রেমিট্যান্সে ছন্দপতনের বছর

বেশ কয়েক বছর ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি থাকলেও সদ্যসমাপ্ত বছরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অর্থ প্রবাহ কমেছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা ২০১৩ সালে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে মোট ১ হাজার ৩৮৪ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। আগের বছর রেমিট্যান্স এসেছিল ১ হাজার ৪১৮ কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় ২০১৩ সালে রেমিট্যান্স কমেছে ৩৪ কোটি ডলার, যা প্রায় ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দেশে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের দূরত্বসহ নানা কারণে জনশক্তি রফতানি কমেছে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডি প্রবণতাও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসবের প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। তবে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি না থাকলেও বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য, টাকার বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্বস্তিদায়ক অবস্থা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ৯৬৯ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে রেকর্ড ১৪৪৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে। প্রতিটি বছর কিংবা অর্থবছরে রেমিট্যান্স আগের চেয়ে বেড়েছে। এবারই ছন্দপতন হচ্ছে। অবশ্য রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার প্রভাব এখনও সামষ্টিক অর্থনীতিতে ততটা পড়েনি। কেননা ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে গতি না থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কম রয়েছে। তবে রেমিট্যান্স বাড়লে জাতীয় আয়ের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
প্রতি মাসের পরিসংখ্যান বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থবছর ধরে রেমিট্যান্সের বার্ষিক তথ্য প্রকাশ করে। অর্থবছর ধরলে ডিসেম্বরে চলতি অর্থবছরের ৬ মাস পূর্ণ হয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার হার ২০১৩ পঞ্জিকা বছরের তুলনায় অনেক বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) মোট রেমিট্যান্স এসেছে ৬৭৮ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৭৪০ কোটি ডলার। এ হিসাবে অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ৬২ কোটি ডলার, যা ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এ ছাড়া একক মাস হিসেবে গত ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ১২১ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। আগের বছরের একই মাসের তুলনায় এই পরিমাণ কম হলেও আগের মাস নভেম্বরের তুলনায় বেশি। নভেম্বরে মোট ১০৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। আর আগের বছরের ডিসেম্বরে এসেছিল প্রায় ১২৯ কোটি ডলার।
ডিসেম্বর মাসে রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ৪০ কোটি ডলার। নভেম্বরে যা ছিল ৩৪ কোটি ডলার। বিশেষায়িত দুটি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার, আগের মাসে যা ছিল ১ কোটি ২২ লাখ ডলার। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৭৮ কোটি ডলার। আগের মাসে এসেছিল ৬৯ কোটি ডলার। বিদেশি ৯টি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। নভেম্বরে যা ছিল ১ কোটি ২৯ লাখ ডলার। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়লে সাধারণত অর্থ পাচার বাড়ে। এ সময় খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে বিভিন্ন দেশে পাচারের কথা শোনা যায়।
রেমিট্যান্স আশানুরূপ হারে না বাড়লেও রফতানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি এবং আমদানি আগের বছরের তুলনায় বাড়ার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নতুন উচ্চতায় পেঁৗছেছে। গত ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ১৮শ' কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। রিজার্ভের এ পরিমাণ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। এই রিজার্ভ দিয়ে দেশের ৬ মাসের বেশি আমদানি দায় মেটানো সম্ভব।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ায় টাকার মূল্যমান ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং বাজারভিত্তিক তদারকির কারণে বর্তমানে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মুদ্রার তুলনায় অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ও শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। তবে আমদানির হার না বাড়লে এই বিনিময় হার ধরে রাখা বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে।

No comments

Powered by Blogger.