ইয়াবা চোরাচালান এখন ট্রেনে by আল-আমিন

কৌশল পাল্টিয়েছে স্বর্ণ ও ইয়াবার চোরাচালানিরা। তারা এখন ট্রেনকে নিরাপদ মনে করছে। এর কারণ ট্রেনে শ’ শ’ যাত্রী থাকে। চোরাচালানিদের সহজেই চিহ্নিত করা যায় না। এতে সহজেই তারা অবৈধ স্বর্ণ ও ইয়াবা বহন করতে পারে। গত দুই মাসে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে বেশ কয়েকটি স্বর্ণ ও ইয়াবার চালান উদ্ধার করেছে রেলওয়ে পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয়েছে চোরাচালানিদের। গ্রেপ্তারকৃতরা বলছে, বাসে সীমিত সংখ্যক যাত্রী থাকায় ধরা পড়ার ভয় থাকে। এ জন্য তারা ট্রেনে যাতায়াত করছে। এখানে ধরা পড়ার ভয় কম। স্টেশন থেকে যাত্রী বেশে চোরাকারবারিরা সহজেই নিজেদের গন্তব্যে চলে যেতে পারে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে চোরাচালানিদের শনাক্ত ও আটক করার জন্য শক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নেই। তবে পুলিশের দাবি, চোরাচালানিদের ঠেকাতে রেলওয়ে পুলিশ ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। তার বড় প্রমাণ, গত দুই মাসে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিপুল পরিমাণের স্বর্ণ ও ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ তাদের আটক করলেও এর মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের আটক করার জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে। রেল পুলিশ সূত্র জানায়, গত দুই মাসে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ১১টি অভিযানে প্রায় ৬০০০ ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া তিনটি অভিযানে ১০২টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করেছে পুলিশ। কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি আবদুল মজিদ জানান, চোরাকারবারি দলের সদস্যরা ট্রেনকে এখন নিরাপদ বাহন মনে করছে এটা সত্য। তবে পুলিশও আগের চাইতে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করছে। তার বড় উদাহরণ, গত দুই মাসে কমলাপুর স্টেশন থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণে ইয়াবা ও স্বর্ণের বার। বাড়ানো হয়েছে টহল টিমের সংখ্যা। তিনি আরও বলেন, কমলাপুর রেলওয়ে পুলিশের জনবলের ঘাটতি রয়েছে। তল্লাশি চালানোর জন্য নেই কোন আধুনিক যন্ত্র। ট্রেন থেকে হাজার হাজার যাত্রী নামে। যাকে পুলিশ সন্দেহ করে তাকেই তল্লাশি করে। চোরাচালানিদের ঠেকাতে ও তাদের আটক করার জন্য রেলওয়ে পুলিশের আরও জনবল দরকার। বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের কাছে জানানো হয়েছে।

সূত্র জানায়, গত ১৪ই জুলাই তূর্ণা এক্সপ্রেস থেকে আবদুল আজিজ নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৯১ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। ১৬ই জুলাই সুবর্ণ এক্সপ্রেসে অভিযান চালিয়ে ৫০ পিস স্বর্ণের বারসহ সুমন, দেলু ও সেলিম নামে তিনজনকে আটক করা হয়। একই দিনে ওই ট্রেন থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ১৬ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। ১৬ই জুলাই সুবর্ণ এক্সপ্রেস থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ১৬ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে। ১৯শে জুলাই তূর্ণা এক্সপ্রেস থেকে এমরান নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১০০০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। ২৬শে জুলাই তূর্ণা এক্সপ্রেস থেকে ১২টি স্বর্ণের বারসহ দুজনকে আটক করা হয়। চলতি মাসের ৪ঠা আগস্ট সকালে সুবর্ণ এক্সপ্রেস থেকে ১৯০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ এক যুবককে আটক করা হয়। ৯ আগস্ট তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেসের যাত্রী খালেদ নামে এক ব্যক্তির দেহতল্লাশি করে ১ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। ১০ই আগস্ট এক যুবকের ব্যাগ তল্লাশি করে ৫০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে পুলিশ।
১৪ই আগস্ট পারাবত এক্সপ্রেস থেকে আবেদ নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে এক হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। ১৫ই আগস্ট সকালে চট্টগাম থেকে ছেড়ে আসা সুবর্ণ এক্সপ্রেসের যাত্রী মুক্তা বেগমের কাছ থেকে ৭০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে পুলিশ। ১৬ই আগস্ট লালমনি এক্সপ্রেস থেকে ৪১ পিস ট্যাবলেট পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ২২শে আগস্ট নিশিতা এক্সপ্রেস থেকে ৪০টি স্বর্ণের বার সহ শাহীন নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। ১লা সেপ্টেম্বর সকালে তূর্ণা এক্সপ্রেসে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ১০টি স্বর্ণের বারসহ মো. বাবর নামে এক যুবককে আটক করা হয়। ২৬শে অক্টোবর সকালে নিশীথা এক্সপ্রেসের যাত্রী ইমরান ও শাহীন নামে দুজন যুবকের দেহতল্লাশি করে ৭০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা।
সূত্র জানায়, এসব ঘটনায় ১৯৭৪ সালের ২৫/বি ধারার চোরাচালান আইনে আটককৃত ব্যক্তিদের নামে কমলাপুর রেলওয়ে থানায় মামলা করা হয়েছে। অনেকেই রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। কিন্তু, এসব ঘটনার মূল হোতাদের গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না।
পুলিশ জানায়, ২২শে আগস্ট সুবর্ণ এক্সপ্রেস থেকে ৪০টি স্বর্ণের বার সহ শাহীন নামে এক যুবককে আটক করে রেলওয়ে থানা পুলিশ। এ ঘটনায় থানায় একটি মামলা করা হয়। পুলিশ তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কমলাপুর থানার এসআই রফিক জানান, আটককৃত শাহীন চট্টগামের পতেঙ্গা থেকে চোরাকারবারি দলের সদস্য জহির উদ্দীন স্বপন নামে এক জনের কাছ থেকে ৪০টি স্বর্ণের বার নেয়। পরে ট্রেনযোগে ঢাকায় নিয়ে আসে। তিনি আরও বলেন, স্বর্ণের বারগুলো পুরানা পল্টনের এক যুবককে দেয়ার কথা ছিল। তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তার নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। আটককৃত শাহীন জানিয়েছে, স্বর্ণের বারগুলো সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করার কথা ছিল। গত ১৬ই জুলাই কমলাপুর স্টেশনে সুবর্ণা এক্সপ্রেসে অভিযান চালিয়ে ৫০ পিস স্বর্ণের বারসহ সুমন, দেলু ও সেলিম নামে তিনজনকে আটক করা হয়। এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কমলাপুর থানার এসআই মো. আরেফিন জানান, আটককৃত ৩ ব্যক্তি স্বর্ণের বারগুলো মতিঝিল এলাকার একটি হোটেল ও এক ট্রাভেল ব্যবসায়ীকে দেয়ার কথা ছিল।
তাদের শনাক্ত করা গেলেও গ্রেপ্তার করা যায়নি। ঘটনার পর থেকে তারা গা’ঢাকা দিয়ে আছে। এছাড়াও ২৬ অক্টোবর নিশীথা এক্সপ্রেসের দুই যাত্রীর দেহতল্লাশি চালিয়ে প্রায় ৭০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে তারা জানায় যে, ওই সব ট্যাবলেট তারা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নিয়ে আসছিল। ট্যাবলেটগুলো তারা কারওয়ান বাজারের এক পাইকারি মাদক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রয় করতো। পুলিশ ওই মাদক ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করেছে। তারা গ্রেপ্তার হওয়ার পরেই ওই মাদক ব্যবসায়ী গা-ঢাকা দিয়েছে। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে।
সরজমিনে গতকাল কমলাপুরে রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, মূল প্রবেশপথে বড় ধরনের কোন তল্লাশি চৌকি নেই। পুলিশ যাকে সন্দেহ করে তাকেই তল্লাশি করে থাকে। তল্লাশি করার জন্য নেই কোন অত্যাধুনিক স্ক্যানারের ব্যবস্থা। এতে করে চোরাকারবারি দলের সদস্যরা নিমিষেই তাদের চোরাই পণ্য নিয়ে রেলস্টেশন থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। কোন কোন গেটে শুধু একজন আনসার সদস্য বসে থাকেন। মাঝে মধ্যে রেলওয়ে থানার দুই একজন পুলিশ সদস্যকে টহল দিতে দেখা যায়। স্টেশনের চারদিকের রেলওয়ে প্রাচীরের প্রায় চার স্থানে বড় ফুটো রয়েছে। চোরাকারবারি দলের সদস্যরা প্রাচীরের ওই ফুটোগুলো দিয়ে বেরিয়ে যায়। এ কারণে তাদের তল্লাশি চৌকির মুখোমুখিও হতে হয় না। রেল পুলিশ জানায়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে কয়েকবার অবহিত করার পরও তারা ওই প্রাচীর নির্মাণের কোন উদ্যোগ নেয়নি। যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক তোফাজ্জাল হোসেন জানান, চোরাচালান ঠেকাতে দক্ষ জনবল নিয়োগ ও আধুনিক স্ক্যানার কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.