পথের শেষ কোথায় by আবির হোসেন

(সংকটে বাংলাদেশ) ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হবে দশম জাতীয় সংসদের; কিন্তু গত ২৮ ডিসেম্বর সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডিসহ চারটি সংগঠন যৌথভাবে এক আলোচনায় এ নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানায়। 'সংকটে বাংলাদেশ :নাগরিক ভাবনা' শিরোনামে আহূত এ আয়োজনে যুক্ত অপর তিনটি সংগঠন হচ্ছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি, সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র। এগুলো মর্যাদাসম্পন্ন সংগঠন। নেতৃত্বে রয়েছেন সমাজের বিশিষ্টজন হিসেবে স্বীকৃত ব্যক্তিবর্গ। সমাজের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ীরা এ আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন।
এ আলোচনায় হাজির হওয়ার সুযোগ ঘটেছিল আমার। বেশ বড়সড় মিলনায়তনটিতে অনেক লোক। টিভি ক্যামেরার উপস্থিতি ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যারা কথা বলছিলেন, তারা প্রত্যেকেই একেকজন স্টার। সবাইকে ধরে রাখার জন্য ক্যামেরাম্যানরা সচেষ্ট ছিলেন। আলোচনা শুনতে শুনতে মনে হয়েছে, বেশিরভাগ বক্তা নির্বাচন স্থগিত রাখার বিষয়ে যতটা গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন, কেন বাংলাদেশে গত দুই বছর ধরে হানাহানি ও নৈরাজ্য, তার প্রতি ততটাই অমনোযোগী ছিলেন। জামায়াতে ইসলামীর সহিংস ও নাশকতার রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় তাদের মোটেই আগ্রহ ছিল না। এই দলটির ওপরে ভর করে বিএনপি তার 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' কায়েমের আন্দোলন সফল করতে চায়। তারা একের পর এক হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দিচ্ছে এবং তা বাস্তবায়নের ভার পড়ছে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধীদের নেতৃত্বে পরিচালিত দলটির ওপর। জামায়াতের উদ্দেশ্য স্পষ্ট_ দেশকে অরাজক অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়ে গণহত্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বাঁচানো। তারা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছে_ ক্ষমতায় বিএনপিকে আনতে না পারলে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো যাবে না। তারা নিজেরা সহিংসতা করছে। একসময়ে ইসলামের হেফাজত করার জন্য একটি বিশেষ মহলকেও রাজনীতির মাঠে নামিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, গত ২৮ ডিসেম্বরের 'সংকটে বাংলাদেশ :নাগরিক ভাবনা' আলোচনার উদ্যোক্তাদের কাছে এ বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। গত এক বছরে ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য স্থানে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের যেসব সমাবেশ হয়েছে, তাতে সামনের এলাকা দখল করার জন্য সচেষ্ট ছিল জামায়াতে ইসলামী এবং এ সুযোগকে তারা যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করার দাবি সামনে আনার জন্য ব্যবহার করেছে। কিন্তু 'নাগরিক সমাজের' ভাবনায় এ সমস্যা আদৌ গুরুত্ব পায়নি। জামায়াতে ইসলামীর ভোট ২-৩ শতাংশের বেশি নয়। তাদের অর্থ-দাপট প্রবল এবং সেটা বুঝতে কারও সমস্যা হয় না। কিন্তু আমাদের নাগরিক ভাবনায় তা মোটেই বড় সমস্যা নয়। এ অর্থের উৎস কোথায়, তার হিসাব তারা চায় না। কিংবা সরকারকেও বলে না বিশেষ অনুসন্ধান পরিচালনা করতে। এ দলটিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে প্রকাশ্যেই, কিন্তু তার কারণ বোধগম্য নয়। এটা কি একাত্তরের সখ্যের পুনরাবৃত্তি? ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসন বাংলাদেশের অভ্যুদয় রুখতে পক্ষ নিয়েছিল ইয়াহিয়া-টিক্কা খানের জান্তার সঙ্গে। তারা অস্ত্র দিয়েছে বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যার জন্য। রাজনৈতিক মদদ দিয়েছে। জাতিসংঘে শত্রুতা করেছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। সে সময়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর কারণে ভারতের নেতৃত্বকেও তারা নানাভাবে হেয় করার চেষ্টা করেছে।
জামায়াতে ইসলামীও ইয়াহিয়া খানের পাশে ছিল পূর্ণ শক্তি নিয়ে। তারা নিজেরা বাঙালিদের হত্যায় অংশ নিয়েছে, লুটপাট-অগি্নসংযোগ-ধর্ষণ করেছে। এখন বাংলাদেশের ক্রান্তিলগ্নে তারা আবার পরস্পরের বন্ধু হয়ে গেল! যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির ফোন কিন্তু তারই ইঙ্গিত দেয়। অনেকে এটাও বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র কোনো সময়েই আওয়ামী লীগকে সহ্য করতে পারে না। তারা মৌলবাদের বিরুদ্ধে বলে। কিন্তু বাংলাদেশে যেন ওই শক্তি ক্ষমতায় আসতে পারে, তার জন্য চেষ্টা চালায়। আওয়ামী লীগকে সহ্য করতে না পারার কারণ কি একাত্তরের পরাজয় মেনে নিতে না পারা? বর্তমানে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের অতিমাত্রায় দৌড়ঝাঁপও কিন্তু সন্দেহ সৃষ্টি করছে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ডা. সারোয়ার আলী গত ২৮ ডিসেম্বরের আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্যও রখেন। তিনি পরে আমাকে বলেছেন, "কয়েকটি ঘটনা পরপর সাজালে কিছু সন্দেহ না এসে পারে না। ২৭ ডিসেম্বর একটি বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক নিজের নামে কেন ৫ জানুয়ারি নির্ধারিত নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া কিংবা স্থগিত রাখা উচিত, তার পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেন। তার বক্তব্যে ধার ছিল যথেষ্ট এবং এটা তিনি করতেই পারেন। তিনি যদি নির্বাচন তফসিল ঘোষণার পরপরই এ লেখা প্রকাশ করতেন, তাহলে তাকে ভিন্নভাবে দেখা যেত। কিন্তু লেখাটি প্রকাশিত হয় নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে, যখন সব প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। ২৮ ডিসেম্বর সিপিডি এবং আরও তিনটি সংগঠন গুলশানে 'সংকটে বাংলাদেশ :নাগরিক ভাবনা' আয়োজন করে। শুরুতেই আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের তারিখ পুনর্বিবেচনা করতে হবে। দেশের যাবতীয় সংকটের সমাধান হিসেবে এটাই সম্ভবত তারা তুলে ধরতে চেয়েছে। পরের দিন ২৯ ডিসেম্বর ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি। তারাও এটার আয়োজন করেছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বন্ধ করার দাবি নিয়ে।"
পরপর তিন দিনের কর্মসূচি কিন্তু একই দাবিতে আহ্বান করা হয়! কাকতালীয় বটে!
সিপিডি এবং অন্যদের সভায় ব্যবসায়ী নেতাদের বেশিরভাগের বক্তব্য ছিল যুক্তিপূর্ণ। তারা নিজেদের কথা বলেছেন, দেশের কথা বলেছেন। স্কয়ার গ্রুপের তপন চৌধুরী বলেছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা কেউ, এমনকি আরও কয়েক মাস রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম অস্থিরতা বিরাজ করলেও অভুক্ত থাকবেন না কিংবা তাদের পড়াশোনা বা সচ্ছল জীবনের অন্যান্য আয়োজনে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটবে না। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর হাজার হাজার কর্মীকে বেতন দেওয়া যাবে না। ফলে তাদের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে উঠবে। তিনি এবং অন্য ব্যবসায়ী নেতারা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে সমঝোতার জন্য আবেদন জানান এবং সেটা ছিল সঙ্গত। তারা রাজনীতি অঙ্গনের রেষারেষির সঙ্গে নিজেদের জড়াতে চাননি। বিশেষ কোনো দলের এজেন্ডার ফাঁদেও পা দিতে চাননি।
ডা. সারোয়ার আলী বলেছেন, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তিনি মনে করেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সামান্যই বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে। প্রধান দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি নিষ্পত্তিতে পেঁৗছানোর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এরপর একটির পর একটি ঘটনা যেভাবে ঘটেছে, তাতে কিন্তু সযত্নে পরিকল্পিত একটি গেমপ্ল্যান আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমি আশা করব, আমার ভাবনা যেন ভুল প্রমাণ হয়। কিন্তু না হলে...!
বিরোধীরা আন্দোলন কর্মসূচি সফল করতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের দমন-কৌশল এর একটি কারণ। কিন্তু এটাও ঠিক যে, বিএনপি নেতারা লাখ লাখ কর্মী-সমর্থকের ঢল নামানোর ঘোষণা দিয়েও বাস্তবে সেটা ঘটাতে পারেননি। আওয়ামী লীগের কর্মীরা সর্বোচ্চ আদালতে হানা দিয়ে কেবল ভুল করেনি, বিএনপির জন্য অনাবশ্যক একটি ইস্যু তৈরি করে দিয়েছে। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীও মার্চ ফর ডেমোক্রেসি সফল করতে মাঠে নামেনি। তারা সাতক্ষীরা-মেহেরপুর-সীতাকুণ্ড 'দখলে রাখতে' মরিয়া ছিল। কিন্তু ২৯ ডিসেম্বর জীবন-মরণ লড়াইয়ে কেন রাজধানী ঢাকার মাঠে নামেনি, সেটা বিএনপি নেতারা ভেবে দেখতে পারেন। এখন এটাও মনে হচ্ছে, উভয় পক্ষ ভরসা করে আছে 'সুশীল সমাজ' এবং পশ্চিমা দেশগুলোর বন্ধুদের ওপর। তারা আমাদের রাজনীতিকদের চেয়েও বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এর শেষ কোথায়, কে জানে। অনেক উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের অভিজ্ঞতা কিন্তু এটা বলে যে, যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু তার আর শত্রুর দরকার পড়ে না। বাংলাদেশের প্রধান সব রাজনৈতিক দলের নেতারা এটা স্মরণে রাখলে ভালো করবেন।
মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক

No comments

Powered by Blogger.