দূষণ- পরিবেশবান্ধব ইটভাটা ও করণীয় by মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী

পরিবেশ বিধ্বংসী ইটভাটা এখন জনমনে আতঙ্ক, গ্রামবাংলার অশান্তি। ইটভাটার প্রাথমিক অনুমোদন প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসক। ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৮৯-এর আওতায় জেলা প্রশাসকেরা ইটভাটা নির্মাণ ও পরিচালনার কার্যক্রমে এককভাবে ক্ষমতাবান।


যখন কোনো উদ্যোক্তা ইটভাটার অবকাঠামো নির্মাণের প্রাথমিক প্রক্রিয়ার সূচনা করেন, প্রথম তা নজরদারিতে আসে জেলা প্রশাসকদের। ইটভাটার লাইসেন্সের আবেদনের সূত্রপাত ঘটে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে। আবার ইটভাটার দখল ও দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কান্না, আর্তি ও অভিযোগ সবার আগে পৌঁছায় জেলা প্রশাসকের কাছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসকেরা ভূমি-ব্যবস্থাপনার মূল অভিভাবক। ভূমি নিয়েই ইটভাটার যাবতীয় কর্মযজ্ঞ। ইটভাটার জন্য উদ্যোক্তারা জমি ভাড়া নেন, জমি দখল করেন, জমির মাটি কর্তন করেন এবং জমির মাটি পুড়িয়েই ইট তৈরি করেন। ইটভাটা এক রাতেই গড়ে তোলা যায় না। এই কার্যক্রম সম্পন্ন করতে প্রয়োজন দুই থেকে তিন মাস সময়। এত দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও ইটভাটা নির্মাণের অনেক ঘটনা জেলা প্রশাসকদের অগোচরে রয়ে যায়। ফলে বিস্তীর্ণ এলাকায় ফসলি জমি ভরাট করে, গ্রামীণ নীরবতা ভেঙে ইটবাহী ট্রাক চলাচলের রাস্তা তৈরি করে, গাছপালা উজাড় করে এবং পার্বত্য এলাকায় পাহাড় কেটে অবৈধ ইটভাটা গড়ে উঠছে। এসব অবৈধ তৎপরতা বন্ধ ও আইনের আয়ত্তে আনা জেলা প্রশাসকের জন্য দুরূহ কোনো কাজ নয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট অভিযানের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, জেলা প্রশাসকদের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই সব নিয়মনীতি ভেঙে দুর্বার গতিতে ইটভাটা তৈরি হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর অনুমোদনহীন ও পরিবেশ বিধ্বংসী এমন অনেক ইটভাটা এনফোর্সমেন্ট অভিযানের আওতায় উচ্ছেদ করেছে এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতিপূরণ নির্ণয় করে অপরাধীদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এ ‘শক্তিশালী’ এনফোর্সমেন্ট অভিযান জীবন ও প্রকৃতিবিনাশী ইটভাটার বিরুদ্ধে ‘কার্যকর প্রতিষেধক’ হিসেবে কাজ করছে। এ অভিযানের সমান্তরালে জেলা প্রশাসকদের ভ্রাম্যমাণ আদালত কার্যকর প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে। ইটভাটার মালিকেরা অনেক ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের বিশেষ তহবিলে অর্থ জমা দিয়ে থাকেন। এ তহবিল জনকল্যাণে এবং রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠানে ব্যয় হয়। কিন্তু ইটভাটার মালিকদের ভ্রান্ত বিশ্বাস, জেলা প্রশাসকের বিশেষ তহবিলে অর্থ জমা দিলেই ইটভাটার লাইসেন্স পাওয়া যাবে, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের আর প্রয়োজন নেই। এ ভ্রান্ত ধারণা দূর করার দায়িত্ব নিতে হবে জেলা প্রশাসকদেরই। ইটভাটায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অভিযোগ, ভ্রাম্যমাণ আদালতে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযানে শুধু জরিমানা আদায় করা হলে ইটভাটার বেআইনি কার্যক্রমে বিন্দুমাত্র ছেদ পড়ে না। এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ হয় না ধুলা, ধোঁয়া ও ছাই নির্গমনের অসহনীয় ঘটনা।
নরসিংদী জেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট অভিযানে মারাত্মক কার্বন নিঃসরণকারী অবৈধ দুটি ইটভাটা উচ্ছেদ করতে গিয়ে জনমানুষের ক্ষুব্ধ মনোভাব উপলব্ধি করা গেছে। ইটভাটা দুটির মালিককে দণ্ডিত করে মোট ১০ লাখ টাকা জরিমানা আদায়ের পর সব অবৈধ স্থাপনা সমূলে উচ্ছেদ করা হয়। দুটি ইটভাটারই অবস্থান ফসলি জমিতে এবং একেবারে মানুষের ঘরবাড়ির কাছে। অশ্রুভেজা চোখে জনগণ অসহায়ভাবে জানায়, তারা ইটভাটার পরিবেশ বিধ্বংসী আচরণের নিষ্ঠুর শিকার। তাদের এলাকার গাছপালার ফলমূল কমে গেছে, ফসল উৎপাদনে ভাটা পড়েছে এবং মানুষের রোগব্যাধি বেড়ে গেছে। অভিযানের সময় গ্রামের এক প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদের এমন কঠোর অভিযান আগে কখনো অবলোকন করেননি বলে উচ্ছ্বাসভরে মন্তব্য করেন। তিনি যুগপৎ আক্ষেপ ও আবেগের সুরে বলেন, ‘এবার এসেছে আসল বাঘ, এত দিন এসেছিল মেছো বাঘ। এবারই প্রথম পরিবেশ অধিদপ্তর এমন সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে।’
জেলা প্রশাসকেরা কর্মব্যস্ততায় সদা ডুবে থাকেন। তাঁদের ছুটি নেই, কর্তব্য পালনে বিরতি নেই, শ্রান্তি নেই। মাঠ প্রশাসনের তাঁরাই দক্ষ কান্ডারি। শত-সহস্র দায়িত্বের মধ্যেও ইটভাটার যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা তাঁদের অন্যতম গুরুদায়িত্ব। পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রত্যাশা, জেলা প্রশাসকেরা ইটভাটার দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর অভিযান পরিচালনা ও শক্তিশালী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে আসবেন। কাজটি পরিবেশ অধিদপ্তরের একার পক্ষে অসম্ভব। জনবল ও লজিস্টিকসের সীমাবদ্ধতার কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর এককভাবে সক্ষম নয় ইটভাটার বিধ্বংসী কার্যক্রম থেকে মানুষকে রেহাই দিতে। সুতরাং, মানুষ, মাটি ও প্রকৃতিকে রক্ষার চ্যালেঞ্জটি নিতে হবে জেলা প্রশাসকদের। একটি ইটভাটায় বছরে প্রায় ৫০০ থেকে এক হাজার টন কয়লা পোড়ে। শত শত টন কাঠও পোড়ে বেআইনিভাবে। কৃষিজমির টপ সয়েল ব্যবহার করা হয় প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ ঘনফুট। একটি ইটভাটা থেকে বছরে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ প্রায় ৩০ মেট্রিক টন। ইটভাটার ব্যবসা বাংলাদেশের আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে মৌসুমি ব্যবসা। এভাবে অবিরাম কাঠ ও কয়লা পুড়িয়ে এবং মাটি জ্বালিয়ে আকাশে-বাতাসে নিঃসরণ ঘটছে শত শত টন কার্বন। এর বিনিময়ে ইটভাটার মালিকেরা তাঁদের নগদ মুনাফা তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। সে মুনাফা দিয়েই জীবনকে উপভোগ করছেন তাঁরা। বিনিময়ে মাটি, মানুষ ও পরিবেশ রিক্ত-নিঃস্ব হচ্ছে। কিন্তু ইটভাটার মালিকেরা ভাটার আশপাশে দূষিত পরিবেশে বসবাস করেন না। তাঁরা থাকেন নিরাপদ আশ্রয়ে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ইটভাটার প্রযুক্তিতে পরিবর্তন এনেছে। প্রযুক্তিগত এ পরিবর্তনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে আগামী মার্চ ২০১৩ পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে সব ইটভাটাকে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদিত পদ্ধতির আধুনিক ইটভাটায় আবশ্যিকভাবে রূপান্তর করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এ পরিবর্তনের গতি খুবই শ্লথ। পরিবেশ রক্ষার জন্য এ প্রযুক্তিগত পরিবর্তন বর্তমান সরকারের বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। জেলা প্রশাসকেরা জেলায় সরকারের নীতি বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ট। যুগপৎ আইনি ক্ষমতা প্রয়োগ, ইটভাটার মালিকদের সঙ্গে সমন্বয় ও জনসাধারণকে পরিবেশসচেতন করার মাধ্যমে সব ইটভাটাকে পরিবেশবান্ধব করার যুগান্তকারী কার্যক্রমে জেলা প্রশাসকদের ভূমিকা অপরিহার্য। জেলা প্রশাসকেরা জনমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক এবং সমস্যা ও সংকটে নির্ভরতার কেন্দ্রবিন্দু। তাই পরিবেশবান্ধব ইটভাটা নির্মাণে জেলা প্রশাসকদের অনন্য ভূমিকা প্রত্যাশা করছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট), পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা।
mmunirc@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.