খালেদা সংসদে না থাকায় খিস্তিখেউর শুনতে হয় না

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনে (৫ জানুয়ারি) না আসায় ভালো হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘এক অর্থে ভালোই হয়েছে, পার্লামেন্টে এখন আর কারও খিস্তিখেউর শোনতে হয় না। সংসদ ভদ্রভাবে চলছে, ভালোভাবে চলছে। সংসদের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে।’ হবিগঞ্জের নিউফিল্ডে আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী হবিগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে ১৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে সুধী সমাবেশেও অংশ নেন তিনি। জনসভায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা তুলে দিয়ে লাখো শহীদের সঙ্গে বেঈমানী করেছেন। সেই যুদ্ধাপরাধীদের আজ বিচার হচ্ছে, রায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা তুলে দেয়ার অপরাধে একদিন খালেদা জিয়ারও জনগণের আদালতে বিচার হবে। আওয়ামী লীগ মানেই উন্নয়ন এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দেশের মানুষ শান্তিতে থাকে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আর বিএনপি মানে বিদ্যুৎ ও খাদ্যে ভাটার টান। বিএনপির সময় গ্রেনেড-বোমা হামলার উন্নয়ন হয়েছে। দুর্নীতির উন্নয়ন হয়েছে। মানি লন্ডারিংয়ের উন্নয়ন হয়েছে। সন্ত্রাসের উন্নয়ন হয়েছে। খালেদা জিয়া ও বিএনপি নেতারা কিভাবে নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন করবেন তা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, যারা এতিমদের টাকা মেরে খায় তারা কিভাবে দেশের উন্নয়ন করবে। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহির এমপি জনসভায় সভাপতিত্ব করেন। জনসভায় বক্তৃতা করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিজবাহ উদ্দিন সিরাজ, জেলা সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান এমপি, অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী এমপি, আমাতুল কিবরিয়া চৌধুরী কেয়া এমপি, যুবলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক আতিক ও হবিগঞ্জ জেলা পরিষদ প্রশাসক ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী। আরও বক্তব্য দেন শহীদ উদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী টিপু, আরব আলী, মো. শরীফ উল্লাহ, অ্যাডভোকেট আলমগীর ভূঁইয়া বাবুল, আলমগীর চৌধুরী, জাকির হোসেন চৌধুরী অসীম, মশিউর রহমান শামীম, বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, শফিকুর রহমান চৌধুরী, অ্যাডভোকেট নিলাদ্রী শেখর পুরকায়স্থ টিটো, সভাপতি, মো. মোতাচ্ছিরুল ইসলাম, আতাউর রহমান সেলিম, সৈয়দ কামরুল হাসান, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী পাঠান প্রমুখ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ‘উন্নয়নের’ জোয়ারে সারা দেশে বিদ্যুৎ-গ্যাসের উৎপাদন কমে গিয়েছিল। সারা দেশে একযোগে বোমা হামলা হয়েছিল। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ সিলেট অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর বোমা-গ্রেনেড হামলা হয়। শেখ হাসিনা বলেন, কিবরিয়া হত্যার চার্জশিট দেয়া হয়েছে। আশা করি বিচারও শেষ করতে পারব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই দেশে শিক্ষার হার ৯৮ শতাংশ হোক। এজন্য আমরা বিনামূল্যে বই বিতরণ, বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ ও ছাত্রছাত্রীদের ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে ১৪ বিষয়ে অনার্স ও ৫ বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু করেছি। অবিলম্বে হবিগঞ্জে একটি মেডিকেল কলেজ এবং সরকারি বা বেসরকারি যাই হোক একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যবস্থা করব। শায়েস্তাগঞ্জকে উপজেলা করার চেষ্টা করা হবে বলেও জানান তিনি।
খালেদা জিয়ার সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি চান না ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করুক। কারণ তিনি নিজে ম্যাট্রিক পাস করেছেন। তাও মাত্র দু’বিষয়ে। একটি হচ্ছে উর্দু, অন্যটি অংক। কারণ তার হৃদয় পড়ে থাকে পাকিস্তানে। আর অংকে পাস করেছেন- কারণ দুর্নীতির হিসাব করতে হবে। তিনি দুর্নীতি খুব ভালো বোঝেন। দেশে উন্নয়ন করেছেন লুটপাটের।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক করেছিলাম। তারা ক্ষমতায় এসে সড়কের প্রস্থ কমিয়েছে। সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা একটি বাড়ি একটি খামার করেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি। গ্রামগঞ্জে ইন্টারনেট ছড়িয়ে দিয়েছি। যাদের পরিবারের লোকজন বিদেশে আছে, তারা ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে স্বজনদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে সরাসরি কথা বলতে পারে। এখন গ্রামে বসে মানুষ আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছে। এখন কেউ কোনো জামানত ছাড়া ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারছে। প্রবাসীদের জন্য কল্যাণ ব্যাংক করে দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী হবিগঞ্জে পৌঁছেই শায়েস্তাগঞ্জ এবং বানিয়াচং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন, হবিগঞ্জ আধুনিক স্টেডিয়াম, ডায়াবেটিক হাসপাতাল, জেলা পরিষদ অডিটোরিয়াম, শিল্পকলা একাডেমি ভবন, আলেয়া-জাহির কলেজ, আনসার ও ভিডিপির জেলা কমান্ডেন্টের অফিস, হবিগঞ্জ কেন্দ্রীয় ঈদগাহ উন্নয়ন কার্যক্রম উদ্বোধন এবং আজমিরীগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি সদস্যের সমন্বয়ে জেলাজুড়ে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় জনগণের চলাচল সীমিত করা হয়।
১৪ বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হবিগঞ্জ জেলা সদরে আসেন শনিবার। নেতাকর্মীরা তাকে দেখতে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় ছিলেন। সকাল ১০টা থেকেই জনসভাস্থলে মানুষ আসতে শুরু করে। দুপুর ১২টার মধ্যে মাঠ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। জনতার ঢল গিয়ে গড়ায় পার্শ্ববর্তী বাইপাস সড়কসহ আশপাশের এলাকা পর্যন্ত। প্রধানমন্ত্রী বিকাল তিনটায় জনসভাস্থলে আসেন। চলে যান চারটায়।
সকাল থেকেই প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে মিছিলে মিছিলে মুখরিত হয়ে ওঠে জেলা সদরসহ জনসভাস্থলের আশপাশের এলাকা। জেলার প্রবেশদ্বার মাধবপুর থেকেই তোরণ নির্মাণ করা হয়। সাঁটানো হয় হাজারও ব্যানার-ফেস্টুন। আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, লাখাই উপজেলাও এ থেকে বাদ যায়নি। জেলাজুড়ে নির্মাণ করা হয় প্রায় দেড় হাজার তোরণ। সরকারি, আধাসরকারি স্থাপনাগুলোয় দেয়া হয় রঙ। বিশেষ করে ঈদগাহ থেকে সার্কিট হাউস রোড হয়ে প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তা, বৃন্দাবন কলেজ রোডের সবগুলো দেয়াল ভবন সাজানো হয় বর্ণিল সাজে।
নবীগঞ্জবাসী কী গ্যাস পাবে? : আমাদের নবীগঞ্জ প্রতিনিধি সরওয়ার শিকদার জানান, দুপুরে বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ড সম্প্রসারণ এবং বিবিয়ানা-ধনুয়া গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইনে সরবরাহ উদ্বোধন ও সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ড এলাকায় গ্যাসের দাবি যুক্তিসঙ্গত। যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ প্লান্ট এবং গ্যাসফিল্ড রয়েছে সেসব এলাকায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ দেয়ার দাবি যৌক্তিক।’ কিন্তু নবীগঞ্জবাসী গ্যাস পাবে কিনা তা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি।
বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ড হচ্ছে আমাদের অহংকার ও গর্বের সম্পদ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের মোট বাণিজ্যিক জ্বালানির শতকরা ৭৩ ভাগ গ্যাস থেকে মেটানো হয়। গ্যাস আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে বড় ভূমিকা রাখছে।
সুধী সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন খনিজ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। অতিথির বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম চৌধুরী এমপি, হবিগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য এমএ মুনিম চৌধুরী বাবু, শেভরন এশিয়ান প্যাসিফিক চেয়ারম্যান মায়ার মেলোডি, শেভরন বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জেমস স্ট্রং, জ্বালানি খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ সচিব আবু বকর সিদ্দিক। স্বাগত বক্তব্য দেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ইশতিয়াক আহমেদ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ আনন্দঘন মুহূর্তে নবীগঞ্জবাসীকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। তবে দুই রাজনৈতিক নেতার কথা মনে পড়ায় আমার মন ভীষণ ভারাক্রান্ত। তারা হচ্ছেন সাবেক সংসদ সদস্য দেওয়ান ফরিদ গাজী ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। বিবিয়ানা-ধনুয়া গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন হচ্ছে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ ব্যাসবিশিষ্ট পাইপলাইন। প্রধানমন্ত্রী এছাড়াও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক থেকে বিবিয়ানা পাওয়ার প্লান্ট সংযোগ সড়ক, নবীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন উদ্বোধন করেন। বিবিয়ানা দক্ষিণ ও বিবিয়ানা উত্তর নামে পৃথক দুটি ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ প্লান্ট, নবীগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও বিজনা ব্রিজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে তিনি বিবিয়ানা ৩৪১ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণকাজ পরিদর্শন করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক, সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী, সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস সহিদ এমপি, হুইপ সাহাব উদ্দিন এমপি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিছবাহ উদ্দিন সিরাজ, শেভরন বাংলাদেশের সিকিউরিটি ডাইরেক্টর মেজর হাসনাইন চৌধুরী প্রমুখ।
বিবিয়ানায় দুপুর ১২টায় ৩টি হেলিকপ্টারে সফরসঙ্গীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডের পাশে নির্মিত হেলিপ্যাডে অবতরণ করেন। বেলা ২টা ১০ মিনিটে তিনি হবিগঞ্জের নিউফিল্ডের উদ্দেশে বিবিয়ানা ত্যাগ করেন।

No comments

Powered by Blogger.