মারমুখী জামায়াত- পুলিশ কেন মার খাচ্ছে? by কামরুল হাসান

‘আমরা ছয়জন মার খাচ্ছি আর আমাদের বাঁ পাশে ৩০ জন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে দেখছেন। কেউ এগিয়ে আসছেন না। নিরাপদে সরে না গেলে ওরা আমাদের মেরেই ফেলত। চাকরিজীবনের ২২ বছরে আমার এমন অভিজ্ঞতা হয়নি।’


রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণের সময় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন পুলিশের আহত সহকারী উপপরিদর্শক আবদুর রহিম। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১০ তলার ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এই পুলিশ সদস্য ৬ নভেম্বর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় জামায়াত-শিবিরের হামলায় আহত হন। তাঁর একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে।
গতকাল দুপুরে আবদুর রহিমের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে ছিলেন গাড়িচালক কনস্টেবল আবুল কালাম। ৫ নভেম্বর মতিঝিলে তাঁর গাড়িতে আগুন দিয়েছেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। তিনি বলেন, হামলার সময় পুলিশ কর্মকর্তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। কেউ প্রতিহত করার নির্দেশ দেননি।
কয়েক দিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক আচমকা হামলা চালাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির। পুলিশকে লক্ষ্য করেই হামলা চালানো হচ্ছে বেশি। কিন্তু এসব হামলা প্রতিরোধে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারাও উদ্বিগ্ন। দফায় দফায় বৈঠক করে তাঁরা এর কারণও খোঁজার চেষ্টা করছেন।
ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা রাজশাহীর একটি ছবি এ প্রতিবেদককে দেখিয়ে বলেন, একজন পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিচ্ছেন জামায়াতের কর্মীরা, আরেকজন পুলিশ পাশে দাঁড়িয়ে সেটা দেখছেন। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বললেন, সরকারের শেষ বছরে এসে রাজনৈতিক আনুগত্য নিয়ে দোদুল্যমানতায় ভুগছেন কোনো কোনো কর্মকর্তা। অনেকে এখন গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করছেন।
তবে পুলিশ যে নিষ্ক্রিয়, তা মানতে নারাজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। গতকাল নিজের দপ্তরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে তারা চোরাগোপ্তা হামলা করছে। পুলিশ আক্রান্ত হলেও কোথাও গুলির ঘটনা ঘটেনি। সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখানো হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এএসএম শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, আইন প্রয়োগে পুলিশের দুর্বলতা প্রকাশ পেলে তারা কোনোভাবেই ভালো কাজ করতে পারবে না। পুলিশকে কঠোর হতেই হবে। না হলে প্রতিপক্ষ সুযোগ নেবে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ৬ নভেম্বর থেকে এক সপ্তাহে দেশের ৪০টি স্থানে পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। এতে ২০০ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় ৬৯টি মামলা হয়েছে।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে তাণ্ডব চালায় জামায়াত-শিবির। এ সময় পুলিশ ছিল একেবারেই নিষ্ক্রিয়। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে শিবিরকর্মীরা একজন পুলিশ সদস্যকে আহত করার পাশাপাশি আইনমন্ত্রীর গাড়িতেও হামলা চালান।
৪ নভেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ৬ থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত দেশব্যাপী গণসংযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও শীর্ষ নয় নেতার মুক্তিসহ কয়েকটি দাবিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। মূলত এ কর্মসূচি ঘোষণার পর জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে শুরু করে।
কর্মসূচি ঘোষণার পরদিন মতিঝিলে পুলিশের ওপর হামলা করে জামায়াত। এই দিন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে হামলা হয়। কুষ্টিয়ার মজমপুরে জামায়াতের কর্মীদের মারধরে আহত হয়ে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা পুলিশ সদস্যের ছবি ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে একজন পুলিশ সদস্যকে ধাওয়া করার ছবিও প্রকাশিত হয়। ৬ নভেম্বর রাজশাহীর সাহেববাজারে এক পুলিশ সদস্যের রাইফেল কেড়ে নিয়ে তাঁকেই মারধর করতে দেখা যায় জামায়াতের কর্মীদের। জয়পুরহাটে এক পুলিশ কনস্টেবলকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে জামায়াত-শিবির।
একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন, ৬ নভেম্বর থেকে জামায়াতের কর্মসূচির সময় পুলিশের ওপর হামলা হতে পারে—এ তথ্য পুলিশের কাছে ছিল। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া এসব তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়। সেই মতো বিভিন্ন স্থানে পুলিশও মোতায়েন করা ছিল। কিন্তু হামলার সময় পুলিশ ছিল একেবারেই নিষ্ক্রিয়।
কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? পুলিশের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন সদস্য এ নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার ও পুলিশ কমিশনারের মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশই এখন জামায়াতের হামলার মূল লক্ষ্য। যেহেতু পুলিশ জামায়াতের নাশকতার পরিকল্পনাগুলোকে বারবার ব্যর্থ করে দিচ্ছে। তাই তারা আতঙ্ক ছড়াতে এসব কাজ করছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত রয়েছে, সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। অযথা পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা যাবে না। পোশাক পরে একা একা না চলারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, নতুন করে কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে না। এটাকে দুর্বলতা বা নিষ্ক্রিয়তা বলে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুযোগসন্ধানী কর্মকর্তারা নিজেদের দলের লোক পরিচয় দিয়ে রাতারাতি ভালো জায়গায় বদলি হয়েছেন। সরকারের শেষ সময়ে এসে তাঁরা নিরাপদে সরে পড়তে চাইছেন।
মহানগর পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, অনেকে সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালনের জন্য এসবি বা সিআইডির মতো প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জোর চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ বলছেন, পুলিশে এখন সাংগঠনিক শৃঙ্খলা নেই। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কেউ কারও কথা শুনছেন না। এত দিন তাঁরা দলের নাম ভাঙিয়ে সুবিধা নিয়েছেন। এখন কোনো ঝামেলায় জড়াতে চান না। এ কারণে গা বাঁচিয়ে চলছেন। কেউ কেউ বলছেন, অনেক পুলিশ সদস্য এ সরকারের বা আগের সরকারের আমলে ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন। এখন কর্মক্ষেত্রে এসে তাঁরা ঝুঁকি নিতে চান না। মাঠপর্যায়ে তারই প্রভাব পড়ছে।
অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা সৈয়দ বজলুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘাসের ভেতরে সাপ যেভাবে চলে, পুলিশ এখন সেভাবে চলছে। এভাবে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে চলতে চলতে বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়বে। তখন সরকারের জন্যই সেটা বিপদ ডেকে আনবে।’
জামায়াতের হামলায় আহত তরুণ কনস্টেবল আরিফ খান এখন রাজারবাগ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর মুখেও একই কথা। তিনি বলেন, ‘ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করলে পুলিশ পালিয়ে যায়, এটা জীবনেও চিন্তা করিনি। এখন পুলিশের পোশাক পরতে ভয় করছে।’

No comments

Powered by Blogger.