চারদিক-বানু বিবির গল্প by মোছাব্বের হোসেন

গায়ে তাঁর মলিন শাড়ি। শ্যামবর্ণের মুখে রাজ্যের বিষণ্ন্নতা। কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখ দুটোর নিচে কালি। বয়স ষাটের ওপর। মাথা ভর্তি পাকা চুল। ঘোমটা টেনে কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বলতে শুরু করলেন বানু বিবি। বানু বিবি থাকেন মিরপুরের দেওয়ানবাড়ি বস্তিতে। আর কদিন বাদে হয়তো বা লিখতে হতে পারে ‘থাকতেন’।

সে কথায় পরে আসছি। ১৯৭১ সালে দেশের চরম দুর্দিনে ঘরে বসে থাকেননি বানু বিবি। শরীয়তপুরে গ্রামের বাড়িতে থাকার সময় চারদিকের যুদ্ধের ভয়াবহ অবস্থা ভাবিয়ে তোলে তাঁকে। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে স্বামী রুস্তম ব্যাপারি যখন যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন বানু বিবিও তাঁকে সাফ জানিয়ে দিলেন—তিনি একা ঘরে বসে থাকতে পারবেন না। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ করবেন। রুস্তম ব্যাপারিও তাঁর কথায় সায় দিলেন। শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলার ডামুড্যা থানায় যুদ্ধে অংশ নেন স্বামী-স্ত্রী দুজনই। একদিকে স্বামী রুস্তম ব্যাপারী সম্মুখযুদ্ধে গেছেন, অন্যদিকে বানু বিবি মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ সরবরাহ করেছেন। প্রয়োজনে তা নিজের কাছে বা গোপন স্থানে রেখেছেন। পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকাররা মিলে তাঁকে অনেক নির্যাতন করেছে। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে দিশেহারা হয়েছেন। তার পরও নীরবে সব নির্যাতন সহ্য করেছেন, কিন্তু দালালদের কাছে মাথা নত করেননি। বাঁ পাঁজরে গুলি লেগেছে, অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন।
দেশ স্বাধীন হলে স্বামী-স্ত্রী মিলে আবার ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু ততক্ষণে শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি লেগে অচল হয়ে গেছেন স্বামী রুস্তম ব্যাপারি। তার পরও এই অচল মানুষকে নিয়ে বানু বিবি সামনে এগোতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যে শক্তি দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তাদেরই একটি দল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে রুস্তম ব্যাপারিকে গুলি করে হত্যা করে। চার সন্তান নিয়ে নিঃসঙ্গ বানু বিবি ঢাকায় চলে আসেন। এরপর বানু বিবির মুখেই শুনি তার জীবনের কথা: ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করলাম। দুঃখের কথা শুনে বঙ্গবন্ধু আমারে মিরপুর ১ নম্বরের দেওয়ানবাড়ি বস্তির খাসজমিতে থাকতে বললেন। তখন মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ কইরে পেট চালাই। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সাথে আবার দেখা কইরে খাসজমিটি আমার নামে দলিল করার জন্য আবেদন করি।’
বঙ্গবন্ধু বানু বিবির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দুই দিন পর, অর্থাৎ ১৫ আগস্ট দেখা করতে বলেন। কিন্তু এবার ভাগ্য তাঁর সঙ্গে কী নির্মম খেলাটা খেলেছে, তা হয়তো অনেকেই আন্দাজ করতে পেরেছেন। আর কখনোই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়নি বানু বিবির। বারবার মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা তৈরি হয়, অথচ সে তালিকায় স্থান পান না বানু বিবিরা। যে খাসজমিতে বাস করছেন, তা-ও নিজের নামে করে নিতে পারেন না। এভাবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেওয়ানবাড়ি বস্তিতে বানু বিবিকে থাকার জন্য কিছু জমি বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু জমির নানা জটিলতা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেন না বানু বিবি। এ-কাগজ, ও-কাগজ সঙ্গে নিয়ে বেরোতে বেরোতে কাগজগুলোই ক্ষয়ে গেছে। সঠিকভাবে জমির স্থায়ী কাগজও করতে পারেননি তিনি।
২০০৯ সালে বানু বিবি আবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলে তিনি জমি বরাদ্দ দেওয়ার আশ্বাস দেন। ‘কিন্তু একদল লোক আমারে এইখান থিকে উঠায় দিতে চাচ্ছে।’ এরা বিভিন্নভাবে বানু বিবিকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে চলেছে। এলাকার প্রভাবশালী নেতারা প্রায়ই এই ঘর ছেড়ে দেওয়ার জন্য বানু বিবিকে শাসিয়ে যান। বানু বিবির পাশে আজ কেউ নেই। প্রায়ই তাঁর বাঁ পাঁজরে গুলি লাগা স্থানে ভীষণ ব্যথা করে। বানু বিবি বলেন, ‘ব্যথায় বুকডা আমার ধড়ফড়াইয়া ওঠে। তখন মনে লয়, কলিজাডা ছিঁইড়া যাইতাছে। আমার ঘরটা যদি ওরা ভাইঙ্গা দেয় তাইলে আমি যামু কই? এই বয়সে আমারে কেডা দেখব?’ আর বেশি কথা বলতে পারেন না বানু বিবি।
এ পর্যন্ত অনেক কাগজ চালাচালি হয়েছে, অনেকের কাছে তিনি জমিটির কাগজ স্থায়ী করতে ধরনা দিয়েছেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শেষমেশ, এক জমিতে ২৫ বছর বসবাস করায় ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে মানবিক কারণে ন্যূনতম ২ দশমিক ৫ কাঠা পরিমাণ একটি প্লট বানু বিবির অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু তাতেও তেমন কোনো কাজ হয়নি। বানু বিবি শঙ্কার মধ্যেই দিন পার করছেন।
বানু বিবি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ঘর যদি পাখির বাসার মতো ভাইঙ্গা দেয়, তাইলে আমি যামু কই?’ এর বেশি আর বানু বিবি বলতে পারেন না।
মোছাব্বের হোসেন

No comments

Powered by Blogger.