সব দলের মধ্যে সংলাপ জরুরি- মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ

দেশে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়ে ঢাকা ছাড়লেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। তিন দিনের সফরের সমাপনীতে গতকাল আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে দেশের চলমান  রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে সংলাপ আয়োজনের আহ্বানও পুনর্ব্যক্ত করে গেছেন তিনি। ওবামা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ওই কর্মকর্তা স্পষ্টই বলেছেন, এখানে একটি শক্তিশালী ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র দেখতে চায় তার দেশ। তাই সব দলের অংশগ্রহণে সংলাপ জরুরি। এক্ষেত্রে দেশের সব রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে দায়িত্বশীলতাও আশা করে যুক্তরাষ্ট্র। এ সময় সরকার ও বিরোধী দলগুলোর শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সমান সুযোগ সৃষ্টির ওপর জোর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচনের সময়ক্ষণ দেশের জনগণই নির্ধারণ করবেন। গুলশানে আমেরিকান ক্লাবে প্রায় এক ঘণ্টার ওই সংবাদ সম্মেলনে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা, দূতাবাসের প্রেস অফিসার মনিকা শাইসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের সঙ্গে র‌্যাব সদস্যদের সম্পৃক্ততা বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে নিশা দেশাই বলেন, এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ঘটনা ঘটছে সে বিষয়ে তার দেশ ও সরকার অবহিত। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে আসছে। এ সময় দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর তদন্ত এবং অপরাধের সঙ্গে যুক্তদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার আহ্বানও পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। জবাবদিহির মধ্যে থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পরিচালনার আহ্বান জানিয়ে মার্কিন মন্ত্রী বলেন, যে কোন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের সরকারের কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ।
বিএনপি নেতার সঙ্গে বৈঠকেও সংলাপ প্রসঙ্গ: সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে নিশা দেশাই বলেন, রাজনৈতিক সংলাপের বিষয়ে বিএনপি নেতার অবস্থানকে সমর্থন করে তার দেশ। ওই নেতার সঙ্গে বৈঠকে রাজনৈতিক সংলাপের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের কথা জানিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন মার্কিন সহকারী মন্ত্রী। বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কিত অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা যখন যেখানে যাই সব সময় সরকার ও বিরোধীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। গণতন্ত্র চর্চার অংশ হিসেবে আমরা তা করি। আমরা বিশ্বাস করি, একটি জাতি হিসেবে বাংলাদেশের শক্তি হচ্ছে এর গণতন্ত্র এবং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে বৈঠকে দেশের পরবর্তী নির্বাচন কবে জানতে চেয়েছিলেন মার্কিন ওই প্রতিনিধি। সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নোত্তর সেশনের শুরুতেই ওই বক্তব্যের বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে-নির্বাচনের সময়ক্ষণ দেশের জনগণই নির্ধারণ করবে উল্লেখ করে তিনি জানান, দুই দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিভাবে সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেয়া যায়, যুক্তরাষ্ট্র সে সব বিষয়ে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছি। বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সামনে এগোতে চাই।
জিএসপি ফেরতের প্রত্যাশা: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্য রপ্তানিতে জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব  প্রেফারেন্সেস) ফিরে পাওয়ার বিষয়ে নিশা দেশাই বলেন, এটা মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের কাজ। এই বিষয়ে আমার কোন অবস্থান নেই। বাংলাদেশের জিএসপি ফিরে পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ বস্ত্রখাতে অনেক উন্নতি করেছে। রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক কারখানার উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব উন্নয়ন জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে সহযোগিতা করবে। শ্রমখাতে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ এরই মধ্যে অনেক কিছু করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের শ্রমমানের উন্নয়ন, কর্মস্থানে শ্রমিকের নিরাপত্তা, ট্রেড ইউনিয়ন করার স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয় দেখার জন্য এখানে একটি মূল্যায়ন কমিটি রয়েছে। আমরা এসব কার্যক্রমকে উৎসাহিত করি।
এ সময় অপর এক প্রশ্নে আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঢাকা-ওয়াশিংটন এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি বলেও জানান নিশা দেশাই বিসওয়াল। গত ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগে (গত ১৬ নভেম্বর) নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশের যখন চরম অস্থিরতা চলছিল তখন ঢাকা সফর করেছিলেন মার্কিন ওই সহকারী মন্ত্রী। সে সময় রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে রাজনৈতিক নেতৃত্বতে সংলাপে বসার আহবানও জানিয়েছিলেন তিনি। ঠিক এক বছরের মাথায় দ্বিতীয় দফায় ঢাকা সফর করলেন তিনি। কাঠমাণ্ডুতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়ে বৃহস্পতিবার থেকে বাংলাদেশ সফর শুরু করেন তিনি। এখানে তিন দিন অবস্থান করে সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী জোটের নেতা বেগম খালেদা জিয়া, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভি, পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক, শ্রমিক অধিকার কর্মীসহ তৈরি পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে তার অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সার্ক শীর্ষ সম্মেলন প্রত্যক্ষ করেছি। এবারের সম্মেলনে বিদ্যুৎ সহায়তা চুক্তি খুবই ইতিবাচক।’
কেরির বার্তা পৌঁছে দিলেন: মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ওয়াশিংটন সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বিসওয়াল তার একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন বলে জানান বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে। তিনি এ-ও জানান, ওই সফরের জন্য দিনক্ষণ ঠিক করতে কাজও শুরু হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবেশসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে এবং এ অগ্রগতি অব্যাহত থাকুক তা আমরা দেখতে চাই। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব সংলাপের কথা স্মরণ করে বিসওয়াল বলেন, তার এ সফরও ওই সংলাপের ধারাবাহিকতা। বিসওয়াল বলেন, অভিন্ন লক্ষ্যের অনেক ক্ষেত্র আমরা পেয়েছি যেখানে আমরা সম্পর্ক গভীর ও জোরালো করতে চাই এবং এ সফরও ওই সংলাপের ধারাবাহিকতা। ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত ওই সংলাপে পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।
মজিনার প্রশংসা: যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার প্রশংসা করে মার্কিন সহকারী মন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে তিনি খুবই সোচ্চার ছিলেন। মজিনার উত্তরসূরিও তা অব্যাহত রাখবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনের শেষ লগ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, শনিবার হবিগঞ্জের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে তারও যোগ দেয়ার কথা ছিল। তবে সন্ধ্যায় উজবেকিস্তানের উদ্দেশে যাত্রা করতে হবে বিধায় সার্বিক পরিস্থিতি মিলিয়ে তিনি যেতে পারেননি বলে দুঃখ প্রকাশ করেন।

No comments

Powered by Blogger.