকেন্দ্রে পাঠান। ডিসেম্বরে সে বেরিয়ে আসবে।
আডউইনের ছবির অনেকটা জুড়ে আছে দিল্লির তিহার জেলে বাসচালক মুকেশের সাক্ষাত্কার। তিনি চেনা সাফাই গেয়েছেন, ‘তালি বাজাতে দুহাত লাগে। শরিফ মেয়ে হলে রাত নয়টায় ঘুরে বেড়াত না। ধর্ষণের জন্য ছেলের চেয়ে মেয়ে বেশি দায়ী।’
মুকেশ বলেছেন, ছেলেমেয়ে সমান নয়; নারীর স্থান ঘরে। অথচ নারীরা রাতেবেরাতে স্বল্প বসনে ডিসকো-বারে ঘুরছে, ‘গলত’ কাজ করছে। শতেকে ২০ জন হয়তো ভালো।
আলাদা সাক্ষাত্কারে জেহাদি জোশে একই বোল তুলেছেন আসামিপক্ষের দুই উকিল। গা গুলিয়ে বমি পায়।
উকিল এম এল শর্মা বলেছেন, ‘মেয়ে ঠিক ফুলের মতো—দেখতে সুন্দর, ভারি কোমল, সুখকর একটা বিষয়। অন্যদিকে, পুরুষ হচ্ছে ঠিক কাঁটার মতো। বলবান, শক্তপোক্ত। ফুলের চাই সুরক্ষা। নর্দমায় ফেললে ফুল নষ্ট হবে, মন্দিরে রাখলে পূজিত হবে।’
উকিলজুটি রায় দিয়েছেন, ‘আমাদের সমাজে সন্ধ্যার পর মেয়েদের ঘরের বাইরে বেরোনোর অনুমতি নেই, বিশেষত বেগানা পুরুষের সঙ্গে। শর্মাজি বলেছেন, মেয়েকে রাস্তায় খাদ্যের মতো ফেলে রাখতে নেই। মেয়েরা হীরার চেয়েও দামি —‘যদি তুমি তোমার হীরা রাস্তায় ফেলে রাখো, অতি অবশ্যই সেটা কুকুরে (?!) নিয়ে নেবে।’
শর্মাজির আরেক রায়, আমাদের সংস্কৃতিতে ছেলে-মেয়ের বন্ধুত্ব অচল—‘মেয়ে মানেই ছেলের চোখে যৌনচিন্তা জাগাবে। আমাদের হচ্ছে সেরা সংস্কৃতি। আমাদের সংস্কৃতিতে নারীর কোনো স্থান নেই।’
এসব কথা কি নতুন বা বিরল? এই বাংলাদেশে হেফাজতের বৃদ্ধ আমির বলেছিলেন, মেয়েছেলেরা তেঁতুলের মতো, পুরুষের জিবে পানি আনবেই। ঢাকায় পুলিশের বড় কর্তা সেদিন যৌনহয়রানিকে বললেন ছেলেদের ‘দুষ্টামি’।
ঢাকাতেই ১৯৯৯ সালে ইংরেজি নববর্ষের রাতে রাজপথে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন যে মেয়েটি, তখনকার সরকারদলীয় সাংসদ জয়নাল হাজারী তাঁর সাজা চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অত রাতে রাস্তায় বেরিয়ে মেয়েটিই দোষ করেছেন। সম্প্রতি মাইক্রোবাসে আদিবাসী মেয়েটির গণধর্ষণের শিকার হওযার ঘটনায় তিনি স্বেচ্ছায় গাড়িতে উঠেছিলেন কি না, তা আলোচিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন মাধ্যম ভাইস নিউজে এক তথ্যচিত্রে দেখি, ছাতকের এক পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, মেয়েরা পর্দা করলে ধর্ষণ ঘটে না।
ইন্টারনেট ঘাঁটলে মাথা ঝিমঝিম করে। লক্ষ্মণরেখা টেনে, যৌন সহিংসতার জন্য নারীকেই দায়ী করে, সহিংসতাকে অস্বীকার করে, পুরুষোচিত লঘু স্খলন বলে বাণী দিয়েছেন বড় বড় লোকেরা। দেশে দেশে।
২০১২ সালে কলকাতায় সুজেট জর্ডনের গণধর্ষণের পর অশ্লীল কটাক্ষ করেছিলেন ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রী, অধুনা জেলবাসী মদন মিত্র। সুজেটকে যৌনকর্মী বলেছিলেন তৃণমূলেরই সাংসদ কাকলী ঘোষ দস্তিদার। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ঘটনাটা সাজানো। (১৯ জুন ২০১৩, এনডিটিভি)
পাশ্চাত্যে ‘ডেট রেপ’ বা ছেলেবন্ধুর হাতে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে নাক-সিঁটকানি ব্যাপক। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে সাবেক কংগ্রেস সদস্য রিপাবলিকান টড আকিন টিভি সাক্ষাত্কারে গর্ভপাতবিরোধিতার যুক্তি হিসেবে বলেছিলেন, ধর্ষণ বৈধ হলে নারীর শরীর গর্ভধারণ ঠেকিয়ে দেয়। (১৯ আগস্ট ২০১২, নিউ ইয়র্ক টাইমস)
‘বৈধ ধর্ষণ’, ‘নারী ধর্ষণযোগ্য’ অথবা ‘ধর্ষণযোগ্য নারী’, এমনকি শিশু?
ইনডিয়া’স ডটার নিয়ে বিতর্কের সূচনাকালে একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডশায়ারে সংঘবদ্ধ সহিংস শিশু যৌন শোষণের ব্যাপকতার ওপর আলো ফেলে। দেখা যায়, পুলিশ ও সমাজসেবা কর্মীরা ভেবেছেন, ১১ বছরের মেয়েও নিজের ইচ্ছায় ধর্ষিত হয়েছে। এই শিশুদের ‘বেয়াড়া’ ও ‘অকালপক্ব’ ধরে নিয়ে তাঁরা তাদের দুষেছেন, নির্যাতনের কথা বিশ্বাস করেননি। (৩ মার্চ, বিবিসি ও গার্ডিয়ান)
গত বছর যুক্তরাজ্যের রদারহ্যাম শহরে এমন প্রবণতার ওপর একই ধারার তথ্য দিয়েছিল একটি তদন্ত প্রতিবেদন (২৬ আগস্ট ২০১৪, বিবিসি ও গার্ডিয়ান)। সমস্যাটি আরও বিস্তৃত ও জটিল, তবে ঘটনাগুলো ১৫-১৬ বছর ধরে চলার পেছনে রক্ষা কর্মকর্তাদের মনোভাবকে বড় কারণ বলা হয়েছে।
৩...
বাংলাদেশে আজও সমাজপতিদের সালিসে ধর্ষণের শিকার নারীকে ‘জেনা’র দায়ে দোর্রা মারা হয়। ধর্ষকের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক খোঁজা হয়। ২০১১ সালে শরীয়তপুরের কিশোরী হেনার হত্যা এভাবেই ঘটেছিল। ঘটে আত্মহত্যা।
এ.পি. সিং ইনডিয়া’স ডটার-এ আবির্ভূত দ্বিতীয় উকিল। ছবিটায় মক্কেলদের ফাঁসির রায় ঘোষণার পরপর টিভিকে দেওয়া তাঁর সাক্ষাত্কারের ক্লিপ দেখি। সেখানে তিনি বলেছিলেন, তাঁর মেয়ে বা বোন বিয়ের আগে কোনো সম্পর্কে জড়ালে অথবা চাল-চরিত্র খারাপ করলে তিনি পুরো পরিবারের সামনে তাকে পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়ার সাহস রাখেন। ছবিতে সাক্ষাত্কারে জোর গলায় তিনি বলেন, আজও এটাই তাঁর ‘স্ট্যান্ড’।
মুকেশ বলেছেন, ‘নির্ভয়া’র ক্ষেত্রে ধর্ষণ মুখ্য ছিল না। ‘অ্যাক্সিডেন্টাল’ যা ঘটেছে, সেটা সবক শেখানোর অধিকারে করা হয়েছে। ছেলেতে মেয়েতে ‘এত রাতে’ ঘুরবে কেন? উদ্দেশ্য ছিল, ‘ওর সাথে গলত কাজ করব, কাপড় খুলে দেব’, ওরা লজ্জায় কাউকে বলবে না। ‘আকল মিলেগি’—শিক্ষা হবে।
মুকেশের মতে, মেয়েটির উচিত ছিল চুপচাপ নিজেকে ধর্ষিত হতে দেওয়া। তা হলে মরতে হতো না। (ইংরেজি প্রবাদটি মনে পড়ে যায়—ধর্ষণ যদি ঠেকাতে না পারো, তবে বরং উপভোগই কর।)
মুকেশ বলছেন, তাঁদের ফাঁসি মেয়েদের বিপদ বাড়াবে। এখন কেউ ধর্ষণ করলে মেয়েটিকে সোজা মেরে ফেলবে। ‘আগে যারা রেপ করত, বলত ছেড়ে দেই, কাউকে বলব না।’ এই ভয় দেখানোর মধ্যে কিন্তু তাঁর নিজের ভয়টাই ফুটে ওঠে। সামাজিক লজ্জা ভেঙে ধর্ষণের কথা প্রকাশ পেলে ধর্ষকের শাস্তির ভয়।
৪...
ভারতের সরকার মুকেশের সাক্ষাত্কার দেখেই ছবিটা ঠেকাতে উঠেপড়ে লাগে। পুলিশের তুরন্ত ফরিয়াদের ভিত্তিতে দিল্লির এক হাকিমি আদালত সাক্ষাত্কারটির সব রকম প্রকাশ নিষেধ করেন জনরোষ ও আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের আশঙ্কার যুক্তিতে। পুলিশ আরও বলেছিল, মুুকেশের বক্তব্য নারীর জন্য অবমাননাকর, এটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করবে।
ছবিটা নারী দিবসে ভারতের এনডিটিভিতে দেখানোর কথা ছিল। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় প্রাইভেট চ্যানেলগুলোকে আইনের ভয় দেখিয়ে ‘পরামর্শ’ পাঠায়। তাতে আরও বলা হয়, সাক্ষাত্কারটি নারীর প্রতি সহিংসতাকে উসকে দেবে। তা ছাড়া, দণ্ডিতদের আপিল বিচারাধীন থাকায় এর প্রচার আইনি প্রক্রিয়াকে বাধা দেবে।
সম্প্রতি টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও মেয়েটির মর্যাদাহানি এবং বিচারাধীন বিষয়ের যুক্তি দিয়েছেন। ছবিটার বিরুদ্ধে একই ধারার যুক্তি দেখিয়েছিল ভারতের নারীবাদী চিন্তক-আন্দোলনকর্মীদের একাংশ। তর্কবিতর্কে জোরালো পাল্টা যুক্তিও কিন্তু উঠে এসেছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নিষেধাজ্ঞার আদত কারণ জাত্যভিমান—আঁঁতে ঘা লাগা। সংসদীয় মন্ত্রী ভেঙ্কাইয়া নাইডু লোকসভায় বলেছিলেন, এ ছবি ভারতের মানহানি করার একটা চক্রান্ত (৪ মার্চ, পিটিআই)। আর বিজেপির মুখপাত্র লোকসভাসদস্য মীনাক্ষী লেখী রাজ্যসভায় বলেছিলেন, এটা পর্যটনের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলবে (৪ মার্চ, এনডিটিভি)!
৫...
লজ্জা, দায় এড়ানো ও ভয় নানা রূপ ধরে। জবাবদিহি চাইলে ক্ষমতা ক্ষিপ্ত হয়।
পুলিশের ভয় ছিল, ছবিটা দেখালে ‘নির্ভয়া’র ঘটনা-পরবর্তী জনবিক্ষোভের পুনরাবৃত্তি হতে পারে (৪ মার্চ, দ্য হিন্দু)। ছবিতে ২০১২ সালের ওই বিক্ষোভ দমনে পুলিশের লাঠিপেটা করা, জলকামান দাগা সহিংসতার ফুটেজ দেখি।
অদম্য ওই জনবিক্ষোভ হয়ে উঠেছিল মেয়েদের মুক্ত জীবন, নিরাপত্তা ও সম-অধিকারের দাবি। পুঞ্জীভূত ওই বিক্ষোভের চাপই কর্তৃপক্ষকে শেষতক পথে আসতে বাধ্য করেছিল।
১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের দিনাজপুরে শিশু গৃহকর্মী ইয়াসমিনকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছিল পুলিশের তিন সদস্য। পুলিশ পরে ইয়াসমিনকে যৌনকর্মী বলেছিল। গণবিক্ষোভে গুলি চালিয়ে মানুষ মেরেছিল। দেশজোড়া প্রতিবাদের চাপেই ধর্ষণকারীদের বিচার ও ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়।
ফিজিওথেরাপির ছাত্রী ‘নির্ভয়া’র ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০০৪ সালে বাংলাদেশের সাভারে পোশাকশ্রমিক রাহেলা আখতারের গণধর্ষণ ও হত্যার কথা। রাহেলার ধর্ষকেরা কুপিয়ে তাঁর ঘাড়ের পেছনটা (স্পাইনাল কর্ড) বিচ্ছিন্ন করে তাঁকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন জঙ্গলে ফেলে রেখে যায়। দুদিন পর ফিরে এসে রাহেলাকে জীবিত দেখতে পেয়ে তাঁরা অ্যাসিড ঢেলে চলে যায়। রাহেলাকে পাওয়া যায় পরদিন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায় এক মাস যুঝে তিনি মারা যান। ঘটনাটির প্রতিবাদী বিক্ষোভ ছিল বিক্ষিপ্ত, স্বল্পায়ু। প্রায় পাঁচ বছর পর মাত্র একজন আসামির ফাঁসির দণ্ড হয়েছে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে আজও ধরেনি।
কোন ঘটনা কেন সমাজের নারী-পুরুষকে ব্যাপক বিক্ষোভে টেনে আনে, সেই প্রশ্ন মনে আসে।
৬...
ইনডিয়া’স ডটার-এ তিহার জেলে মুকেশের তিন সহযোগীকেও দেখি। চারজনই দেখতে গড়পড়তা সাধারণ মানুষ।
মুকেশ নিজেকে নির্দোষ বলে নিপাট মুখে নৃশংসতার বিবরণ দেন। তিনি বলেন, তাঁরা সেদিন ‘মৌজ-মস্তি’ করতে বেরিয়েছিলেন। তিনি ভাই-বন্ধুদের বেপরোয়া গায়ের জোরের কথা বলেন। বলেন, তাঁর ভাই আগেও ধর্ষণ করেছেন; অনেকেই করে, পারও পেয়ে যায়।
ছবিটায় তাঁদের বস্তির পরিবেশ, পরিবারের দারিদ্র্য ও প্রান্তিকতা আর নাবালক ছেলেটির প্রসঙ্গে পথশিশুর জীবন দেখানো হয়েছে। সেখানে মারধর, নারীর প্রতি সহিংসতা ও অবজ্ঞার ব্যাপ্তির কথা বলা হয়েছে। এটা আর্থসামাজিক বৈষম্যের বিষবৃক্ষকে অবয়ব দিয়েছে, অপরাধের পটভূমির গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিকে আলো ফেলেছে।
তবে ভুললে চলবে না, কেবল দারিদ্র্যই ধর্ষকের জন্ম দেয় না। অনেক ধর্ষক বিত্তবান, ক্ষমতাধর। সমস্যাটা একা ভারতেরও নয়।
জাতিসংঘের হিসাবে পৃথিবীতে পাঁচজনে একজন নারী জীবনকালে কখনো না কখনো ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার শিকার হবে। যুক্তরাষ্ট্রে দুটি জরিপে ছয় থেকে পাঁচজনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী এমন অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন (এনআইজে, ১৯৯৮; সিডিসি, ২০১০)। জরিপ বলছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ২০ জনে একজন নারী ১৫ বছর বয়স থেকে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন (এফআরএ, ২০১৪)।
জরিপগুলো স্বামী বা নিকটসঙ্গীর হাতে ধর্ষণের ব্যাপকতার কথাও বলে। বাংলাদেশে ১৫ পেরোনো নারীদের জীবনকালে ২৩ জনে একজন অন্য পুরুষের হাতে এবং বিবাহিতদের তিনজনে একজন স্বামীর হাতে এমন সহিংসতার শিকার হয়েছেন (বিবিএস, ২০১১)।
সব পুরুষ ধর্ষণ করে না। এমন প্রতিটি অপরাধের জটিল পটভূমি থাকে। তবে এ কথা স্বীকৃত যে, ধর্ষণ তথা সহিংসতার আকর নারীকে পুরুষের চেয়ে কমদামি, তুচ্ছ বলে ভাবার মধ্যে। নারীকে ভোগ করা, সবরকমে নিয়ন্ত্রণে রাখাকে পৌরুষ বলে ভাবার মধ্যে।
প্রকাশ্য বা সুপ্ত এ মানসিকতা দুনিয়াজুড়েই ব্যাপ্ত। কতজনের মধ্যে? এ প্রশ্ন প্রত্যেক পুরুষ-নারীর নিজেকেই করার।
মুকেশ এবং উকিল জুটির বক্তব্য অনেককে লজ্জা দিয়েছে। কিন্তু সেগুলোর নগ্ন প্রকাশের পরই শুধু দিল্লির উকিলসমাজ শর্মাজি ও সিংজিকে জবাবদিহির মুখোমুখি করেছে।
‘নির্ভয়া’র মা বলেছিলেন, ‘কোনো ক্রাইম হলে সোজা মেয়ের ওপর আক্রমণ হয় যে ওর বাইরে যাওয়া ঠিক নয়; এত দেরি পর্যন্ত ঘোরাফেরা ঠিক নয়; এই কাপড় পরা ঠিক নয়। এই দোষ যদি ছেলের ওপর আরোপ করা যায় যে, সে কেন এমন করে—ওর এমন করা ঠিক নয়...।’
ধর্ষণের বিচার কমই মেলে। বিচার ও শাস্তির জন্য প্রতিবাদ-বিক্ষোভ খুব জরুরি। কিন্তু আসল যুদ্ধটা মানুষের মনের অচলায়তনের সঙ্গে। লজ্জাকর মানসিকতাকে ধামাচাপা দেওয়া নয়, স্বীকার করাটা তাই প্রথম কাজ।
৭...
‘নির্ভয়া’র বাবা-মা তথ্যচিত্রটির আন্তর্জাতিক সংস্করণে মেয়ের নাম প্রকাশ করেছেন। ছবির নামপাতায় ভাসে—ইনডিয়া’স ডটার, জ্যোতি সিংয়ের কাহিনি।
জ্যোতি সিং আশা ও বদ্রীনাথ সিংয়ের কন্যা। কাহিনির শুরুতে মা বলেন, মেয়ের জন্মে তাঁদের ঘরে খুশি এসেছিল। বিমানবন্দরে শ্রমিকের কাজ করা বাবা বলেন, মেয়ের চিকিত্সক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে তিনি জমি বেচেছিলেন।
গল্পের পরিণতিতে থমধরা সন্ধ্যায় নদীতীরে কার চিতা জ্বলে। মায়ের হাত ছোট্ট ভেলায় প্রদীপ জ্বালে। ভেলায় হলুদ গাঁদাফুল আর সাদা চন্দ্রমল্লিকার মালা। ভেলা ভেসে যায়।
বাবার গলা ভেসে আসে, ‘যেতে যেতে ও এমন এক মশাল জ্বেলে গেছে, যাতে একটি দেশ শুধু নয়, পুরো বিশ্ব প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ও এক প্রশ্নচিহ্নও রেখে গেছে—নারীর মানে কী? সমাজে আজ নারীকে কী চোখে দেখা হয়?’ মা আবছা গলায় মেয়ের শেষ মুহূর্তের কথা বলেন...।
ঘটনার পর ঘটনা ঘটছেই। মানুষ হওয়ার জন্য মানুষকে আরও কত পথ হাঁটতে হবে?।
কুর্‌রাতুল–আইন–তাহমিনা: সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.