জঙ্গিদের ঔদ্ধত্য রুখতে হবে

(বাংলাদেশকে তালেবানি হুমকি) পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলার যে হুমকি নিষিদ্ধ ঘোষিত টিটিপির (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) পক্ষ থেকে এসেছে, সেটা একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তার দোসরদের ঔদ্ধত্য ছাড়া কিছু নয়। পাকিস্তানি সংবাদপত্র নেশনের প্রতিবেদনে এটা স্পষ্ট যে, মহান মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দোষী প্রমাণিত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরই সন্ত্রাসী এই গোষ্ঠীটিকে ক্ষুব্ধ করেছে। বস্তুত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর দেশে ও বিদেশের কিছু চিহ্নিত মহল এমন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। খোদ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদেও পাস হয়েছে নিন্দা প্রস্তাব। আমরা জানি, একাত্তরে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর যে গোষ্ঠী হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল এবং যারা তাদের দোসরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, গত চার দশকের বেশি সময়ে তারা নানা কায়দায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়েছে। ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধে তাদের দিক থেকে হুমকি, চাপ সৃষ্টি, অর্থ বিনিয়োগ ও কূটকৌশল অস্বাভাবিক নয়। তারপরও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে কলঙ্কমুক্ত করার উদ্যোগ থেমে থাকবে না বলে আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু তাই বলে টিটিপির হুমকিকে হালকাভাবে নেওয়ার অবকাশ নেই। রাষ্ট্রহীন এই জঙ্গি গোষ্ঠীরা কতটা অবিমৃষ্যকারী ও নৃশংস হতে পারে আমরা জানি। পাকিস্তান ছাড়াও উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাদের চোরাগোপ্তা ও আত্মঘাতী হামলায় অনেক মূল্যবান প্রাণ হারাতে হয়েছে। বাংলাদেশকেও এ ধরনের জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলা মোকাবেলা করতে হয়েছে। জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় বর্তমান সরকারের আন্তরিকতা, উদ্যোগ ও পদক্ষেপের কারণে এ দেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো এখন আগের মতো সাবলীল তৎপরতা পরিচালনা করতে পারছে না। বাংলাদেশের এমন উদ্যোগ যখন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে, তখন টিটিপির হুমকি যে কেবল 'কসাই' কাদের মোল্লার ফাঁসির কারণে, এমন ভাবা উচিত হবে না। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি, জঙ্গিবাদ সমর্থক ও সহানুভূতিশীল গোষ্ঠীগুলো বারবারই ক্ষমতাসীন, উদার, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে তৎপর থাকে। কখনও সরাসরি, কখনও রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মুখোশ পরে। টিটিপির হুমকি তারই ধারাবাহিকতা বলে আমরা মনে করি। এ ক্ষেত্রে সতর্কতার বিকল্প নেই। আমরা দেখেছি, পাকিস্তান সরকার ইতিমধ্যে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে। আমরা বিশ্বাস করি, বিদেশি দূতাবাসে দেশীয় জঙ্গিদের হামলার পরিণতি সম্পর্কে পাকিস্তানের শাসকরা ওয়াকিবহাল। সেখানে কর্মরত বাংলাদেশি কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি এই হুমকিদাতাদের আটক ও শাস্তি প্রদানেও তারা যথেষ্ট আন্তরিক থাকবে আশা করা যায়। ঢাকার উচিত হবে এ ব্যাপারে ইসলামাবাদের সঙ্গে বিশেষভাবে আলোচনা করা। একই সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশি দূতাবাস ও হাইকমিশনে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। জঙ্গিবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক লড়াইয়ে বাংলাদেশের ভূমিকা মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে কতটা ক্ষুব্ধ করেছে, টিটিপির হুমকির মধ্য দিয়ে তা আরেকবার প্রমাণ হলো। বাংলাদেশের স্বার্থে আঘাত হানতে তারা হয়তো দ্বিধাবোধ করবে না। দেশের অভ্যন্তরেও জঙ্গি গোষ্ঠী ও তাদের দোসরদের নৈরাজ্য সৃষ্টির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষত নির্বাচন সামনে রেখে যে তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, সেই শঙ্কা খোদ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকেই উচ্চারিত হয়েছে কয়েকবার। সে ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি খতিয়ে দেখার সময় হয়েছে। দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল ও জঙ্গিবাদের দোসর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে লড়াই আমরা শুরু করেছি, তাতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি, সর্বাত্মক সতর্কতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। টিটিপির হুমকি সেই তাগিদই দিয়ে গেল।

No comments

Powered by Blogger.