কণ্ঠস্বর-সংলাপেই পরিত্রাণ by রাহাত খান

দুনিয়ার সব গণতান্ত্রিক দেশেই সাধারণ নির্বাচনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক নির্বাচন সম্পন্ন হয় সেই দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের আওতায়। তবে বাংলাদেশে নানা কারণে নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে সাধারণ নির্বাচন পরিচালনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি আলোচনায় চলে এসেছে।


নির্বাচন চাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
এই দাবি এককালে ছিল আওয়ামী লীগের। ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার এই দাবির ঘোর বিরোধী ছিল। বিএনপি তাদের অবস্থানে অটল থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি (২০০৬) নির্বাচন অনুষ্ঠানের জোর প্রস্তুতিও নিচ্ছিল। বিরোধী আওয়ামী লীগের দাবিকে (তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত) কোনো রকম পাত্তাই দিতে চাইছিল না। তবে সাংগঠনিক শক্তি বরাবরই আওয়ামী লীগের বেশি। নিজেদের দাবিতে আওয়ামী লীগের দেশব্যাপী আন্দোলন এমন পর্যায়ে পেঁৗছে যায় যে, বিএনপি সেই দাবি মানতে বাধ্য হয়। সংবিধানে যথেষ্ট ফাঁকিঝুঁকি রেখে পার্লামেন্টে মোমের বাতি জ্বালিয়ে (বিক্ষুব্ধ বিদ্যুৎকর্মীরা পার্লামেন্টের বিদ্যুৎ সংযোগ পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন) সারারাত জেগে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত একটি আইন সংযোজনে বাধ্য হয়। সেই থেকে গত সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত বাংলাদেশের সব ক'টি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে এসেছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে জিতে ক্ষমতাসীন হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। তারা সুপ্রিম কোর্ট প্রদত্ত এতদসংক্রান্ত একটি রায়ের ভিত্তিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি পার্লামেন্টের বিগত এক অধিবেশনে বাতিল করে দিয়েছে এবং রাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান পুনর্বহাল করেছে।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন বাতিলে আওয়ামী লীগ তাদের কার্যক্রমের পক্ষে কতগুলো যুক্তির অবতারণা করেছে। এক. সুপ্রিম কোর্টের রায় মান্য করা। দুই. নির্বাচন কমিশনকে যথার্থ অর্থে স্বাধীনভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষমতা দেওয়া, যা সরকার এবং বিরোধী দলের যৌথ আলোচনা ও সম্মতিক্রমে স্থির হতে পারে। তিন. নির্বাচনের তিন মাস আগে অনির্বাচিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কের বদলে পার্লামেন্টে আসন পাওয়া সব দলের, বিশেষ করে সরকার ও প্রধান দলগুলোর সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন বহুদলীয় সরকার গঠন করা যেতে পারে। চার. বিএনপির পাস করা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনে বহু ফাঁকিঝুঁকি রয়েছে, যার কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন নয়, বড় ও কার্যকর হয়ে ওঠে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা_ যা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। পাঁচ. কোনো অনির্বাচিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামকাওয়াস্তে নির্বাচন পরিচালনা করতে এসে দেশ শাসন করবে, সেটা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কাম্য বা বাঞ্ছনীয় নয়।
বিএনপি আওয়ামী লীগ বর্ণিত এসব যুক্তি মানতে কিছুমাত্র রাজি নয়। তাদের কথা, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো আওয়ামী লীগেরই দাবি বা আওয়ামী লীগের নৈরাজ্য ও রক্তাক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টির মুখে বিএনপি মেনে নিয়েছিল। এখন কেন তবে আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পার্লামেন্টে তাদের 'ব্রুট মেজরিটি'র জোরে আইনত বাতিল করেছে এবং উল্টো সুরে গাইছে? বিএনপির যুক্তি, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণার পরও বলা হয়েছিল, ইচ্ছা করলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আরও দুটি সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত রেখে দেওয়া যেতে পারে। মহাজোট সরকার তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অন্তর্ভুক্ত সেই 'দুটি নির্বাচন পর্যন্ত' নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধি বহাল রাখেনি অত্যন্ত উদ্দেশ্যমূলক কারণে। সেই উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, পুনর্বার দেশের শাসন ক্ষমতায় যাওয়া।
সুতরাং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল না করা পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। আর বিএনপি-জামায়াতের অংশগ্রহণবিহীন নির্বাচন যাতে কোনোক্রমে অনুষ্ঠিত হতে না পারে, সে জন্য প্রয়োজনে দেশ অচল করে দেওয়া হবে।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে পক্ষ-প্রতিপক্ষের দাবি-পাল্টা দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়েও বলা যায়, পার্লামেন্টে নিজেদের দাবি উপস্থাপনের সুযোগ তো বিএনপি-জামায়াত জোটের ছিল। সরকার পক্ষ মানুক বা না মানুক, পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে নিজেদের দাবি তো বিরোধী দল বলে আসতে পারত; দেশবাসীকে গণতান্ত্রিক সংসদীয় ধারায় অবহিত করতে পারত তাদের ভাষায় আওয়ামী লীগের মতলববাজি বা ষড়যন্ত্র করে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়টি। বিএনপি তা করেনি। আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে পার্লামেন্টের বাইরেও সংলাপে বসার এবং আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগ এও বলেছে, সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে বিএনপির যদি কোনো বিকল্প প্রস্তাব থাকে, সেটা নিয়েও পার্লামেন্টে বা পার্লামেন্টের বাইরে আলোচনা হতে পারে।
বিএনপি-জামায়াত নিজেদের গণতান্ত্রিক দল বলে মনে করে। কিন্তু পার্লামেন্ট বা পার্লামেন্টের বাইরে প্রতিপক্ষের সঙ্গে কোনো বিবদমান বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসা এবং তার শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় বিশ্বাস করে না বলে প্রতীয়মান হয়। এটি আর যা-ই হোক, গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে না। তবে হু কেয়ারস ফর ভার্জিনিয়ান উলফ?
বিএনপি বিশ্বের প্রধান রাষ্ট্রগুলোর ঢাকাস্থ কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বেশ কয়েকবার। বাংলাদেশ সফর করতে আসা বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের খাতিরে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। খালেদা জিয়ার লবিস্টরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীন সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়েছেন। এসবই বাংলাদেশে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা এবং অপরিহার্যতা বোঝানোর চেষ্টায়। জানা মতে, কোনো পর্যায় থেকে বিএনপি ইতিবাচক সমর্থন পেয়েছে বলে মনে হয় না। আলোচ্য বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সেখানে হস্তক্ষেপ বা নাক গলানোর সুযোগ নেই বাইরের রাষ্ট্র বা নেতাদের। তারা সবাই একটা কথাই বিএনপিকে বলেছে এবং এখনও বলছে যে, দেশের যে কোনো গুরুতর বা গুরুত্বপূর্ণ বিবদমান বিষয় পক্ষ-প্রতিপক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই মীমাংসা করতে হবে। কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যায়, এসব কথায় বিএনপি-জামায়াত সন্তুষ্ট হয়নি। কোনোদিন সন্তুষ্ট হবে বলেও মনে হয় না।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য খুব একটা শুভ হয়নি। সম্মানিত ব্যতিক্রম হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান (শেলী) ছাড়া বাদ বাকি অনির্বাচিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রধানদের ভূমিকা কমবেশি বিতর্কিত। বিশেষ করে সাবেক বিচারপতি লতিফুর রহমান এবং প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের ভূমিকা তো ছিল অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট, ষড়যন্ত্রমূলক এবং ক্ষমার অযোগ্য বিষয়। প্রশ্ন জাগে, আমাদের প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনে কার্যোপযোগী ক্ষমতায়নের কথা একবারও বলে না, নির্বাচন প্রশ্নে তাদের কাছে সবসময় গুরুত্ব পায় শুধু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা! বিষয়টি কী! এর মধ্যে রহস্যটা কোথায়?
রহস্য একটা কিছু এর মধ্যে আছে নিশ্চয়। নির্বাচনের আগে তিন মাস অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ তো সরকারের ডে টু ডে কাজ করা। নির্বাচন করার একক দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনে যাতে প্রভাব বিস্তার বা গোপনে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় বিধি-ব্যবস্থা করলেই তো হয়। প্রতিবেশী ভারতে নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দলই অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে থাকে, তবে ভারতের শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার পরিধি বিচারে অন্তর্বর্তীকালীন সেই সরকার হয়ে পড়ে 'ঠুঁটো জগন্নাথ' সরকার। অর্থাৎ সেই সরকারের হাতে নতুনভাবে দেশের পলিসি নির্ধারণের ক্ষমতা থাকে না। সেই সরকারের দেশ শাসন করা বলতে যা বোঝায় তা হচ্ছে, সচিবালয়ে জমে থাকা রুটিন কাজের ফাইলপত্র দেখা এবং ডিসপোজ অফ করা। সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপযোগী সব ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয় নির্বাচন কমিশনের হাতে।
নির্বাচন কমিশনই নির্বাচনের আগে ও অব্যবহিত পরের কয়েকটা দিন সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়ার বিষয়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। আমি মনে করি, বিষয়টি মীমাংসার স্বার্থে উভয় পক্ষের উচিত নির্বাচন কমিশনকে কতদূর ক্ষমতায়ন করলে কারচুপি বা ভেজাল নির্বাচনের আশঙ্কা থাকে না, সেই বিবেচনাকেই গুরুত্ব দেওয়া। শাসক সরকার বহুদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটা রূপরেখা দিয়েছে। সুশীল সমাজের বড় অংশের কাছে সেটাই সবচেয়ে বিবেচনাযোগ্য অপশন! সংলাপে বসে সেই রূপরেখা নির্ধারণ করার চেষ্টাও উভয় পক্ষ করতে পারে।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনের আগে পুনর্বহাল না করলে দেশ অচল করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে বিএনপি এবং তাদের দোসর যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত। জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের লুকানো গর্ত থেকে বের করে এনে দেশে বোমাবাজি, গ্রেনেডবাজি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে সেটা তারা করতে পারে। ডেকে আনতে পারে তৃতীয় শক্তিকে। তবে সেই ক্ষেত্রে দুই বিঘা জমি পাওয়ার বদলে গোটা বিশ্বের সমর্থন হারানোর ভয় রয়েছে বিএনপির। দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত রাজনীতিতেও সেটা কাম্য নয় বলেই মনে হয়। তেমন অবস্থা সৃষ্টি করার সুযোগও বিএনপি-জামায়াত পায় কি-না সেটাও প্রশ্ন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে যথোচিত ক্ষমতায়নের কথাই ভাবা উচিত পক্ষ-প্রতিপক্ষের। ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় যাওয়ার দিন তো শেষ বলেই জানি। বিশ্বের বিদ্যমান ভৌগোলিক-রাজনৈতিক-কূটনৈতিক বাস্তবতাও তা সমর্থন করে।

রাহাত খান :কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.