অপারেশন বালাগঞ্জ- ‘পরিস্থিতি ছিল গুলি ছোড়ার মতো’ by ওয়েছ খছরু

‘আফিয়া ও শিমুলকে নিয়ে বারবার বের হতে চেষ্টা করি। কিন্তু ওদের ছিনিয়ে নেয়ার ঝুঁকি ছিল। শেষে ডিআইজি ও পুলিশ সুপারের পরামর্শ নিলাম। রাত নেমে আসার পর আফিয়া ও শিমুলকে পুলিশের জ্যাকেট ও হেলমেট পরাই। একপর্যায়ে অন্ধকারের মধ্যেই দু’টি মরদেহের সঙ্গে ওদেরও গাড়িতে তুলে নিই।’ ঘটনার ১৩ দিন পর অপারেশন বালাগঞ্জের ঘটনার কথা এভাবেই মানবজমিন-এর কাছে জানান সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রওশনুজ্জামান সিদ্দিকী। বালাগঞ্জের নিখোঁজ থাকা মসজিদের ইমাম ও গাড়িচালকের লাশ উদ্ধার অভিযানের ঘটনাবলি এখনও বিচলিত করে তোলে এই পুলিশ কর্মকর্তাকে। বালাগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান আবদাল মিয়া ঘটনাস্থলে গিয়ে নিজেই জানিয়েছিলেন, ‘নিকট অতীতে বালাগঞ্জে এত বড় ঘটনা ঘটেনি। ইমাম ও গাড়িচালক গুম, খুন ও লাশ উদ্ধারের কাহিনীকে রূপকথার গল্পও হার মানিয়েছে।’ ১৮ই অক্টোবর বালাগঞ্জ থেকে তাজপুর আসার পথে গুম হন সদর পূর্ববাজার মসজিদের ইমাম মাওলানা আবদুল হামিদ শুকুর ও সিএনজিচালক আরশ আলী। ২৩শে অক্টোবর তাদের লাশ পাওয়া যায় ইলাশপুরের ফিরোজ ভিলার বাথরুমে। বিশেষ কায়দায় সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে ওই লাশ দু’টি গুম করে রাখা হয়েছিল। আর এই খবর পেয়ে মানুষের ঢল নামে ইলাশপুরে। শুধু বালাগঞ্জ নয় আশপাশের থানা ও বিভাগীয় নগরী সিলেট থেকেও মানুষ আলোচিত এ ঘটনাস্থল দেখতে ভিড় জমায়। দুপুর গড়াতেই কয়েক হাজার মানুষের ঢল নামে ইলাশপুরে। এই সময়ে অপারেশনের মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্ব দিতে পুলিশ দল নিয়ে সেখানে যান সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রওশনুজ্জামান সিদ্দিকী। গতকাল মানবজমিন-এর কাছে আলোচিত এ অপারেশনের স্মৃতি ধারণ করেন রওশনুজ্জামান। বলেন, বাড়ির সদর দরজার বাইরে কয়েক হাজার মানুষ। তারা বিক্ষুব্ধ। হাতে লাঠি, রডসহ দেশী অস্ত্র। গুম করে জোড়া খুনের ঘটনায় তারা বিক্ষুব্ধ। পুলিশ বাড়ির ভেতরে অবস্থান করছে। কিন্তু উত্তেজিত জনতার ক্ষোভ কোনভাবেই প্রশমিত হচ্ছে না। তারা ক্ষোভে বাড়ির দেয়াল ভেঙে ফেলে। ঘরেও চালায় হামলা। বাধা দিতে গিয়ে ক্ষুব্ধ জনতার হাতে পুলিশও হেনস্থা হয়েছে।’ তিনি জানান, ‘বারবার হ্যান্ডমাইকে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানাই। এরই মধ্যে সেখানে উপজেলা চেয়ারম্যান আবদাল মিয়া, ইউএনও আশরাফুর রহমানসহ জনপ্রতিনিধিরা ছুটে যান। তারাও পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমরা ধৈর্যহারা হইনি। জনগণকে সামলানোর পাশাপাশি লাশ উদ্ধারে চলে অভিযান। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রওশনুজ্জামান জানান, ‘সিলেটের ডিআইজি মিজানুর রহমান ও পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বারবার ফোন করছেন। দিচ্ছেন দিক-নির্দেশনা। বলছেন, ‘জনগণকে ক্ষেপানো যাবে না। পুলিশ অপদস্থ হলেও ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। ওদিকে, বিক্ষুব্ধ মানুষ কোন বাধা মানছে না। পুলিশের কয়েকজন সদস্যও রোষানলের শিকার হয়েছেন। পরিস্থিতি এমন ছিল গুলি না ছুড়লে জোড়া লাশ ও আসামিদের নিয়ে ফেরা সম্ভব নয়। অপারেশনের ইতি টানার বর্ণনা দিয়ে রওশন জানান, ‘সন্ধ্যার পর বাথরুমের ভেতর থেকে লাশ দু’টি বাইরে নিয়ে আসি। তার আগেই বাড়ির সব লাইট অফ করে দিই। অন্ধকার হওয়ায় জনগণ বুঝতে পারেনি কি হচ্ছে বাড়িতে। এ সময় খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আফিয়া বেগম ও শিমুলকে পুলিশের জ্যাকেট পরাই। মাথায় হেলমেট পরিয়ে অন্ধকারের মধ্যে লাশ দু’টির সঙ্গে তাদেরও এম্বুলেন্সে ওঠাই। এরপর জনগণের ভিড় সামলে তাদের নিয়ে সিলেটে চলে আসি। আলোচিত এ জোড়া গুম ও খুনের ঘটনা নিয়ে সিলেটজুড়ে এখনও কথাবার্তার অন্ত নেই। গ্রাম, গঞ্জ, হাট-মাঠে মানুষের মুখে মুখে এই ঘটনা। এই ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া মা আফিয়া ও ছেলে শিমুল আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। তারা অনৈতিক কাজের কারণে খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে স্বীকার করলেও পুলিশ এখনও ঘটনার পেছনে দৌড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে পুলিশের কাছে বেশ কিছু তথ্য এসেছে। রওশনুজ্জামান জানিয়েছেন, আদালতের স্বীকারোক্তি, নিহতদের পরিবারের অভিযোগসহ নানা বিষয় নিয়ে তদন্ত চলছে। তবে, সত্য বেরিয়ে আসবে বলে জানান তিনি। বালাগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান আবদাল মিয়া জানিয়েছেন, আলোচনা এ জোড়া খুনের ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করা হোক সেটিই চায় বালাগঞ্জের মানুষ।

No comments

Powered by Blogger.