একাত্তরে রণাঙ্গনের দিনগুলো by মোহাম্মদ বদিউজ্জামান

১৯৭১ সালের রণাঙ্গনের দিনগুলোর কথা এখনও স্পষ্ট। আমাদের কত স্বপ্ন ছিল। মানুষ আমাদের কত সম্মান ও শ্রদ্ধা করত। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে, স্বাধীন করতে সেদিন আমরা যারা অস্ত্র ধরেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম তাদের বেশিরভাগই আজ স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় কাতর। তারপরও সান্ত্বনা যে, বাংলাদেশের জনগণকে উপহার দিয়েছি স্বাধীন জাতির মর্যাদা।
তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। পাকিস্তান আর্মি নিরস্ত্র জনগণের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলার সীমাবাড়ীর প্রান্তসীমায় আমরা কয়েকজন বন্ধু সিদ্ধান্ত নিলাম, যুদ্ধে যাব। কয়েকদিন পর ভোরের আলো ফোটার আগেই চিড়া-মুড়ি, যবের ছাতু ও গুড় সঙ্গে নিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হলাম। প্রথমে ৪০ মাইল আঁকাবাঁকা পথে হেঁটে পাবনার সাঁথিয়া থানার করঞ্জা গ্রামে পেঁৗছি। সেখান থেকে হেঁটে ভারতের জলঙ্গিতে পেঁৗছি। সেখান থেকে চুয়াডাঙ্গায় এক ট্রানজিট ক্যাম্পে উঠলাম। পতিরামপুর ট্রানজিট ক্যাম্পে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন শিরহীর নেতৃত্বে কয়েকদিন ট্রেনিং হয়। এরপর বহু প্রত্যাশিত হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য দার্জিলিংয়ের পানিঘাটায় ৩০ দিনের ট্রেনিং শুরু করলাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চার হাজার ফুট ওপরে পাহাড়ের পাদদেশে আমাদের ট্রেনিং হলো। কীভাবে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, অ্যামবুশ, পাচওয়ার্ড ইত্যাদি বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ ট্রেনিং হলো।
ট্রেনিং শেষে দেশে ঢোকার পর আমাদের প্রথমে পাঠানো হলো বিনোদপুর, খাসেরহাট ও তেলিপুকুরে। গলাপানি পার হয়ে আমরা খাসেরহাটে পেঁৗছলাম। সেখানে প্রথম রাজাকারদের সঙ্গে আমাদের গুলিবিনিময় হয়। খাসেরহাট ও তেলিপুকুরে কয়েকদিন থাকার পর এলাম কলাবাড়ী। শিবগঞ্জ থানার মহানন্দা নদীর পূর্ব পাড়ে আমবাগানের ভেতর বাঙ্কারে অবস্থান নিলাম। পাকবাহিনী নদীর পশ্চিম পাড়ে স্কুলঘরে ও আশপাশে পাকা বাঙ্কারে অবস্থান করছিল। আমাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরসহ বেশকিছু সেনা অফিসার ও জওয়ান যোগদান করলেন। একদিন সোনামসজিদ থেকে বাঁধ ধরে রেকিতে (সম্ভাব্যতা যাচাই) বের হলাম। পথে একটি মাটির বাড়ির পাটশোলার বেড়ার আড়াল থেকে জীর্ণ কাপড় পরা এক মধ্যবয়সী মহিলা ইশারায় আমাকে ডাকলেন। যুদ্ধের নিয়ম উপেক্ষা করে আমি সেই বাড়িতে ঢুকলাম। তার বাবা ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে আছেন। তিনি আমার দুই হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, মুক্তিযোদ্ধারা যেন তাদের মহাকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেন। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর অত্যন্ত সাহসী যোদ্ধা। তিনি সোনামসজিদে আসার পর সীমান্ত অবস্থার উন্নতি হয়। মনে পড়ে গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত লেফটেন্যান্ট ইদ্রিসকে সোনামসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়েছিল। কুদ্দুস ভাই কলেজের অধ্যাপক। বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায়ও আমাদের সহযোগিতা করেছেন। সেখানে আমরা অনেক রাজাকার ধরে ছিলাম। সেখান থেকে প্রায়ই গভীর রাতে ভারতীয় ট্যাংক বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আঘাত করত। একসময় আমাদের দিনাজপুর সীমান্তে পাঠানো হলো। সেখানে পাকবাহিনীর গুলি এবং মর্টার শেলিংয়ে আমাদের বেশ কয়েকজন আহত হলেন। তারপর আমরা আবার তরঙ্গপুর ক্যাম্পে এলাম। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার জন্য সিরাজগঞ্জে লতিফ মির্জাকে এবং শাহজাদপুরে আমিসহ ১২১ জনকে পাঠানো হয়।
সর্বশেষ আমরা তখন শাহজাদপুর থানার কোনো এক গ্রামে ছিলাম। ১৫ ডিসেম্বর শুনলাম টাঙ্গাইল থেকে ৩০-৩৫ জন পাকসেনা যমুনা নদী পার হয়ে নদীর পশ্চিম পাড়ে ধিতপুর গ্রামে ব্রহ্মপুত্র ফ্লাড কন্ট্রোল বাঁধের পাশে এক সিড গোডাউনের পাশে আশ্রয় নিয়েছে। উদ্দেশ্য নগরবাড়ী হয়ে ঢাকার দিকে যাওয়া। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মেরে ফেলবে। আমরা তখন ধিতপুরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। আমাদের পেছনে শত শত গ্রামবাসী অংশ নিল। আমরা পাকবাহিনীর বাঙ্কারের প্রায় ১৫-২০ গজের মধ্যে একটা বাড়ির আমগাছের আড়ালে থেকে একযোগে এলএমজি ও রাইফেলের গুলি শুরু করি। গভীর রাতে রাজাকারদের অনবরত গুলি করার নির্দেশ দিয়ে পাকসেনারা হুরাসাগর নদী পার হয়ে নগরবাড়ীর দিকে চলে গেছে। সকালে আমরা কয়েকজন রাজাকারকে পেলাম। আমাদের কয়েকজন সহযোদ্ধা আহত হলেন এবং তাদের মধ্যে বর্তমান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর ভাই আবদুল খালেক অন্যতম। তাকে বাঁচাতে পারিনি। শুধু ভালো ট্র্রিটমেন্টের অভাবেই অনেকে মারা গেছেন। আমার সঙ্গে যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন অনেকের নামই ভুলে গেছি। তবে ভুলিনি সাধারণ মানুষের আন্তরিকতা ও অভাবনীয় সহযোগিতার কথা। অনেক সহযোদ্ধাকে রণাঙ্গনে হারিয়েছি। তাদের জন্য আজও মন কাঁদে।
মোহাম্মদ বদিউজ্জামান : মুক্তিযোদ্ধা

No comments

Powered by Blogger.