জয়বাংলা স্লোগান প্রথম যেদিন উচ্চারিত হয়

বেশ কিছু জায়গায় মুক্তিবাহিনী ও বিএলএফের সদস্যদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও সংঘর্ষ হয়। এটা উল্লেখ করা দরকার যে, বিএলএফের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর (ফ্রিডম ফাইটার বা এফএফ নামে পরিচিত) এবং বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধরত বাঙালি সৈনিকদের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত প্রধানত দুই নম্বর সেক্টরেই লক্ষ্য করা যায়। বিএলএফের পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মণির সঙ্গে মেজর খালেদ মোশাররফের বাহিনীর কোন বোঝাপড়া ছিল না। মণি ছিলেন তাজউদ্দীন সরকারের প্রচণ্ড রকম বিরোধী। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের লেখা সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থে এসব কথা বলা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের ভেতরে একটা গোপন সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার সূচনা করেন। ১৯৬৩ সালের নভেম্বরে তিনি আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদকে নিয়ে ছোট্ট একটি সেল বা চক্র তৈরি করেন। রাজ্জাক ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক। কাজী আরেফ ছিলেন ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সভাপতি। এই সেলের তাত্ত্বিক ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তারা বিপ্লবী রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন ছিলেন। আঙুল কেটে রক্ত ছুঁয়ে তারা শপথ নেন, যতদিন পূর্ববাংলা স্বাধীন না হবে ততদিন তাঁরা ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার দিকে ছুটবেন না, এমনকি বিয়েও করবেন না। ১৯৬৫ সালে এ গ্রুপে আরও দু’জনকে নেয়া হয়। একজন যশোর ছাত্রলীগের নেতা আবুল কালাম আজাদ, অপরজন চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের নেতা এম এ মান্নান। পরে নিষ্ক্রিয়তার কারণে মান্নানকে বাদ দেয়া হয়। গ্রুপের অন্যদের না জানিয়ে স্কুলপড়ুয়া এক ছাত্রীকে বিয়ে করার অপরাধে আবুল কালাম আজাদও বাদ পড়েন।
১৯৬৯ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস পালন উপলক্ষে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১৫ই সেপ্টেম্বর থেকে তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করে। প্রথম দিন অর্থাৎ ১৫ই সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে একটা সাধারণ ছাত্রসভা ডাকা হয়। সভা শুরু হলে জিন্নাহ হলের (পরবর্তী নাম সূর্যসেন হল) ছাত্র আফতাব উদ্দিন আহমদ সবাইকে চমকে দিয়ে চিৎকার দিয়ে বলেন ‘জয় বাংলা’। ইকবাল হলের (পরবর্তী নাম সার্জেন্ট জহরুল হক হল) ছাত্র চিশতি শাহ হেলালুর রহমান সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দেন ‘জয় বাংলা’ বলে। এভাবে তারা কয়েকবার স্লোগানটা দেন। ব্যাপারটা আকস্মিকভাবে ঘটে যায়। যেহেতু এটা একটা নতুন স্লোগান, তাই সবাই একটু হতচকিত হয়ে চুপচাপ থাকেন। বিষয়টা এভাবেই চাপা পড়ে থাকে। সত্তরের ১১ই জানুয়ারি পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগ জনসভার আয়োজন করেছিল। প্রধান বক্তা ছিলেন শেখ মুজিব। মঞ্চের সামনের দিকে ‘জয় বাংলা’ লেখা একটা ব্যানার ঝোলানো ছিল। ‘বিজ্ঞাপনী’র কর্ণধার কামাল আহমেদ এটা ডিজাইন করে দিয়েছিলেন। মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে সিরাজুল আলম খান বেশ কয়েকবার এই স্লোগান দেন। এ প্রথম ঢাকার একটি জনসভায় প্রকাশ্যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারিত হলো এবং উপস্থিত জনতা তাৎক্ষণিকভাবে তাতে সাড়া দিলো। তবে মঞ্চ থেকে আওয়ামী লীগের কোন নেতা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেননি।

৭ই মার্চ রেসকোর্সের স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় শেখ মুজিব এলেন বেলা তিনটায়। তার ১৯ মিনিটের ভাষণটি ছিল নানা দিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা করেননি, তবে ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার’ আহ্বান জানান এবং ‘যার যা আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার’ জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। জনসভায় তিনি কি বলেছেন, তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তিনি কি বলেননি। ২৫ ও ২৬শে মার্চ মধ্যবর্তী রাতে সামরিক অভিযান শুরু হয়। রাত নয়টার পর থেকেই সামরিক হামলার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে আসছিল। তবে এটা যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা নেতারা আঁচ করতে পারেননি। শেখ মুজিব তার সহযোগী আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের এবং ছাত্রনেতাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলেন। তিনি নিজে তাদের সঙ্গে যোগ দেবেন এমন ধারণাও দেন। শেখ মুজিব শেষ কথা বলেন সিরাজুল আলম খান, আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজের সঙ্গে রাত ১১টার দিকে। সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ ২৬শে মার্চ কেরানীগঞ্জের দৌলেশ্বর গ্রামে জাতীয় পরিষদের সদস্য হামিদুর রহমানের বাড়িতে অপেক্ষা করেছিলেন শেখ মুজিবের জন্য। ওখান থেকে আরও দূরে সরে যাওয়ার জন্য একটা লঞ্চও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। শেখ মুজিবকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে খসরু একটা জিপ নিয়ে মধ্যরাতে ধানমন্ডির আশপাশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। শেখ মুজিব বাড়িতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। রাত সোয়া একটায় লে. কর্নেল জেড এ খানের নেতৃত্বে একদল কমান্ডো নিয়ে মেজর বেলাল ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের বাড়িতে বিনা বাধায় প্রবেশ করেন। শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হন। আওয়ামী লীগের আর কোন নেতাকে সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ৪ঠা এপ্রিল ড. কামাল হোসেন গ্রেপ্তার হন।

No comments

Powered by Blogger.