জামায়াতের পিছুটান by রাজীব আহাম্মদ

বিএনপির নিষ্ক্রিয়তা, যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান, চরম পন্থা নিয়ে দলে মতবিরোধে পিছু হটেছে জামায়াতে ইসলামী। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে সর্বাত্মক 'আন্দোলন' কর্মসূচিতে নামে দলটি। এর পরের এক বছরে দলটি এককভাবে ৩১ দিন দেশব্যাপী হরতাল করে। জামায়াতের হরতাল মানেই ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানি। জোটের হরতালে কিছুটা নমনীয় থাকলেও রাজপথে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষে সরব ছিল জামায়াত। কিন্তু গত এক মাসে দলটি অনেকটাই পিছু হটেছে। জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবির দলীয় কর্মসূচিতে যতটা সরব থাকে, জোটের কর্মসূচিতে ততটাই থাকে নিষ্ক্রিয়। গত ২৫ নভেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরদিন থেকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের লাগাতার অবরোধে রাজপথে অনেকটা এককভাবেই শক্তি প্রদর্শন করে জামায়াত। গত ১২ ডিসেম্বর দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুুল কাদের মোল্লার রায় কার্যকরের পর দেশের অনেক জেলায় চলে সহিংসতা। জামায়াতের হিসাবেই এর পরের চার দিনে প্রাণ হারান অন্তত ৪৮ জন। তাদের মধ্যে ২৭ জনই দলটির নেতাকর্মী। কাদের মোল্লার
মৃত্যুদণ্ডের পর সাতক্ষীরা, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, যশোর, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার জেলাকে অচল করে দেয় জামায়াত-শিবির। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এসব জেলার। কিন্তু চার দিনের বেশি টিকতে পারেনি। যৌথ বাহিনীর অভিযানে পিছু হটতে বাধ্য হয় তারা। ১৮ দলের ডাকা 'মার্চ ফর ডেমোক্রেসি'তেও মাঠে নামতে পারেনি জামায়াত।
জামায়াতের এ পিছু হটার অন্যতম কারণ বিএনপির নিষ্ক্রিয়তা। বিএনপি রাজপথে নামতে না পারায় জামায়াতও এককভাবে নামতে পারছে না। দলটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জামায়াতের ব্যাপারে যতটা কঠোর, বিএনপির ব্যাপারে ততটা নয়। জামায়াতের ঢাকা মহানগর মজলিসে শূরা সদস্য আবদুুল হাকিম সমকালকে বলেন, 'বিএনপির মিছিল পুলিশ লাঠিপেটা কিংবা টিয়ার গ্যাসের শেল ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আর জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা রাস্তায় নামলেই গুলি। এমন পরিস্থতিতে রাজপথে নামা নিশ্চিত প্রাণহানি ছাড়া আর কিছু নয়।'
জোটগত আন্দোলন চললেও বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে সমন্বয় নেই। মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচিতে সমন্বয়ের অভাব প্রকটভাবে প্রকাশ পায়। কর্মসূচি নিয়ে একই সুরে কথা বললেও বিএনপি-জামায়াত কিংবা ছাত্রদল-শিবিরের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না।
অতীতে ১৮ দলের কর্মসূচির আগেই মহানগরের যৌথ প্রস্তুতি সভা হতো। গত ২৫ অক্টোবরের সমাবেশের আগেও সমন্বয় সভা হয়। মার্চ ফর ডেমোক্রেসিকে ঘিরে তার কিছুই হয়নি। বিএনপি নেতারা আত্মগোপনে থাকায় এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে বলে জানান ঢাকা মহানগর জামায়াতের নেতারা। গত তিন বছর ধরেই জামায়াত নেতারা আত্মগোপনে থাকলেও কর্মসূচির আগে প্রস্তুতি সভায় ঠিকই যোগ দিতেন। এখন তেমন সভা দূরে থাক দুই দলের মধ্যে কর্মসূচি নিয়ে যোগাযোগ পর্যন্ত নেই।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছাত্রদল ও শিবিরের মধ্যে। বিগত দুই বছরে যেখানেই ১৮ দলের কর্মসূচি হয়েছে সেখানেই সংঘর্ষে জড়িয়েছে এ ছাত্র সংগঠন দুটি। গত ২৫ অক্টোবরের সমাবেশেও কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতেই সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রদল-শিবির। ছাত্রদলের একাংশ শিবিরবিদ্বেষী। শিবিরেও একই অবস্থা। তবে শিবিরের সহ-প্রচার সম্পাদক জামাল উদ্দিন সমন্বয় না থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি সমকালকে বলেন, 'পরিস্থিতির কারণেই এমন হচ্ছে। ছাত্রদল-শিবির দুই সংগঠনের শীর্ষ নেতারা জেলে। ছাত্রদলে আবার কমিটি নিয়ে মতবিরোধ।'
গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে সারাদেশে নাশকতা প্রতিরোধে অভিযানে নেমেছে যৌথ বাহিনী। গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর থেকে দেশের অন্তত ১৪ জেলায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছিল জামায়াত। হরতালে সড়ক অবরোধ, সেতু ভেঙে ফেলা, যানবাহনে আগুন দেওয়াসহ সহিংস পদ্ধতিতেই চলছিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ। যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে জামায়াত পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। জামায়াত অভিযোগ করছে, এ অভিযানে অন্তত দলীয় ১৩ নেতাকর্মী নিহত হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে ৮০০ নেতাকর্মী।
জামায়াত সূত্র জানায়, যাদের নেতৃত্বে এসব জেলায় আন্দোলন চলত, যারা শহর ছাড়াও গ্রাম-গঞ্জের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখত, তাদের অধিকাংশই এ অভিযানে আটক হয়েছে। সাতক্ষীরার আগরদাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা আনোয়ারুল ইসলামকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মেহেরপুরের আমঝুপি ইউনিয়ন জামায়াতের আমির আবদুুল জব্বার 'ক্রসফায়ারে' নিহত হয়েছেন। যারা আটক হননি তারাও ক্রসফায়ার আতঙ্কে আত্মগোপনে।
জামায়াতের অভ্যন্তরেও সহিংস আন্দোলন নিয়ে রয়েছে মতবিরোধ। কট্টরপন্থি ও চরমপন্থার সমর্থক হলেও দলের উদারপন্থিরা সহিংসতার বিরোধী। জামায়াতের অভ্যন্তরে অনেক দিন ধরেই এ গুঞ্জন থাকলেও গত ১৫ ডিসেম্বর সহিংসতা চলমান অবস্থায় দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুুর রাজ্জাকের বিবৃতিতে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। জামায়াতের সহিংস আন্দোলনেকে ভুল হিসেবে আখ্যা দেন তিনি। জামায়াতের বর্তমান কর্মপদ্ধতিকে সমর্থন করছেন না শিবিরের এক সময়ের কেন্দ্রীয় নেতারাও। যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকানোর নামে সহিংসতার কারণে তারা ছাত্রজীবনে শিবির করলেও জামায়াতে যোগ দিচ্ছেন না। শিবিরের সাবেক কার্যকরী পরিষদ সদস্য মাহমুদুল হাসান সমকালকে বলেন, 'দিবালোকের মতো স্পষ্ট সত্য_ বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে নির্যাতিত দল জামায়াত। কিন্তু জামায়াত তার প্রতিক্রিয়ায় যা করছে, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।'

No comments

Powered by Blogger.