সাকিবে সবুজ বাংলাদেশ

গোটা স্টেডিয়ামের দর্শক তখন উঠে দাঁড়িয়েছেন। সাকিবের বলে চাতারার শট বাতাসে ভাসছে। কয়েক সেকেন্ড পর গ্যালারিজুড়ে ইশশশ... শব্দ। মিড-অনে জিম্বাবুয়ের শেষ ব্যাটসম্যানের ক্যাচটা যে ধরতে পারেননি ফিল্ডার শাহাদাত হোসেন। এরপর সাকিবকে পরপর দুটি চার মেরেছেন পানইয়ানগারা। খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে ক্ষণিকের সেই গুমোট ভাব কেটে গেছে পরের ওভারেই। একটা ক্যাচ মিসে বাংলাদেশের জয়ের উন্মাতাল আনন্দে ভাটা পড়েনি একটুকু। সেই চাতারাকে যখন এলবিডব্ল–র ফাঁদে ফেললেন তাইজুল, স্ট্রাইক প্রান্তের একটি স্টাম্প তখন মুশফিকের হাতে। উইকেট নিয়ে হাত ঘোরানোর সময় স্টাম্প লাগলো শুভাগত হোমের মাথায়, সেদিকে খেয়ালই নেই অধিনায়কের। অন্য প্রান্তের তিন উইকেট নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে সাকিব-তাইজুল-জুবায়ের ও রুবেলের মধ্যে। ম্যাচের মতো এখানেও তিন স্পিনার পেসার রুবেলকে হতাশ করলেন। উইকেট গেল তিন স্পিনারের হাতে। যারা দিনমান হাত ঘুরিয়েছেন ক্লান্তিহীনভাবে। পুরস্কার বিতরণ শেষ হওয়ার পর আবার উদযাপন। উত্তাল দর্শকদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার সময় নেতৃত্ব দিলেন সেই সাকিবই। যার সবুজাভ অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ভাস্বর বাংলাদেশের সিরিজ জয়। একের পর এক রেকর্ড গড়া এই অলরাউন্ডার কাল টেস্ট ইতিহাসের তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে একই মাঠে সেঞ্চুরি এবং ১০ উইকেট পাওয়ার অনন্য অর্জনের আবিরে রাঙালেন তিনি নিজেকে। আর বাংলাদেশ ১৬২ রানের জয়ে এক ম্যাচ বাকি থাকতে সিরিজ নিজেদের করে নিল ২-০-তে। খুলনায় এই বড় জয় প্রয়াত মানজারুল ইসলাম রানার প্রতি উৎসর্গ করেছে বাংলাদেশ দল। রানের বিচারে এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জয়। আর সব মিলিয়ে ষষ্ঠ টেস্ট জয়। সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচ শুরু হবে ১২ নভেম্বর, চট্টগ্রামে।
অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের ভাবনায় সব সময়ই ছিল জয়। ম্যাচ শেষে তিনি বলেন, ‘আমি কখনও ভাবিনি যে, ম্যাচটা ড্র হবে।’ একই টেস্টে সেঞ্চুরি এবং ১০ উইকেট। সাকিবের আগে এই কীর্তি ইংল্যান্ডের ইয়ান বোথাম ও পাকিস্তানের ইমরান খানের। এই দু’জনই রেকর্ড গড়েছেন ভারতের বিপক্ষে। কাল সাকিব সেই রেকর্ডের অংশ হয়ে বলেন, ‘আমি শুনেছি একটি রেকর্ড হয়েছে। তবে আমার কাছে রেকর্ডের চেয়ে দলের জয়ই বড়।’ মাঠে বসেই নিজের দেশ জিম্বাবুয়েকে হারতে দেখেও খুশি বলে জানালেন বাংলাদেশ দলের পেস বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিক। প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদসহ অন্য দুই নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু ও হাবিবুল বাশার বললেন, দারুণ ম্যাচ। বাংলাদেশের এখন নয় নম্বর র‌্যাংকিং নিশ্চিত হয়ে গেল। চট্টগ্রামে শেষ টেস্ট হারলেও জিম্বাবুয়ের উপরেই থাকবেন মুশফিকুর রহিমরা। ম্যাচ শেষেও মুশফিক জানালেন, র‌্যাংকিংয়ে উন্নতির ধারা ধরে রাখতে চান তিনি। দুই বছর আগে খুলনা শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামের অভিষেক টেস্ট ১৩৫২ রানের ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশ হেরেছিল ১০ উইকেটে। এবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১২০০ রানের ম্যাচে বাংরাদেশ জয় পেল ১৬২ রানে।খুলনার উইকেট নিয়ে আশাবাদী ছিলেন মুশফিকুর রহিম। খুলনার দর্শকদের উত্তুঙ্গ আগ্রহ, খুলনা শহরজুড়ে ব্যানার-ফেস্টুনে টেস্ট ম্যাচের কথা জানান দেয়া, স্পিনসহায়ক উইকেট- সবই ছিল বাংলাদেশের অনুকূলে। তবে নিজেদের চাহিদামতো উইকেট পাওয়া যায়নি বলে বাংলাদেশ কয়েকবার প্রশ্ন তুললেও স্পিন ফাঁদেই জিম্বাবুয়েকে উড়িয়ে দিল তারা। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে সাকিবকে জ্যোতিষী বলায় খানিকটা লজ্জা পেলেন তিনি। ম্যাচের তৃতীয় দিনে জয়ের কঠিন তিন শর্ত তিনিই দিয়েছিলেন। চতুর্থ দিনে তার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। পঞ্চম দিনে মিলে গেল। আপনি কি তাহলে এখন জ্যোতিষী? সাকিব বলেন, ‘এমন কথা আমি নিজেও বিশ্বাস করি না। আমাদের ধর্মে তো এমন কথা মানাই হয় না।’পঞ্চম দিনের সকালে বাংলাদেশ ১৯.৫ ওভার ব্যাট করে মাত্র ৪৭ রান তোলে। তখন কমপক্ষে ৬৮ ওভার খেলতে হবে জিম্বাবুয়েকে। আগেরদিনের পাঁচ উইকেটে ২০৫ রান নিয়ে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশ কাল নয় উইকেটে ২৪৮ রানে তাদের দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করে। জিম্বাবুয়ের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩১৪ রান। হাফ সেঞ্চুরিয়ান মাহমুদউল্লাহ আবারও সেঞ্চুরি করতে ব্যর্থ। এক ম্যাচে দুটি হাফ সেঞ্চুরি হল তার। এবার ৭১ রান। প্রথম হাফ সেঞ্চুরি পেলেন শুভাগত হোম। তিনি আউট হওয়ার পরই ইনিংস ঘোষণা করে বাংলাদেশ। জিম্ববুয়েকে ৬৮ ওভারে এই রান তুলতে হতো। সময় থাকলে আরও কয়েক ওভার বাড়তে পারত। কিন্তু অপেক্ষায় থাকতে হয়নি বাংলাদেশকে। মাত্র ৫১.১ ওভারেই জিম্বাবুয়েকে ১৫১ রানে অলআউট করেন বাংলাদেশের তিন স্পিনার। মুশফিক শুরুটা করেন তাইজুল ইসলামের হাতে বল দিয়ে। এরপর সাকিব। উইকেট নেয়ার ক্ষেত্রেও মিল এই দুই বাঁ-হাতি স্পিনারের মধ্যে। নিজের তৃতীয় ওভরে ব্রায়ান চারিকে ফেরান তাইজুল। এর দুই ওভার পরই আরেক ওপেনার সিকান্দার রাজাকে ফিরিয়ে দুর্দান্ত সূচনা এনে দেন সাকিব। টেলরকে রানের খাতা খোলার সুযোগই দেননি সাকিব। চতুর্থ উইকেটে চাকাবভা ও মাসাকাদজা ৭০ রানের জুটি গড়লে একটু চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ। এই জুটি খেলে ২৩.৫ ওভার। সাকিবকে এ সময় বিরতি দিয়ে পেসার রুবেল হোসেনকে দিয়ে চার ওভার করিয়ে নেন অধিনায়ক। জুবায়ের হোসেন এই জুটি ভাঙার পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি বাংলাদেশকে। প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি এবং দ্বিতীয় ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরি করা মাসাকাদজাকে ফিরিয়ে বুনো উল্লাসে মাতেন সাকিব। তবে শেষটা লুকিয়ে ছিল তাইজুলের জন্যই। চাতারাকে আউট করার পর পুরো গ্যালারি জয়োল্লাসে ফেটে পড়ে। মাঠের পশ্চিম পাশে মানজারুল ইসলাম রানা গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড তখন আরও উজ্জ্বল। পরে রানার উদ্দেশে এই জয় উৎসর্গ করে বাংলাদেশ দল। বাংলাদেশ তাদের টেস্ট ইতিহাসে এ নিয়ে তৃতীয়বার সিরিজ জিতল। আর ২০০৯-এর জুলাইয়ের পর প্রথম। সিরিজ হেরে জিম্বাবুয়ের অধিনাযক ব্রেন্ডন টেলর স্বীকার করে নিলেন, ‘এককথায় বাংলাদেশ আমাদের উড়িয়ে দিয়েছে।’ একদম ঠিক। ঢাকার পর খুলনায়ও বড় জয়ে বাংলাদেশ টেস্ট র‌্যাংকিংয়ে তলানিতে থেকে উঠে এলো নবম স্থানে। আর দশমে নেমে গেল জিম্বাবুয়ে। চট্টগ্রামে যা-ই ঘটুক, এতে কোনো হেরফের হবে না। (স্কোর কার্ড খেলার পাতায়)

No comments

Powered by Blogger.