শনিবারের সুসংবাদ-বানরের জন্য ভালোবাসা by আপেল মাহমুদ

রাজধানীর দোলাইরপাড়ে তেজগাঁও উন্নয়ন সার্কেলের অফিস। সেখানে দেখা হয় পশু ও পাখিপ্রেমী যশোধন প্রামাণিকের সঙ্গে। সার্কেল অফিসারের কাছে এসেছেন রিলিফের চাল-গমের আশায়। তবে নিজের জন্য নয়। কিছু চাল-গম পাওয়া গেলে তা বিক্রি করে বানরের জন্য খাবার কিনে বিতরণ করবেন।
পুরান ঢাকায় দীর্ঘ ১০ বছর ধরে তিনি এভাবেই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে চলেছেন। দুঃখজনক হলো, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে ঘুরে জুতার সুকতলা ক্ষয় করাই সার। কোনো রকম সহযোগিতাই মিলছে না।
প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ঢাকা নগরীর বেশির ভাগ স্মৃতি হারিয়ে গেলেও টিকে আছে বানর। পুরান ঢাকার এক দালান থেকে আরেক দালানে বানরগুলোর লাফিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সহজেই পথচারীর চোখে পড়ে। বিশেষ করে গেণ্ডারিয়া, মিল ব্যারাক, বনগ্রাম, মৈশুণ্ডি, জনসন রোড, নবাবপুরের রথখোলা, টিপু সুলতান রোড, নারিন্দা, সূত্রাপুর, স্বামীবাগ এলাকায় এমন দৃশ্য বেশি দেখা যায়।
যশোধন প্রামাণিক কালের কণ্ঠকে বলেন, পুরান ঢাকার বানরকুলের অস্তিত্ব রক্ষায় তিনি প্রায় ১০ বছর আগে সাংবাদিক শিবশংকর চক্রবর্তীর সহযোগিতায় এগুলোকে খাবার দেওয়া শুরু করেন। নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে আজও তা অব্যাহত রেখেছেন।
পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দা ত্রৈলোক্যনাথ সাহা জানান, একসময় স্বামীবাগের শক্তি ঔষধালয়, সাধনা ঔষধালয়সহ বেশ কিছু মঠ-মন্দির-আশ্রম কর্তৃপক্ষ বানরের জন্য নিয়মিত খাবার সরবরাহ করতো। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। তবে এ ক্ষেত্রে সাধনা ঔষধালয় আজও ব্যতিক্রম। তারা এই মহৎ কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে।
দীননাথ সেন রোডের সাধনা ঔষধালয় কর্তৃপক্ষ ১৯১৪ সাল থেকে সাধনার চত্বরকে বানরের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে গড়ে তুলেছে। সাধনার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ড. যোগেশ চন্দ্র ঘোষ নিজস্ব ছাপাখানার উপরের একটি কক্ষ বানরের বিশ্রামখানা হিসেবে ছেড়ে দেন। সে সঙ্গে সকাল-বিকেল খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। তাঁর ছেলে নরেশ চন্দ্র ঘোষ ও নাতি প্রদীপ চন্দ্র ঘোষ পূর্বপুরুষের এই ধারা বজায় রেখেছেন। দীর্ঘ প্রায় শত বছর ধরে এই নিয়ম চালু রেখেছে সাধনা কর্তৃপক্ষ।
সাধনার কর্মকর্তা নারায়ণ চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, প্রতিদিন সকাল-বিকেল প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বানরের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। ১৯৭৭ সাল থেকে তিনি এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। সেই থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত একদিনের জন্যও তা বন্ধ করা হয়নি। প্রবীণ কর্মী সুখরঞ্জন দাস বলেন, একসময় শত শত বানর সাধনা চত্বরে ভিড় করত। বর্তমানে এর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮০/৯০টিতে। সাধনার কর্মচারীরা নিজ হাতে বানরদের ছোলা-বুট, রুটি কিংবা কলা খেতে দেন। অনেক সময় বাইরের লোকজনও খাবার সরবরাহ করে।
প্রতিবন্ধকতা : নানামুখী প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে পুরান ঢাকায় প্রায় তিন শ বানর আজও টিকে আছে। তবে খাদ্য সংকটের কারণে এগুলো বিভিন্ন বাসা-বাড়ি, প্রতিষ্ঠান কিংবা দোকানে হামলা করছে। কলা, রুটি কিংবা ভাতের ভাণ্ড ছাদে তুলে নিচ্ছে। আবার খাবার না পেয়ে অনেক সময় কামড়ে দিচ্ছে মানুষকে।
যশোধন প্রামাণিক জানান, অসহায় বানরগুলোর প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু অবস্থা দিন দিনই প্রতিকূল হয়ে উঠছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন ধর্না দিয়েও ফল হয়নি। সর্বশেষ তেজগাঁও উন্নয়ন সার্কেলে কিছু রিলিফের জন্য এসেছেন। কিন্তু তাদেরকেও খুব একটা আন্তরিক মনে হচ্ছে না।
যশোধন জানান, বানরগুলোর খাবারের সংস্থান করতে ডিসিসি থেকে ২০১০ সালে ৭০ হাজার টাকা অনুদান পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সমস্যার সমাধান করতে দরকার বছরে কমপক্ষে দুই লাখ টাকা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, 'ডিসিসি এক লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে প্রস্তুত। তবে এজন্য তিন লাখ টাকার ভাউচারে সই দিতে হবে। এমন অনৈতিকভাবে টাকা এনে বানরের জন্য খাবার সরবরাহ করতে মন সায় দেয় না।'
বিশিষ্টজনরা যা বলেন : ঢাকার ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অতীতে পুরান ঢাকায় অনেক মঠ-মন্দির ছিল। হিন্দু সম্প্রদায় সেখানে অনেক ফল-মূল দেবতার ভোগ হিসেবে নিয়ে আসত। বর্তমানে মঠ-মন্দির-আশ্রমের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বানরগুলো খাদ্য সংকটে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেনের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে কাঁঠবিড়ালী এবং সলিমুল্লাহ হলে বানর দল বেঁধে ঘুরাফেরা করত। কিন্তু পুরনো ভবন ভেঙে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ ও নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের কারণে বানর হারিয়ে যেতে থাকে। আজ আর এই এলাকায় বানরের দেখা মেলে না।
মানুষের সঙ্গে বানরের সংঘাত বিষয়ে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞানী ড. মোস্তফা ফিরোজ বলেন, বানর বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ পুরান ঢাকায় নষ্ট হয়ে গেছে। আগের মতো গাছ-পালা, বাগ-বাগিচা কিংবা খালি জায়গা না থাকায় বানর-মানুষ পরস্পর শত্রু হয়ে গেছে। তিনি বলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি তাতে ১০ বছর পর পুরান ঢাকায় বানর খুঁজে পেতে কষ্ট হবে।
গেণ্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডের বাসিন্দা নবী উল্লাহ শেখ বলেন, 'আমাদের মনুষ্যত্বহীনতার কারণে প্রায় প্রতিদিনই পুরান ঢাকা থেকে দুই-চারটি করে বানর হারিয়ে যাচ্ছে।'
প্রাণীবিজ্ঞানীদের মতে, ঢাকার বোটানিক্যাল গার্ডেন, মাদারীপুরের চরমুগুরিয়া, যশোরের কেশবপুর ও গাজীপুরের বর্মী এলাকায় নানা প্রজাতির বানর পাওয়া গেলেও পুরান ঢাকায় শুধু রেসাস জাতের বানর দেখা যায়। দেশে হনুমান ও উল্লুক ছাড়া বানর রয়েছে পাঁচ প্রজাতির। তবে রেসাস ও ম্যাকাকু প্রজাতির বানরের ডিএনএর গঠন মানুষের খুব কাছাকাছি। তাই গবেষকদের কাছে পুরান ঢাকার বানর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মতে, পুরান ঢাকাবাসীর ভালোবাসাই বানরকুল রক্ষা করতে পারে। এজন্য সাধনার পাশাপাশি বলধা গার্ডেনকেও বানরের অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তোলা দরকার।

No comments

Powered by Blogger.