মতভেদের কারণে চুক্তিতে পূর্ণাঙ্গ সফলতা আসেনি

সদ্যসমাপ্ত সার্ক শীর্ষ সম্মেলন সফল হয়েছে বলে দাবি করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী। জানিয়েছেন, সম্মেলনে প্রতিটি বৈঠকেই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিগুলো স্বাক্ষরের বিষয়ে বাংলাদেশ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। সেই সঙ্গে সব সদস্য রাষ্ট্রের ঐকমত্যের জন্য চেষ্টা করেছে। কিন্তু সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মতভেদের কারণে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ সফলতা আসেনি। গতকাল সার্ক সম্মেলন নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনক্লস সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। এ সময় মন্ত্রী লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে সম্মেলনে গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি, প্রস্তাব ও বাংলাদেশের ভূমিকা তুলে ধরেন। পরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আসার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এর আগেই বাংলাদেশে আসতে আগ্রহী। আমাদের সংসদীয় প্রতিনিধি দলের কাছে তিনি এ আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে এ মাসের ১৮ই ডিসেম্বর থেকে ২১শে ডিসেম্বর আমাদের প্রেসিডেন্ট ভারতের প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে ভারত সফর করবেন। সার্ক সম্মেলনে গুরুত্বপূূর্ণ চুক্তিগুলোর বিষয়ে মাহমুদ আলী বলেন, শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং ঐকমত্যের কারণে সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা স্ব-স্ব দেশের পক্ষে জ্বালানি সহযোগিতা চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন। এর ফলে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ কেনা-বেচার পথ সুগম হবে। মোটর ভেহিকেল এবং রেলওয়ে সংক্রান্ত চুক্তি দু’টি স্বাক্ষরের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে তিন মাসের মধ্যে সার্ক পরিবহন মন্ত্রীদের বৈঠক করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। এছাড়া অন্যান্য অভিবাসন, ব্লু-ইকোনমি, ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়নের পরিকল্পনা, সার্ক ফুড ব্যাংকের থ্রেসহোল্ড বিলোপ, সার্ক সিড ব্যাংকের বোর্ড গঠনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, সম্মেলনের সাইডলাইনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বেশ কয়েকটি দেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের দ্বিপক্ষীয়  স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে বহুমাত্রিক এবং নিবিড় আন্তঃসংযোগ গড়ে তুলতে শীর্ষ নেতারা তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন এবং এসব সন্ত্রাস দমনে কার্যকর সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের বেশ কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসরত বিশ্বের মোট জনগণের প্রায় এক-চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কৃষিক্ষেত্রে বিদ্যমান সহযোগিতা আরও জোরদার করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে সার্ক ফুড ব্যাংক এবং সার্ক সিড ব্যাংক দ্রুত কার্যকর করতে আহবান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি এবং স্বাভাবিক খাদ্য সঙ্কটে সার্ক ফুড ব্যাংকের খাদ্যশস্য ব্যবহারের নিম্ন সীমা  ৮% অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সম্মেলনের ঘোষণায় কৃষি ক্ষেত্রে আরও বিনিয়োগ ও গবেষণা এবং  কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বিষয়ক সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারে জোর দেয়া হয়েছে। সার্ক আঞ্চলিক ভ্যাকসিন ব্যাংক এবং সার্ক লাইভস্টক জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও শীর্ষ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছে।  সার্কভুক্ত দেশসমূহের বাণিজ্য সম্প্রসারণে গৃহীত প্রস্তাব সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, সাফটার অধীনে বাণিজ্য সমপ্রসারণে বিভিন্ন অশুল্ক বাধা দূরীকরণে বাংলাদেশের প্রস্তাব সম্মেলনে গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবে রয়েছে  পণ্যের মান সুষমকরণ, কাস্টমস সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন সহজীকরণ, পণ্য পরিবহন প্রক্রিয়া সহজভাবে সম্পন্ন করণ। মন্ত্রী বলেন, সার্কের অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহের অভিবাসী কর্মীদের অভিবাসন প্রক্রিয়া সহজতর করার লক্ষ্যে শীর্ষ নেতারা একমত হয়েছেন। বাংলাদেশের সক্রিয় ভূমিকায় বহির্বিশ্বে এ অঞ্চলের অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা এবং কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য সার্কের আওতায় পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অংশীদারিত্বের মাধ্যমে কাজ করতে শীর্ষ নেতারা সম্মত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের বিষয়ে মাহমুদ আলী বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী দু’দেশের নিরাপত্তা সহযোগিতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। দুই প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর এবং স্থল সীমানা চুক্তি অনুসমর্থন এ দু’টি অনিষ্পন্ন বিষয়ের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয় দু’টি তাদের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন এবং এ বিষয় দু’টি নিষ্পন্ন করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশ সফরের আগ্রহ পুনর্ব্যক্ত করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নেপালের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠককালে দুই প্রধানমন্ত্রী দু’দেশের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এবং সার্ক দেশগুলোর স্ব-স্ব প্রাকৃতিক সম্পদের যৌথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ অঞ্চলের সমষ্টিগত সমৃদ্ধির ব্যাপারে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নেপালের বিপুল জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে আগ্রহ ব্যক্ত করেন। এছাড়া নেপালের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে ফার্মাসিউটিক্যালস সামগ্রী, তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, সিরামিক সামগ্রী এবং সবজি ও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য নেপালে আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেন । তিনি ব্যাংকিং খাত, ইন্স্যুরেন্স ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ‘জয়েন্ট ভেঞ্চারে’র সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। মন্ত্রী জানান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে দুই প্রধানমন্ত্রী দু’দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। পাকিস্তানের বিদ্যমান বিদ্যুৎ ঘাটতির কথা উল্লেখ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের অর্জিত সাফল্য বিশেষ করে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্বন্ধে জানতে চান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে তাকে অবহিত করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের অভিজ্ঞতা লাভের জন্য বাংলাদেশে প্রতিনিধি প্রেরণের আগ্রহ প্রকাশ করলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাতে স্বাগত জানান। তবে বাংলাদেশে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোন কথা হয়নি বলে মন্ত্রী জানান।

No comments

Powered by Blogger.