গন্তব্য ঢাকা-গ্রাম যেন মায়ের কোল by শর্মিলা সিনড্রেলা

‘আমার চাচাতো ভাই কুদ্দুস। ওদের একটা তালগাছ ছিল। সেই গাছে গ্রীষ্মকালে রোজই তারা হাঁড়ি লাগিয়ে রাখত রস পাওয়ার জন্য। তো, একদিন হয়েছে কি, আমার চাচাতো ভাই রস নিয়ে এসেছে বাড়িতে। তার পরদিনই আমি বাবার সঙ্গে ঢাকায় চলে আসব। আমি ভাইয়াকে বললাম, “আজ আমাকে রস খেতে দাও।

” বড় ভাই আমাকে রাগানোর জন্য বলল, “না, দেব না।” আমিও নাছোড়বান্দা। তার পেছনে পেছনে বাড়ির পুরো উঠোন দৌড়াচ্ছি। সেও আমাকে দৌড়েই নিয়ে চলেছে। কখন যে ভাইয়ের হাতে থাকা দা লেগে আমার হাত কেটে গেছে, আমরা বুঝতেই পারিনি। পুরো উঠোন রক্তে ভরে গেছে। অনেক রক্ত যাওয়ার পর আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আর আমার এত রক্ত দেখে ভাইও অজ্ঞান। এরপর তো বাড়িতে অনেক চেঁচামেচি। বাবা চিন্তায় অস্থির। বলেছিলেন আমার চাচাতো ভাইয়ের নামে মামলা করবেন। যে ছেলেকে বাবা এত যত্নে রাখেন, সেই ছেলেকে প্রায় মেরে ফেললেন!’ না, সেই আঘাতে মরেননি বাবুল শেখ। তবে এখনো মনে হতেই গা শিউরে ওঠে তাঁর। বলেন, ‘বাবাকে অনেক মনে পড়ে। এ ঘটনাটা মনে হতেই মনে পড়ে ভাইয়ের কথা। মনে হয় গ্রামের রসের হাঁড়ির কথা।’
আজ অনেক বছর হলো ঢাকায় এসেছেন বাবুল শেখ। ৪৩ বছরের এই জীবনে কম তো কিছু দেখেননি তিনি। কিন্তু বুকের মধ্যে গ্রামের স্থানটা অন্য রকম। বলেন, ‘গ্রামকে মনে হয় মায়ের কোল। দিন আনি দিন খাই আমরা, তাই গ্রামে ঘন ঘন যাওয়া হয় না। কিন্তু গ্রামের স্মৃতিটা যেন মনের কোণে জ্বলজ্বল করে। আমাদের গ্রাম আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। এখনো কাদাপানি ভেঙেই সেখানে যেতে হয়। অনেক সময় হাতে টাকাও থাকে না যাওয়ার মতো, তবুও ধার করে চলে যাই। ডাল-ভাত খাইলেও ওখানে থাকতে ভালো লাগে।’
ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার নাওড়া গ্রামটির প্রতি রয়েছে বাবুল শেখের নাড়ির টান। মা-বাবা নেই। ভাই শুকুর থাকেন ঢাকায়। গ্রামে রয়েছেন কেবল ভাবি আর চাচারা। ছয় মাস পর বা যখনই গ্রামে যান, তখন হয়তো সাত দিন থাকার জন্য মনস্থির করে যান। গিয়েই শুরু করেন কোনো কাজ। খেতে বা যেকোনো কাজ করে দৈনিক কিছু আয় করেন। যদি আরও কয়েকটা দিন থাকতে ইচ্ছা হয়, তবে তার খরচ আছে না? সেটাও তো জোগাড় করতে হবে।
চাবি বানানোর সব উপকরণ নিয়ে বসে ছিলেন বাবুল শেখ। রোজই সকাল আটটা বা নয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মিরপুরের দিকে যেতে কাজীপাড়া ওভারব্রিজের নিচে ফুটপাতের ওপরে বসেন তিনি। এই প্রচণ্ড রোদে ছায়া দেয় একটি ছাতা। অন্যের ঘরের বদ্ধ তালা খুলতে তিনি সহায়তা করেন, কিন্তু নিজের ভাগ্যের তালাটার চাবিই এখনো বানাতে পারেননি।
বাবাকে খুব মনে পড়ে বাবুল শেখের। বাবার হাত ধরেই ঢাকায় এসেছিলেন। বাবা মুড়াপাড়া জুটমিলে চাকরি করতেন। বাবুল বড় হলে বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে চলে গেলেন গ্রামে। একদিন বাবুল খবর পেলেন বাবা অসুস্থ। গ্রামে যাওয়ার জন্য গেছেন গুলিস্তানে। বাসে উঠেছেন। পাশেই একটা বাস এল ফরিদপুর থেকে। তাকিয়ে দেখেন সেখানে বাবা জানালায় মাথা দিয়ে বসে আছেন। বাবাকে নিয়ে এলেন নিজের কাছে চিকিৎসার জন্য। নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। চিকিৎসক বললেন, বাড়ি পাঠিয়ে দেন, ভর্তি করে লাভ নেই। পরদিনই বাবা চলে গেলেন গ্রামে। তখন তো ফোন ছিল না। চিঠি আসতেও অনেক সময় লাগত। দুই দিন পর এক আত্মীয় গ্রাম থেকে এসে জানালেন বাবা মারা গেছেন। কবরও দেওয়ার ভাগ্য হয়নি তাঁর। যে বাবা তাঁকে এত বড় করলেন তাঁর শেষ মুহূর্তে পাশে না থাকতে পারার ব্যথাটা খুব অনুভব করেন তিনি। বলেন, ‘গ্রামে থাকলে হয়তো আমাকে এই কষ্টটা পেতে হতো না।’
স্ত্রী কুলসুমকে নিয়েই ছোট্ট সংসার বাবুল শেখের। আজ আট বছর হলো বিয়ে করেছেন তাঁরা। কুলসুম তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। আর পাঁচ বছরের ছোট মেয়ে সুবর্ণা থাকে রাজশাহীতে, তার নানা-নানির কাছে। অনেক কাজই পারেন বাবুল শেখ। কিন্তু সুযোগ নেই বলে কাজ করা হয় না। ইলেকট্রিকের কাজ জানেন, জানেন ড্রাইভিং। তবে এই সব কাজই নিজের ইচ্ছাতে কোনো বন্ধু বা পরিচিত কারও কাছ থেকে শেখা। কোনোটাই কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে নয়। আর কোনো কাজে যোগ দিতে হলে তো কোনো প্রতিষ্ঠানের সনদ দেখানো লাগবে। টাকা দিয়ে শেখার মতো সামর্থ্য বাবুল শেখের ছিল না। তাই অন্যের তালা খোলা ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না।
মেয়েটাও গ্রামেই থাকে। ‘প্রতি মাসে কিছু খরচ সেখানে পাঠিয়ে দিই। এখানে দেখাশোনা করার মতো লোক নেই। আর আমার আয়ও তো কখনো ১০০ আবার কখনো ৩০০। মেয়েকে যদি এখানে রাখি, তাহলে তো চুরি করতে হবে। তবে ও যা হতে চাইবে, তা হতে বাধা দিব না।’ কালো রঙের ছাতাটির নিচে দিনভর বসে থেকে এই স্বপ্নই বুনে চলেন বাবুল শেখ।
শর্মিলা সিনড্রেলা

No comments

Powered by Blogger.