সামাজিক ব্যবসা এখন আর কোন অলীক স্বপ্ন নয় by মতিউর রহমান চৌধুরী

সামাজিক ব্যবসা এখন আর অলীক স্বপ্ন নয়। অনেকটাই বাস্তব। পৃথিবীর দেশে দেশে এই ব্যবসা এখন শুরু হয়ে গেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল জয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস যখন সামাজিক ব্যবসা তত্ত্বের সূচনা করেছিলেন তখন দুনিয়ার বহু অর্থনীতিবিদ সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, প্রফেসর ইউনূসের জন্য এটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হবে। কারণ, তার মূল প্রতিপক্ষ পুঁজিবাদ। এ পুঁজিবাদ ভেদ করে তার পক্ষে এ নতুন তত্ত্ব নিয়ে সামনে যেতে পারবেন এটি আসলেই কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে। বাংলাদেশের কেউ কেউ ঠাট্টা মশকারা করেছিলেন। এখন তারা কি বলছেন জানা যায়নি। কিন্তু তামাম দুনিয়ায় এক আলোড়ন তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ইটালি, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কানাডা থেকে শুরু করে ইসরাইল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে সামাজিক ব্যবসার এ ঢেউ। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মাত্র ১০ বছরের মাথায় বুঝতে সক্ষম হয়েছে এটি থামবার মতো কিছু নয়। এটি ধারণা হিসেবে নতুন হতে পারে, কিন্তু এই ব্যবসা একটি সামাজিক আন্দোলনের রূপ পেতে চলেছে। তাই তারা এই কাফেলায় যোগ দিতে শুরু করেছেন। মেক্সিকো শীর্ষ সম্মেলনে তাই দেখা গেল।
সামাজিক ব্যবসা তত্ত্বের জন্য প্রফেসর ইউনূস অবশ্য এখনই চূড়ান্ত কোন মন্তব্য করতে রাজি নন। তিনি শুধু হাসলেন। একটু থেমে বললেন, সাফল্য আসছে এটি ঠিক। উৎসাহ পাচ্ছি, আনন্দ পাচ্ছি। এখানে থেমে থাকলে চলবে না। এটিকে ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বের আনাচে-কানাচে।
জিজ্ঞেস করেছিলাম সাফল্যের মূল কারণ কি? জানালেন, কারণ একটাই। মানুষ চায় পরিবর্তন। কারণ পুঁজিবাদী বিশ্ব আমাদের এক ধরনের ঘোরের মধ্যে রেখেছিল। মানুষ বেকারত্বে জর্জরিত ছিল। দিশা পাচ্ছিল না। সামাজিক ব্যবসার এ ধারণা তাদের সামনে চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে। কারা আসবে এই ব্যবসায়? কারা আসেনি? নারী-পুরুষ সবাই যোগ দিয়েছে। যারা দীর্ঘকাল বেকারত্বে জর্জরিত ছিল তারা এগিয়ে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, এনজিও কর্মী, ব্যবসায়ী, বিশ্বের নামীদামি বহুজাতিক কোম্পানি তাদের পদস্থ কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছে। তারা তাদের মত তুলে ধরেছেন। একক মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যবসা থেকে বেরিয়ে এসে তারা সবাই আরেকটি ব্যবসা সৃষ্টির কথা ভাবছেন। এটাই সামাজিক ব্যবসার সাফল্য। মানুষের মঙ্গল সৃষ্টি করা। এই মঙ্গলের জন্য তারা কি ভাবছে, কি করছে- সম্মেলনগুলোতে এটি নিয়েই মূলত আলোচনা হয়, বললেন প্রফেসর ইউনূস।
মেক্সিকো সম্মেলনের প্রাপ্তি কি কি? ৫০টি দেশের ৭৫০ জন প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন। সবার সঙ্গে কথা হলো। দেখা হলো। তাদের বক্তব্য শুনলাম। তাদের ধারণা পাওয়া গেল। তরুণ ছেলে-মেয়েরা তাদের স্বপ্নের কথা জানালো। শুধু তা-ই নয়। অভাবক্লিষ্ট মানুষগুলোর কথা যেভাবে এসেছে তা নিয়ে নতুন করে ভাববার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ছোট ছোট পুঁজি নিয়ে অনেকে এই ব্যবসায় যোগ দিতে চান। মেক্সিকো সম্মেলন থেকে তাদেরকে স্বাগত জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, বসে থাকবেন না। সব কিছু ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেবেন না। মনে রাখতে হবে, বেকার হয়ে কেউ জন্ম নেয় না। নিজেকেই নিজের ভাগ্য গড়তে হবে। পুঁজি হারানোর কোন ভয় নেই। পুঁজির সম্প্রসারণ হচ্ছে সামাজিক ব্যবসার অন্যতম লক্ষ্য। বহুজাতিক কোম্পানি সম্পর্কে আবারও বললেন, তারা এগিয়ে আসায় সামাজিক ব্যবসার সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হয়েছে।
শীর্ষ সম্মেলনে ইসরাইলের প্রতিনিধি মেয়োজ ইনন তার সাফল্যের কথা তুলে ধরলেন। জানালেন তার ফৌজি আজারিন প্রকল্পের আশাতীত সাফল্যের কথা। প্রফেসর ইউনূস বহুবার ইসরাইল থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। কিন্তু নানা কারণে তিনি যাননি। তবুও ব্যবসা থেমে যায়নি। প্রফেসর ইউনূস বললেন, তার উপস্থিতি ব্যবসাকে উৎসাহিত করে এটা ঠিক- কিন্তু ইন্টারনেটের যুগে ব্যক্তিগত উপস্থিতি মুখ্য নয়।
দু’দিনের সম্মেলন শেষে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে পরবর্তী সম্মেলনের ঘোষণা দেয়া হয়। প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে স্প্যানিশ ভাষায় সিএনএন বিশাল এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তারা প্রফেসর ইউনূসকে গরিব মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, ইউনূস সত্যিকার অর্থে নতুন এক স্বপ্নের জন্ম দিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.