সংসদ এখন তাঁদের ঘর হয়ে গেছে -খালেদা জিয়া by গাজীউল হক

দেশে এখন এক ব্যক্তির শাসন চলছে। সংসদ এখন জন-প্রতিনিধিদের স্থান নয়, তাঁদের নিজেদের ঘর হয়ে গেছে।  গতকাল শনিবার বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে ২০-দলীয় জোটের জনসভায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘সামনের আন্দোলনে আমরা সামনে থাকব। তাই গুলি করে গদি রক্ষা হবে না। আমাদের আন্দোলন গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়।’
জনসভায় খালেদা জিয়া বরাবরের মতো দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), নির্বাচন কমিশন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, র্যাব, দমন-পীড়নসহ নানা বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করেন।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘এক ব্যক্তির নির্দেশে সমস্ত দুর্নীতি থেকে সরকারদলীয় মন্ত্রী-এমপিদের মুক্তি দিয়ে দুদক এখন দায়মুক্তি কমিশন হয়েছে। দুদকের নাম এখন দায়মুক্তি কমিশন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপির নেত্রী বলেন, কেউ নির্বাচনে যায়নি। কিন্তু তাদের আজ্ঞাবহ পা-চাটা নির্বাচন কমিশন দুই দিন পর্যন্ত ভোটের হিসাব মেলাতে পারেনি। তিন দিন পর বলছে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। অথচ ভোট পড়েছে মাত্র পাঁচ শতাংশ। যেখানে আওয়ামী লীগের লোকজনই ভোটকেন্দ্রে যায়নি, সেখানে এত ভোট কোথা থেকে এল। ভোটকেন্দ্রে কুকুর-ছাগল শুয়ে ছিল। ১৫৪টি সিটে কোনো নির্বাচন হয়নি। এঁরা অনির্বাচিত। এ পার্লামেন্ট সম্পূর্ণ অবৈধ। এই পার্লামেন্ট থেকে কোনো আইন পাস করার ক্ষমতা তাদের নেই।
এইচ টি ইমামের সাম্প্রতিক বক্তব্যের প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, এইচ টি ইমাম আওয়ামী লীগের নির্বাচন সমন্বয়ক ছিলেন। কীভাবে নির্বাচন ম্যানুপুলেট করেছেন, নিজেদের লোকদের বসিয়েছেন, ব্যালট বাক্সে ব্যালট পেপার ঢুকিয়েছেন—সব বলে দিয়েছেন। এত বড় সত্য প্রকাশের পর আওয়ামী লীগ ও এইচ টি ইমামের বিদায় নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, এইচ টি ইমাম মোস্তাকের কেবিনেটের লোক ছিলেন। যত রকমের শয়তানি ও কুবুদ্ধি তাঁর মাথায়। তাই এইচ টি ইমামের পেছনে নামাজ হবে না। এই ইমামের পেছনে না থাকলেই ভালো হয়।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘জাসদের একজন নেতা বলেছেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল নয়। গণতন্ত্রের পক্ষের দল নয়। যারা গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল নয়, তাদের দিয়ে দেশের কোনো কল্যাণ হবে না। রণাঙ্গনের সব মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সঙ্গে আছেন।’
তাঁর সরকারের আমলের উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, এখন সারা দেশে উন্নয়ন নেই। উন্নয়নের নামে তারা টাকা বরাদ্দ করে লুটপাট করে নিজেদের পকেটে ভরে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। অর্থমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন, অর্থনীতিতে স্থবিরতা কাটছে না। কর্মসংস্থান কমেছে প্রতি মাসে ১৯ শতাংশ। বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৮২ ভাগ। অর্থমন্ত্রী নিজেই নাখোশ। অর্থমন্ত্রীরও বলার কোনো ক্ষমতা নেই। কারণ ওই দলে (আওয়ামী লীগে) গণতন্ত্র নেই। এক ব্যক্তির শাসন ও শোষণ চলছে।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘তারা (আওয়ামী লীগ) নিজেদের মামলা বাদ দিয়ে আমাদের নামে নতুন নতুন মামলা দিচ্ছে। হাসিনার নামেও ১৫টি মামলা ছিল। এগুলো প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তার আমলে মিগ-২৯ কেনা হয়েছিল। সেটা ছিল পুরাতন। এটা জালিয়াতি করে কিনেছে। এ মামলাগুলোতে হাসিনার সাজা হতো।’ তিনি বলেন, জজ সাহেবদের হাত-পা বেঁধে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। হাসিনা যা বলবে তাই হবে। যে জজ সাহেব নিরপেক্ষ বিচার করবেন, তাঁদের চাকরি থেকে বহিষ্কার ও বিদায় করে দেওয়া হবে।
ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কঠোর সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘এসব লীগদের কাজ হলো জমি-বাড়ি দখল করা, টেন্ডারবাজি ও ভর্তি বাণিজ্য করা। পুলিশ এগুলো দেখে না। তাদের ধরে না। বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধরে।’
র্যাবের প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ‘র্যাব আমরাই প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। সেই র্যাব হয়ে গেছে এখন খুনি। গুম, খুন তাদের কাজ। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় আওয়ামী লীগের গডফাদার, র্যাব ও পুলিশ জড়িত। আসল লোক এখনো পর্দার অন্তরালে। কর্নেল জিয়াকে না ধরা পর্যন্ত র্যাবের গুপ্ত হত্যা বন্ধ করা যাবে না। অবিলম্বে র্যাবকে বাতিল করতে হবে। র্যাব এখন যাকে ইচ্ছে তাকে তুলে নিয়ে যায়। মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করে। র্যাব এখন মানুষ খুন করা বাহিনী। তারা এখন ভাড়া খাটে। জিয়াকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। র্যাব লাকসামের হিরু ও পারভেজকে তুলে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের বহু লোককে খুন করেছে।’
সরকারদলীয় সাংসদ আবদুর রহমান ওরফে বদির প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বদি ড্রাগের ব্যবসা করছে। সেই এমপিকে বেল দেওয়া হলো। একজন চোরাকারবারিকে বেল দেওয়া হলো। অথচ আমাদের দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বেল দেওয়া হচ্ছে না। তাঁদের গাড়ি পোড়ানোর মামলায় কারাগারে রাখা হয়েছে।’
বিডিআর হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, পিলখানার জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী। পিলখানায় রাতের ডিনারে শেখ হাসিনা যাননি। এই প্রথমবারের মতো হাসিনা যাননি। তারা ৫৭ জন অফিসারকে হত্যা করেছিল। পত্রিকায় এসেছে, মইন (জেনারেল মইন উ আহমেদ) স্বীকার করেছেন তিনি দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পাননি। তাই তিনি সেখানে লোক পাঠাতে পারেননি। হাসিনা তাঁর অফিসে মইনকে বসিয়ে রেখেছিলেন। তাই তিনি লোক পাঠাতে পারেননি। যদি আর্মি পিলখানায় যেত, সব অফিসারকে উদ্ধার করা যেত।
বিদ্যুৎ, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির চক্রান্ত প্রতিরোধ, গুম, খুন, গুপ্ত হত্যা বন্ধ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে গণসংযোগের অংশ হিসেবে এই জনসভা ডাকা হয়।
জনসভায় সভাপতিত্ব করেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি বেগম রাবেয়া চৌধুরী। বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার, মওদুদ আহমদ, রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি অলি আহমদ, জাতীয় পার্টির সভাপতি আন্দালিব রহমান, কল্যাণ পার্টির সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম, জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. মনিরুল হক, সাবেক সাংসদ মনিরুল হক চৌধুরী, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শওকত মাহমুদ প্রমুখ।
এর আগে জনসভায় আসার পথে কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার বাগমারা এলাকায় নাঙ্গলকোট উপজেলা বিএনপির নেতা-কর্মীদের ৩০টি বাস ভাঙচুর করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.